যুগ যুগ ধরেই আমাদের মননে একটা পরিবর্তন এসেছে; আর সেটা হলো শহরে বসবাস করা। বিশেষ করে যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত, তারা মনে করেন সব শান্তি শহরেই! তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা কিন্তু নয়। অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে বসবাস করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলছেন, কিন্তু সেটা হাতে গোনা। কে কোথায় থাকবেন, এটা তো নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু কারো কারো দায়িত্ব তো গ্রামে থাকা। সেখানে তাদের কর্মস্থল আছে, থাকার ব্যবস্থাও রয়েছে।
দুই দিন আগে সংবাদ মাধ্যমে একটি খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন আছে; তারপরও নানা অসুবিধা ও প্রয়োজনীয়তার দোহাই দিয়ে অনেক শিক্ষকই বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ভবনে থাকেন না। পরিবার নিয়ে তারা বাস করেন শহরে। এতে শিক্ষকদের কিছু সুবিধা হলেও ছাত্রদের খুব অসুবিধা হয়। শিক্ষকদের অনেকে হলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন; কিন্তু ক্যাম্পাস থেকে দূরে থাকায় তাদের সব সময় পাওয়া যায় না। অন্যদিকে বাসা খালি পড়ে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় আয়বঞ্চিত হয়। শিক্ষকদের মতো কর্মকর্তারাও ক্যাম্পাসের বদলে বাইরে থাকেন।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসা খালি পড়ে আছে। শিক্ষকরা থাকেন শহরে। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গড়ে প্রায় ২৯ শতাংশ বাসা খালি পড়ে আছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা আছেন ৭ হাজার ৫০ জন। এর মধ্যে শিক্ষক ৪ হাজার ৩১১ এবং কর্মকর্তা ২ হাজার ৭৩৯ জন। বিপরীতে ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট বাসা রয়েছে ৯৮০টি, যার মধ্যে ২৮৫টিই খালি পড়ে আছে।
এমন অবস্থায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসনে বসবাস না করার কয়েকটি কারণের কথা বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসনে থাকলে বেতনের বাড়ি ভাড়ার অংশ কেটে নেয় প্রশাসন। পদমর্যাদা ভেদে তা মূল বেতনের ৩০ থেকে ৫৫ শতাংশ পর্যন্ত। এই টাকার চেয়ে অনেক কম ভাড়ায় শহরে থাকা যায়। দ্বিতীয়ত, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস শহর থেকে দূরে। সন্তানদের পড়াশোনাসহ নানা কারণে শিক্ষকরা শহরে থাকতে পছন্দ করেন। তৃতীয়ত, কিছু ক্ষেত্রে বাসা পুরোনো এবং সুযোগ-সুবিধাও কম।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসনে বসবাস করলে শিক্ষকদের যে কিছু অসুবিধা হয়, তা সত্য। কিন্তু গণহারে শিক্ষকরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আবাসনে বাস করা বন্ধ করে দেন, তাহলে তো দেশ-জাতির জন্য আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথম প্রশ্ন, তাহলে এত খরচ করে সরকারি টাকায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আবাসন তৈরি কেন? বাসা খালি পড়ে থাকতেই নতুন ভবন নির্মাণ কেন? সরকারেরও কিছু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। দ্বিতীয় প্রশ্ন, শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে প্রশাসনিক কাজে যে জটিলতা সৃষ্টি হয়, তার দায়ভারও তো শিক্ষকরা এড়িয়ে যেতে পারেন না।
এ রকম অভিযোগ বাংলাদেশের অনেক চিকিৎসকের ক্ষেত্রেও রয়েছে। তারা মফস্বল শহরে গিয়ে বাস করেন না। প্রয়োজনের সময় তাদের ডেকে পাওয়া যায় না। এ রকমটা যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্ষেত্রে হয়, তাহলে কী হবে? দেশের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। শিক্ষক ও চিকিৎসকরাও যদি নিজেদের সুবিধার কথা ভেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা ছেড়ে শহরে গিয়ে বাস করতে থাকেন, তাহলেও এ রকম কিছু সমস্যা হতে পারে।
শিক্ষকদের যেমন তাদের দায়িত্বের কথা ভাবতে হবে, তেমনি সরকারকেও তাদের কিছু বাড়তি সুবিধা দিতে হবে। একটা সুবিধা হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় ভাড়া কিছু কমানো। শহরের কিছু সুবিধা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে তৈরি করা। শিক্ষকদের সন্তানদের জন্য ভালো স্কুল স্থাপন করা। আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শহর থেকে দূরে। ফলে নাগরিক কিছু সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ায় সেখানকার আবাসিক শিক্ষকদের অসুবিধা হয়, তা সত্য। বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা না হলে উভয়মুখী এসব সমস্যা বাড়তে থাকবে। আমরা চাই শিক্ষকদেরও অসুবিধা না হোক, এবং শিক্ষকদের জন্য নির্মিত বাসাগুলো খালি না পড়ে থাকুক। কাউকে ব্যক্তিগতভাবে দোষারোপ না করে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিলেই এ রকম বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য