প্রসঙ্গ ভারত

বিদ্বেষ ও অস্থিরতার নেপথ্যে কী

আহমেদ তালাত তাহজীব
বিদ্বেষ ও অস্থিরতার নেপথ্যে কী

রাশিয়া কখনোই ইউক্রেনের সঙ্গে আগ্রাসী প্রতিবেশী ছিল না। তারপরেও মার্কিন কালার রেভল্যুশনের ন্যারেটিভ ইউক্রেনীয়দেরকে সফলভাবে রুশবিরোধী মগজ ধোলাই করতে পেরেছিল এবং ইতিহাস বিকৃত করে ধারাবাহিক রুশবিরোধী বিভিন্ন কৃত্রিম উগ্র জাতীয়তাবাদী ইস্যু সৃষ্টি করে রুশ বিদ্বেষী মনোভাব উস্কে দিয়ে ইউক্রেনকে আজকের পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রক্সি গ্রাউন্ডে পরিণত করা হয়েছে এবং এর খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেনের জনগণ নিজেরাই। গম ও সূর্যমুখী তেলের অন্যতম রপ্তানিকারক রাষ্ট্র ইউক্রেন আজ ইউরোপের সবচেয়ে ব্যর্থ রাষ্ট্র শুধুমাত্র মার্কিন সৃষ্ট ন্যারেটিভে প্রভাবিত হয়ে জাতিগত বিদ্বেষের ফলে গৃহযুদ্ধ এবং প্রক্সি যুদ্ধে বিপর্যস্ত। ইউক্রেন এখন এতটাই বিধ্বস্ত যে তাকে পুনর্গঠন করতে হলে এখন ট্রিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন, অথচ ডিভাইড র্যুল ফর্মুলার মার্কিন ন্যারেটিভে প্রভাবিত হয়ে জাতিগত বিদ্বেষে আক্রান্ত না হলে ইউক্রেনকে এই পরিণতি বরণ করতে হতো না।

এদিকে বাংলাদেশের জন্য আধিপত্যবাদী ভারতকে ঘৃণা করার জন্য যা যা করণীয় তার সবই ভারত রাষ্ট্র করেছে এবং করছে। ফলে বাংলাদেশকে মার্কিন ন্যারেটিভের ফাঁদে ফেলতে তেমন কিছুই করতে হচ্ছে না। তারপরও একটা সমাধান আছে।

ইসরায়েল ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বটা ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। ফলে ষাট শত্তুরের দশকে ফিলিস্তিনের মুক্তির আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল কমিউনিস্ট প্রগতিশীল সেক্যুলারদের হাতে। তখন ইজরাইল আগ্রাসন ও ভূমিদখল চালাতে খুব একটা সফল হচ্ছিলো না। কিন্তু এরপরই মোসাদ যখন হামাস নামের সাম্প্রদায়িক একটি সংগঠন বানিয়ে ফিলিস্তিনিদের মুক্তির সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক আকার দিল তখনই সেই আন্দোলন বিভক্ত হয়ে গেল এবং তারপর থেকেই ইজরাইল খুব সফলভাবেই ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে ইজরাইলের মানচিত্র বৃদ্ধি করতে সক্ষম হলো দ্রুততার সঙ্গে। সাম্প্রদায়িকতার মাধ্যমে কোনো শান্তি বা সমাধান আসে না বলেই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ফিলিস্তিনের মুক্তির সংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক সংগ্রাম বানিয়ে তাদের আধিপত্যবাদী উদ্দেশ্য সফল করতে সক্ষম হয়েছিল।

বাংলাদেশও ফিলিস্তিনিদের মতো আহাম্মকি করবে যদি তারা সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে ভারত বিদ্বেষী হয়। ভারতের সঙ্গেও আমাদের বৈরিতা ভূরাজনৈতিক কারণে। ভারত আমাদের সীমান্তে মানুষ মারে, আমাদের ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানি দেয় না, বন্যার কারন হয়, ভারতীয় জেলেরা আমাদের জলসীমা থেকে মাছ চুরি করে, আমাদের রাডার কিনতে দেয় না, সামরিক সক্ষমতা অর্জনে বাধা দেয়, আমাদের ভূমি-সড়ক-বন্দর নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় অথচ কোনো সুবিধা দিতে চায় না, ব্রিক্সের সদস্য হতে বাধা সৃষ্টি করে..... খেয়াল করে দেখেন, এগুলা একটা ইস্যুও সাম্প্রদায়িক না অথচ ভারতের সঙ্গে বিদ্বেষ আমাদের সাম্প্রদায়িক ইস্যু থেকে, এরফলে ভারত বিদ্বেষ শুধু বাড়বেই কিন্তু কোনো সমাধান আমরা পাবো না। ফলে, ভারতের ধুরন্ধর শাসকগোষ্ঠীও চায় বাংলাদেশের মানুষ যেন শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে ভারত বিদ্বেষী হয়, তাতে ভারতের শাসকশ্রেণি নিজ দেশের জনগণকেও সাম্প্রদায়িকতায় উস্কে দিয়ে সেখানকার আর্থসামাজিক সমস্যা এবং শ্রেণিগত লুটপাট থেকে জনগণকে সরিয়ে রাখতে পারবে। খুব সতর্কভাবে বর্তমান পরিস্থিতি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ভারতে বাংলাদেশ বিদ্বেষী বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে; যা পুরাপুরি সাম্প্রদায়িক অবস্থান থেকে অথচ সেখানকার কৃষকদের সমস্যা নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলনের কোন খবর নেই, এদিকে বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষী যা কিছুই হচ্ছে সেগুলা সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে অথচ কেউই পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের প্রশ্নে সরকারকে চাপ দিচ্ছে না। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে উভয় দেশেই জনগণ অস্থির অশান্ত এবং উভয় দেশের লুটেরা শোষকশ্রেণি নিরাপদ এবং আরামে আছে। অথচ উভয় দেশের জনগণ যদি ভারত বাংলাদেশ দ্বন্দ্বটা সাম্প্রদায়িকতার বদলে ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক অবস্থান থেকে দেখতো তখন শোষকশ্রেণির এই আরামে থাকার অবস্থা থাকতো না এবং দ্বন্দ্ব নিরসনে সমাধানের উপায় বের করতে বাধ্য করা যেত। ভারত তার দূরবর্তী রাজ্য সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত করতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে ট্রানজিট চায়, বাংলাদেশের জন্য করণীয় হচ্ছে বিনিময়ে ল্যান্ডলক রাষ্ট্র নেপাল ভুটানের সঙ্গে ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্মতি আদায় করা, ভারত যদি বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর চায় তাহলে বাংলাদেশের উচিত অরুনাচল আসাম হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের স্থলপথে বাণিজ্যিক র্যুটের অনুমোদন চাওয়া। অথচ এসব কূটনীতিক তৎপরতা যা থেকে বাংলাদেশ উপকৃত হতে পারে বিদ্বেষের অবসান ঘটিয়ে তার কিছুই আমরা দাবি করছি না। ভারত বিদ্বেষী যেই সাম্প্রদায়িক উগ্রতার চর্চা আমাদের এখানে চলছে বা পরিচালিত করা হচ্ছে তার থেকে কোনো সমাধান কি আমাদের জন্য আছে? প্রসঙ্গত মনে করা যেতে পারে, ২০১১ সালে কিশোরী ফেলানিকে বিএসএফ কর্তৃক হত্যার পর বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের নেতৃত্বে যেই প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল সেটা কোনো সাম্প্রদায়িক আদল পায়নি এবং একই সঙ্গে ভারতের বিবেকবান জনগণকেও প্রভাবিত করেছিল এবং ফলশ্রুতিতে দীর্ঘসময় বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড বন্ধ ছিল। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বদলে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আমাদের অনেককিছু অর্জন করতে সহায়তা করেছে, পক্ষান্তরে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আমাদের জন্য কোনো প্রাপ্তি বা সুফল বয়ে আনার ইতিহাস নেই।

ফলে উভয় দেশের জনগণকে সেই সচেতনতায় আসতে হবে যে আমাদের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ চর্চার মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়ার মধ্যে কোনো সুফল নেই, কোনো লাভ নেই। বরং আমরা যদি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল অবস্থান থেকে জাতীয় স্বার্থে দ্বন্দ্বটাকে দেখি এবং সমাধানের জন্য ঐক্যবদ্ধ হই তাতে দেশের জনগণ হিসেবে আমাদেরই উপকৃত হবার সম্ভাবনা বাড়ে। অতীতে হিন্দু মুসলিম দ্বন্দ্ব থেকে ভারতবর্ষের জনগণের কোনো উপকার হয়নি, লাভ হয়েছে শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের; সেই বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্বের কারনে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় উভয় দেশ পাল্লা দিয়ে সামরিক সমৃদ্ধি করেছে অথচ কৃষক শ্রমিকের অবস্থা সেই ব্রিটিশ আমলের মতোই আছে। তেমনি ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও বিদ্বেষ থেকে কর্তৃত্ববাদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লাভ হলেও ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই সেই চরম সত্যটা নিজেদেরই উপলব্ধি করে জাতীয় স্বার্থে সচেতন হতে হবে।

লেখক: রাজনীতি বিশ্লেষক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য