বিশ্ববিদ্যালয় হলেই কি তাদের ভাগ্য বদলাবে?

মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
বিশ্ববিদ্যালয় হলেই কি তাদের ভাগ্য বদলাবে?

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ে এর পক্ষে ও বিপক্ষে মানুষের অবস্থান বলে দেয় যে তৎকালীন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা গুরুত্ব ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানের চোখে দেখা হতো। পূর্ববঙ্গে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দেশ-বিদেশ থেকে অনেকটা ধরে আনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার ফিলিপ জোসেফ হার্টগ একজন বিদেশি ছিলেন। এর অবশ্যই কারণও ছিল। পূর্ববঙ্গের কোনো ব্যক্তি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার মতো যোগ্য ছিলেন না। উপাচার্য পদে নিযুক্ত লাভ তো দূরের কথা, শিক্ষক পদে নিযুক্ত লাভের জন্য যেসব যোগ্যতা দরকার হতো তা পূরণ করার মতো শিক্ষিত ব্যক্তির সংখ্যা একেবারেই পূর্ববঙ্গে ছিল না বললেই চলে।

ফলে বাধ্য হয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে পূর্ববঙ্গের বাইরে নজর দিতে হয়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পদে নিয়োগের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারকে ইংল্যান্ডের পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়। ওই নজর দেওয়ার ফল শুভ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য তার পাশ্চাত্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্জিত জ্ঞান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাজাতে কাজে লাগায়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বোসদের মতো শিক্ষক পায়। যদিও বোসরা ধর্মীয় রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে এই বঙ্গে বেশি দিন তাদের কাজ মনোযোগ দিয়ে করতে পারেননি।

তারা পূর্ববঙ্গে টিকতে পারেননি। তাদেরও রাজনীতির ফাঁদে পড়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে হয়। বোসরা চলে যাওয়ার পরও অনেক খ্যাতিমান পণ্ডিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভালোবেসে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে নানা ঝড়-ঝাপটা মাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়ে যান।

ওই সব খ্যাতিমান শিক্ষকদের অনেকে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর পূর্ববঙ্গে গড়ে ওঠা সেক্যুলার গণতান্ত্রিক স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ফলে তাদের অনেককে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকের হাতে প্রাণ হারাতে হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশের অলিগলিতে বিশ্ববিদ্যালয় গজিয়ে উঠলেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠতে দেখা যায় না। তারা বুদ্ধিজীবী না হয়ে পেশাজীবী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। স্রোতে গা ভাসিয়ে জীবন পার করতে পারলেই নিজেকে সার্থক মনে করেন। তাই করপোরেট যুগের ছোঁয়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে লেগেছে। একজন পেশাজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে তাই পার্থক্য করা যায় না। দুজনকে একই দাঁড়ি-পাল্লায় অনায়াসে মাপা যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের চেয়ে বিদ্যাচর্চায় একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা বা সামরিক কর্মকর্তা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে তাদের অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সেই ছাড়িয়ে যাওয়ায় তাদের চাহিদা বাড়ছে। আর ওই চাহিদা বাড়া থেকেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে কাজ করার আগ্রহী হচ্ছেন। সাম্প্রতিক দেশের দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষপদে অবসরপ্রাপ্ত আমলা ও সামরিক কর্মকর্তার নিয়োগ তার বড় প্রমাণ।

কয়েক বছর আগে ওই ধরনের নিয়োগ হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তা নিয়ে আলাপ হতো জোরেশোরে। এখন এই বিষয়গুলো যেন স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে। তাই সাম্প্রতিক আমলা ও সামরিক কর্মকর্তার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে পরিচালিত গ্রুপগুলোয় কোনো আলাপ নেই। সবাই চুপ। স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছে। শিক্ষকরা জানেন এই বিষয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। বরং যারা শিক্ষকদের স্বার্থে কথা বলেন তারাই সবসময় বিপদে পড়েন। সুতরাং স্রোতে গা ভাসিয়ে চুপ থেকে জীবন পার কারাই শ্রেয়। তার ফলে অন্তত রুটি রুজির জোগাড়ে সমস্যায় পড়তে হবে না! এ যুগে কে আর সরদার ফজলুল করিমের মতো বিপ্লবী হতে চায়! কথা বলে বিপদে পড়তে চায়!

সাত কলেজের বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার যে দাবি শিক্ষার্থীরা করছেন সেখানেও ওই রুটি রুজির প্রশ্নই প্রধান। শিক্ষার্থীরা মনে করছেন তাদের কলেজগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হলে এবং তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলযুক্ত সনদপত্র পেলে চাকরির বাজারে বাড়তি সুবিধা পাবেন। তারা সহজে চাকরি পাবেন। একটু গর্ব করে বলতে পারবেন তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এর বাইরে সামগ্রিক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। শিক্ষকরা আন্দোলন করেন তাদের বেতন বাড়ানোর জন্য। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন তাদের বেতন কমানোর জন্য। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার জন্য কখনও আন্দোলন করতে দেখা যায় না। তাই তো জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্ররা মূল ভূমিকা রাখলেও অভ্যুত্থানের পর ছাত্র-শিক্ষকরা ক্ষমতার মসনদে বসলেও শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্থার নিয়ে ওই অর্থে কোনো আলাপ-উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

চারদিকের হাহাকার দেখে মনে হয় জুলাই অভ্যুত্থানের সব লক্ষ্য যেন রাজনীতির সংস্থার ও ক্ষমতার লড়াইয়ের বৃত্তে আটকে আছে। দেশ গোছানোর পথে অনেকের আগ্রহ নেই। যদি দেশ গোছানোর আগ্রহ হতো সব কিছুর কেন্দ্র তাহলে সেখানে শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে বদলের কথা ভাবা হতো সবার আগে। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া, সংস্কার ছাড়া অন্য কোনো সংস্কার বা উদ্যোগ টেকসই হবে না।

আর শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ছাড়া সাত কলেজ কেন, হাজার কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় বানালেও শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন হবে না। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কেবল নামকাওয়াস্তে বিশ্ববিদ্যালয় হবে। দেশের সামগ্রিক বিষয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কোনও ভূমিকা রাখতে পারবে না। এমন নামকাওয়াস্তে বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে বহু আছে। সরকারি ও বেসরকারি মিলে যে কয়েক শত বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার কয়টি সত্যিকার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে?

দেশে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ওই প্রশ্ন করার দরকার সবার আগে। যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলোর মধ্যে শ্রেণি বিভাজন করে গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা দরকার এখনই। ঘরে ঘরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না করে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে পারলে তখন দেশ উপকৃত হবে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও তখন উপকার পাবে।

তারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় যুক্ত হতে পারবেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেওয়ার স্বাদ পূরণ করতে পারবেন। তখনই কেবল তাদের ভাগ্যের বদল হবে। তারা উচ্চতর গবেষণায় যুক্ত হলে দেশ উপকৃত হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য