জনগণের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণের পথে সরকারের তেমন অগ্রগতি নেই

এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম
জনগণের অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণের পথে সরকারের তেমন অগ্রগতি নেই

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানার জন্য যে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেছিল, সে কমিটি ইতোমধ্যেই তাদের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে। বিভিন্ন সূত্রে শ্বেতপত্রের যেসব দুর্নীতি অনিয়মের তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তা যেকোনো বিবেকবান মানুষকেই আতঙ্কিত করবে। দেশের অর্থনীতির অবস্থা যে খুব একটা ভালো নয়, তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। বিশেষ করে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে। অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরে আসবে সাধারণ মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে; কিন্তু মানুষের সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে তেমন কোনো অগ্রগতি এখনো লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আগামীতে নানা জটিল সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে। এটা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চলার পথ কুসুমাকীর্ণ হবে না। তাদের নানা ধরনের সমস্যা এবং প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। এমনিতেই বাংলাদেশ সরকারের সময়ই নানা জটিলতা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সেই চ্যালেঞ্জটা আরও কঠিন এবং জটিল হবে বলেই মনে হচ্ছে।

দেশের বিপর্যয়কর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সাধারণভাবে গণআন্দোলনের মাধ্যমে কোনো সরকারের পতন বা পরিবর্তন হলে তাৎক্ষণিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে; কিন্তু এবার তেমনটি প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। সরকার পরিবর্তনের পর প্রায় ৫ মাস সময় অতিবাহিত হলেও এখনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসেনি। বিভিন্ন স্থানে হানাহানি, মিটিং-মিছিল হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে চুরি-ডাকাতির মতো ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মারধর হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংঘবন্ধ হয়ে হানাহানির ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে মোটেও সন্তোষজনক বলা যাবে না। একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে কোনো উন্নয়ন কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রা বিপন্ন হতে বাধ্য।

বিশ্বব্যাংক কর্তৃক কয়েক বছর আগে প্রণীত সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৬তম। সেই অবস্থা থেকে তেমন কোনো উত্তরণ ঘটেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ সূচক প্রকাশ কয়েক বছর ধরে বন্ধ আছে। এর পরিবর্তে সংস্থাটি ‘বিজনেস রেডি’ নামে নতুন একটি সূচক প্রকাশ করেছে। মোট ৫০টি দেশকে বিবেচনায় নিয়ে এই সূচক প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বাংলাদেশ ১০০ পয়েন্টের মধ্যে ৫৩ দশমিক ৮৬ পয়েন্ট অর্জন করেছে। বাংলাদেশকে চতুর্থ সারিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। তার অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশ এখনো উন্নত হয়নি। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ খুবই কঠিন হবে। বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে আগামীতে দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যের বাস্তব পরিবেশের আরও অবনতি ঘটতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যকর এবং অধিকতর গতিশীল হবার ক্ষেত্রে জ্বালানি সংকট একটি বড় সমস্যা। প্রাকৃতিক গ্যাস, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যা রয়েছে। জ্বালানির চাহিদা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে সরবরাহ ঠিক সেভাবে বাড়ছে না। ফলে জ্বালানি সংকট দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভ্যন্তরীণভাবে স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। একইভাবে সমুদ্র থেকে গ্যাস এবং জ্বালানি তেল অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও তেমন কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। বেশ কয়েক বছর আগেই আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমা চিহ্নিত এবং নির্ধারিত হয়েছে। মিয়ানমার এবং ভারত তাদের নিজস্ব সমুদ্র সীমায় জ্বালানি তেল, গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়ে সফলতা পেয়েছে। আমাদেরও এ ব্যাপারে আরও গতিশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে অনেক দুর্বলতা আছে। যেসব অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে তা কতটা গুণগত মানসম্পন্ন এবং উন্নয়নে সহায়ক তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয়ও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। অধিকাংশ অবকাঠামো নির্মাণকাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন হয়নি। ফলে ব্যয় যেমনÑ বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি মানুষ এগুলো থেকে উপকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে আরো একটি জটিল সমস্যা হচ্ছে বন্দর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। পণ্য লোড এবং খালাস করার ক্ষেত্রে অনেক বিলম্ব হয়। ব্যয়ও বেশি হয়। একই সঙ্গে আবার পরিবহনের সমস্যা আছে। ফলে বন্দর থেকে আমদানিকৃত পণ্য খালাস হবার পর উদ্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছুতে অনেক বিলম্ব হয়। এতে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি পায়।

এসব কারণে দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাক্সিক্ষত মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। জিডিপি-ইনভেস্টমেন্ট রেশিও অনেক দিন ধরেই ২২-২৩ শতাংশে ওঠানামা করছে। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাস এবং এ বছর জুলাই-আগস্ট ব্যতীত গত সরকারের আমলের প্রায় পুরোটাজুড়েই দেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল না। কিন্তু এক ধরনের অনিশ্চয়তা সব সময়ই বিরাজমান ছিল। দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বিরাজ করলে সেই অবস্থায় বিদেশি এবং স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিধান্বিত থাকেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা সেই অবস্থাই প্রত্যক্ষ করছি। গত পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৮ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল; কিন্তু সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার জিডিপির ২৭ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবার কোনোই সম্ভাবনা নেই। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আশাব্যাঞ্জক না হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম হয়। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলে পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয় না।

আর কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি না পেলে দেশে বেকারের সংখ্যা বেড়ে যায়। ফলে দারিদ্র্যবিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ওপর দেশের উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা অনেকাংশেই নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির হারের প্রাক্কলন কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারবে না। অর্থবছরের প্রথম মাস থেকেই দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয় যার রেশ এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ফলে এ বছর অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জন করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিয়ে যে প্রক্ষেপণ প্রকাশ করে তা সাধারণত সঠিক হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ঋণ মান কমিয়ে দিয়েছে। এটা বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এ মুহূর্তে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। যদিও এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্টি হয়নি। বিগত ২ বছরের বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। করোনা উত্তর বিশ্ব অর্থনীতি যখন উত্তরণের পর্যায়ে ছিল ঠিক তখনই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বব্যাপী দেখা দেয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল; যা ছিল দেশটির অর্থনীতিতে বিগত ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব আমেরিকা (ফেড) নানা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়। ফেড উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বার বার পলিসি রেট বাড়িয়েছে। পলিসি রেট বাড়ানো হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মন্থরতা দেখা দিতে পারে। সেই আশঙ্কা সত্ত্বেও তারা বারবার পলিসি রেট বৃদ্ধি করেছে। কিছু দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে। এখন ফেড পলিসি রেট কমানোর চিন্তা-ভাবনা করছে। শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যাগ্রস্ত দেশটির মূল্যস্ফীতি এক পর্যায়ে ৭৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল। এখন দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে; কিন্তু বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা করেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে মূল্যস্ফীতির গড় হার ডাবল ডিজিটের ওপরে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ কয়েক মাস ধরেই ডাবল ডিজিটের ওপরে রয়েছে। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় দেশের সাধারণ দরিদ্র এবং নির্ধারিত আয়ের মানুষগুলো বড়ই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। তাদের আয় যে হারে বাড়ছে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে চেষ্টা করলেও এখনো উচ্চ মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

কয়েক মাস আগেও ব্যাংক ঋণের সুদের সর্বোচ্চ হার ছিল ৯ শতাংশ। সেই সময় পলিসি রেট বার বার বাড়ানো হয়েছে। পলিসি বৃদ্ধির মাধ্যমে বর্তমানে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। আগে পলিসি রেট ছিল ৫ শতাংশ। বর্তমানে পলিসি রেট বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে; কিন্তু তারপরও উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এই উদ্যোগ তেমন কোনো সুফল দিতে পারছে না। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ চাহিদা কমে যায়। ফলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানো হলে ঋণের চাহিদা হয়তো কমে যাবে; কিন্তু একই সঙ্গে ঋণের সরবরাহও কমে যাবে; যা অর্থনীতির গতিকে মন্থর করে দিতে পারে।

বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে এক শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি খাতে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন। কাজেই বাংলাদেশ যদি ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় তাহলে ব্যক্তি খাতে ২৮ থেকে ৩৫ শতাংশ বিনিয়োগ হতে হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নিয়ে যে তথ্য প্রকাশ করে তার বাস্তবতা নিয়ে অনেকের মনেই সংশয় রয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে উন্নয়ন সহযোগিরা তার চেয়ে অন্তত ১ থেকে দেড় শতাংশ কম প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করে থাকে; কিন্তু বছর শেষে কোনো পক্ষই তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে না। একটি নির্দিষ্ট বছর কোনো দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তো দুরকম হতে পারে না। এখানে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা আছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সবাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভোগ করতে পারছে না। ফলে আবৈষম্য দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।

দেশের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে যাচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে শহরে অনেকেই কর্মহারা হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। তারা গ্রামে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনি। বাংলাদেশে বেকার মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখের মতো বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিভিন্ন সময় জানিয়েছে; কিন্তু দেশের বাস্তব অবস্থা এই তথ্যকে প্রতিফলিত করে না। আর উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে বেকার নির্ধারণ করা হয় আমাদের দেশে তা করলে হবে না। কারণ উন্নত দেশগুলোতে বেকারদের বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা হয়। আমাদের এখানে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মূল্যস্ফীতির যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করে তার বাস্তবতা নিয়েও অনেকের মনেই প্রশ্ন রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে নির্মোহভাবে বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ করতে হবে। কারণ যেকোনো সিদ্ধান্তগ্রহণ বা পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে সঠিক পরিসংখ্যানের আবশ্যকতা রয়েছে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য