মাতৃভূমি ছেড়ে থাকার বেদনা বলে বুঝানো যায় না। প্রবাসে কেউ থাকলেও তার মনটা পড়ে থাকে নিজ দেশে। কেউ যদি বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যদেশে থাকে, তাহলে তো তার দুঃখের শেষ নেই। এমনই একটা সম্প্রদায় হলো রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এই জনগোষ্ঠীর অন্তত ১২ লাখ মানুষ বহু বছর ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছে। তাদের অন্তত ৭ লাখ এসেছে ২০১৭ সালে দেশটির সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে। বাকিদের অনেকে অনেক আগে থেকেই এদেশে বসবাস করছিল এবং অনেকের জন্ম হয়েছে এখানে। বারবার মিয়ানমার সরকার তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তা বাস্তবায়ন হয়নি। কিন্তু বুকভরা স্বপ্ন, ছন্দহীন জীবন এবং নিজ বাসভূমে ফিরে যাওয়ার অন্তহীন আকুতি নিয়ে দিনাতিপাত করছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা। তারা গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের জান্তা প্রধানের বিচার চান। ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আসবে বলে আশা করেন তারা। জান্তা প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য আবেদন করায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলির প্রতি কৃতজ্ঞতারও শেষ নেই রোহিঙ্গাদের।
বছর সাতেক আগে, প্রাণে বাঁচতে জন্মভূমির মায়া ছেড়ে নাফ নদীর এপার ওপারের কাদামাটি মাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের এক অনিশ্চিত যাত্রায় হতবাক হয় বিশ্ব। সেনাদের নির্যাতনের ঘটনায় ওঠে নিন্দার ঝড়। সহিংস এ কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা আখ্যা দেয় জাতিসংঘ। অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে আইসিসি, চলে চার বছরেরও বেশি সময়। তদন্তের স্বার্থে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান তিনবার পরিদর্শন করেন কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প। সংগ্রহ করেন যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত। সাত বছর পর অবশেষে মিয়ানমারের জান্তা প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদনে নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন রোহিঙ্গারা।
ক্যাম্প-১ ডব্লিউ, ব্লক-সি এর বাসিন্দা জোহার (৩৬) বলেন, আমরা আমাদের দেশে চলে যাব, এটা পুরোপুরি আশা রয়েছে। এখন তো রাখাইন হচ্ছে আগুনের গোলার মতো। ২০১৭ সাল থেকে সেখানে অত্যাচার চালিয়ে আসছে জান্তারা। এখন আগুনের গোলার মধ্যে কীভাবে যাব? আমাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে তা বিশ্বের কারও ওপর হয়নি। বিশ্ব যদি আমাদের রাখাইনে নিরাপত্তার সঙ্গে পাঠানো ব্যবস্থা করে তাহলে যেতে পারব।
ক্যাম্প-৩ ব্লক-এ ৪ এর বাসিন্দা মোহাম্মদ জাবের (২১) বলেন, ক্যাম্পে থাকা তো অনেক কষ্টের। বৃষ্টি হলে ভিজতে হচ্ছে আবার রোদের তাপে পুড়তে হচ্ছে। ক্যাম্পে কোনো বিদ্যুৎ নেই, পাখা নেই। ক্যাম্পের জীবনটা অনেক কষ্টের।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত হলে স্বস্তি পাবে মিয়ানমারের মানুষ। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের কাছেও নিজ বাসভূমিতে ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি করেছেন তারা।
উখিয়ার ক্যাম্প-৩ এর হেড মাঝি ফয়েজুল ইসলাম (৪৬) বলেন, আন্তর্জাতিক আদালতের কৌঁসুলি করিম খান ক্যাম্পে এসে কথা বলেছে। আমরা সাত বছর ধরে আশা করে বসে আছি, অবশ্যই মিয়ানমারের জান্তা সরকার রোহিঙ্গাদের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে এটার বিচার হবে। আগে ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বিচার হবে আশা করেছিলেন। কিন্তু এবার ক্যাম্পে করিম এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, এখন শতভাগ রোহিঙ্গারা বিশ্বাস করেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট হবে এবং বিচার মিলবে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, মিয়ানমারের জান্তা প্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মিং অং হ্লাইংয়ের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছেন। এর জন্য আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খানকে শুকরিয়া জানাচ্ছি। যে নিরীহ লোকজনকে হত্যা করছে, তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মুখোমুখি করানো গেলে পুরো মিয়ানমারের জনগণ শান্তি পাবে। এই সাফল্যের জন্য পুরো বিশ্ব একসঙ্গে সহযোগিতা করবে বলে আশা করছি।
জোবায়ের আরও বলেন, মিং অং হ্লাইং যতবড় গাদ্দারিই করুক না কেন, তিনি পৃথিবীর বাইরের কেউ নন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সবাই একে অপরকে সহযোগিতা করলে তার বিরুদ্ধে দ্রুত গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও বের হবে এবং গ্রেপ্তার করে আদালতের মুখোমুখিও করা সম্ভব।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য