মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে এক ঐতিহাসিক রীতির কথা তুলে ধরা যাক; যা রোমান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের। ধরুন, একজন রোমান শাসক কোনো আদেশ জারি করতে যাচ্ছেন। যেমন, আমাদের দেশে সরকারি আদেশের শুরুতে জাতীয় প্রতীক হিসেবে শাপলা ফুল এবং ধানের শীষ ব্যবহার করা হয়, রোমান শাসকের আদেশপত্রে একটি বিশেষ প্রতীক ব্যবহার হতো। এটি ছিল অ্যালম বা ব্রিচ গাছের সোজা, সমান দৈর্ঘ্যরে এবং ব্যাসের কয়েকটি ডাল একত্র করে লাল ফিতায় বাঁধা। এটি ছিল ঐক্য ও শক্তির প্রতীক। এই প্রতীকটি রোমান শাসনের ক্ষমতার ভিত্তি এবং সমাজব্যবস্থার প্রতীকী উপস্থাপনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
এটি মূলত শক্তি, সংহতি এবং কর্তৃত্বের ধারণাকে তুলে ধরে। একই প্রতীক আরেকটি ভিন্ন রূপেও ব্যবহৃত হতো, যেখানে ডালপালার মাঝে একটি কুঠারের মাথা বেরিয়ে থাকতো।
যখন প্রতীকে কুঠার থাকতো না, তখন এটি বোঝাতো যে রোমে কোনো একনায়ক (ডিক্টেটর) নেই এবং এটি প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করতো। এই ধরনের প্রতীক ব্যবহার করে একজন লিক্টর (শাসনের প্রতিনিধি) আদেশ জারি করতেন; যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক ছিল। সংকটকালে প্রয়োজনে একজন ডিকটেটর নিয়োগ দেওয়ানো যেত। ডিকটেটর যখন আদেশ জারি করতেন, তখন কুঠার সমেত প্রতীকটি ব্যবহৃত হতো; যা শক্তি, কর্তৃত্ব এবং শাসকের একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতীক ছিল। এই প্রতীকদ্বয়কে বলা হতো ফ্যাসেস।
ইতালিয়ান শাসক বেনিতো মুসোলিনি কুঠার সমেত রোমান ফ্যাসেস প্রতীক থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তার দলের নাম ও আদর্শ গঠন করেছিলেন। আধুনিক ফ্যাসিবাদের ধারণার শিকড় মুসোলিনির এই আদর্শেই নিহিত, তবে মুসোলিনির শাসনের বৈশিষ্ট্য ফ্যাসিবাদের পরিধি বা প্রকৃতিকে সম্পূর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করে না; এটি তারও বাইরে বিস্তৃত। ফ্যাসিবাদ ২০শ’ শতাব্দীর শুরুর দিকে একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এটি কর্তৃত্ববাদী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ; যা ব্যক্তি অধিকারকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র ও নেতার প্রতি আনুগত্যকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়।
ইতিহাসে এটি বিভিন্ন দেশে বিকশিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য :প্রথমত, ইতালি (১৯২২-১৯৪৩) : নেতৃত্বে ছিলেন বেনিতো মুসোলিনি। ১৯২২ সালে মার্চ অন রোমের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে ইল ডুচে (দ্য লিডার) ঘোষণা করেন। তার শাসন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দমন, রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্যাতন এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে।
দ্বিতীয়ত, জার্মানি (১৯৩৩-১৯৪৫) : নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। জার্মান ফ্যাসিবাদের রূপ ছিল নাজি মতবাদ; যা হিটলারের নেতৃত্বে বিকশিত হয়। ১৯৩৩ সালে চ্যান্সেলর হয়ে হিটলার দ্রুত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন। ন্যাজি মতবাদে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব, ইহুদি বিদ্বেষ এবং সামরিক আগ্রাসন ছিল মুখ্য।
তৃতীয়ত, স্পেন (১৯৩৬-১৯৭৫) : নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রান্সিসকো ফ্রাংকো। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ (১৯৩৬-১৯৩৯) শেষে ফ্রাংকো একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনে বিরোধীদের নির্মমভাবে দমন করা হতো।
চতুর্থত, জাপান (১৯২০-১৯৪৫) : সামরিকতন্ত্রের সঙ্গে মিশে চরম জাতীয়তাবাদে রূপ নেয়। সম্রাট হিরোহিতোর অধীনে এবং সামরিক নেতাদের নেতৃত্বে, জাপান সামরিক আগ্রাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসনে এগিয়ে যায়।
পঞ্চমত, পর্তুগাল (১৯৩২-১৯৭৪) : নেতৃত্বে ছিলেন অ্যান্টোনিও ডি অলিভেইরা সালাজার। এস্তাদো নোভো (নতুন রাষ্ট্র) নামে ফ্যাসিস্ট ধাঁচের সরকার চালু করেন; যা অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিকভাবে জনগণকে কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতো।
এছাড়াও অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি এবং পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে ফ্যাসিস্ট আদর্শ গৃহীত হয়। উদাহরণস্বরূপ, হাঙ্গেরির অ্যারো ক্রস পার্টি, রোমানিয়ার আয়রন গার্ড এবং অস্ট্রিয়ার ডলফাস শাসন। লাতিন আমেরিকায়ও ফ্যাসিস্ট ধাঁচের শাসনের উপস্থিতি দেখা যায়, যেমন- ব্রাজিলের ইন্টেগ্রালিস্ট আন্দোলন এবং আর্জেন্টিনার হুয়ান পেরনের শাসন। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদ এক প্রকারের বিপ্লব হিসেবে দেশ থেকে দেশান্তরে এবং মহাদেশ থেকে মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর কার্যকারিতা নিঃসন্দেহে প্রভাবশালী ছিল। তবে প্রশ্ন হলো, কেন একই শতাব্দীতে এটি এত বিস্তৃতভাবে বিকশিত হলো?
উত্তরটি মনস্তাত্ত্বিক। যখন কোনো জাতি দারিদ্র্য ও অসম্মানে ডুবে থাকে, তখন ফ্যাসিস্ট আদর্শের শাসনে তারা শক্তি ও আস্থা খুঁজে পায়। উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে শুরুতে সাধারণ মানুষ এর বিরোধিতা করে না। উল্লিখিত সব ফ্যাসিস্ট শাসনই শুরুর দিকে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে ফ্যাসিবাদ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ফ্যাসিস্ট নেতারা বা দলসমূহ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে এবং আরও আগ্রাসী ভূমিকা নেয়; যার ফলে চরম মানবাধিকারের বিপর্যয় ঘটে।
সবচেয়ে বড় কথা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিস্তার এবং ইউরোপজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞের একটি বিশেষ কারণ ছিল এই ফ্যাসিবাদের বিপ্লব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ফ্যাসিবাদ কেন ছড়িয়ে পড়ে বা কোনো শাসনব্যবস্থা কেন ফ্যাসিবাদে রূপ নেয়? এর উত্তর দেওয়া কঠিন নয়।
যদি আমরা লক্ষ করি, ফ্যাসিবাদ যেখানে যেখানে বিস্তার লাভ করেছে, সেসব রাষ্ট্রের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত তিনটি বিষয় একসঙ্গে বা আংশিকভাবে অনুপস্থিত ছিল।
এই কারণগুলো হলো : অর্থনৈতিক দৈন্যতা, প্রচলিত শাসনব্যবস্থার প্রতি চরম অনাস্থা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির চরম দুর্ভোগ।
মূলত এই তিনটি কারণেই ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কারণ, নতুন নেতৃত্ব সাধারণত শুরুতেই অর্থনৈতিক সমাধান দিতে পারে না। তাই তারা জনগণকে উগ্র জাতীয়তাবাদের একটি ধারণায় সম্মোহিত করে রাখে। এর অর্থ হলো- বাস্তব সমস্যাগুলো সমাধানের পরিবর্তে তাদের একরকম মাদকে আসক্ত করে সাময়িক স্থিতিশীলতা তৈরি করা হয়। এই সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের নতুন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সুযোগ নেয়।
এছাড়াও বিক্ষিপ্ত, আন্দোলনপ্রবণ, পরস্পরের প্রতি আস্থাহীন এবং অধৈর্য জাতিকে সংঘবদ্ধ করার প্রচেষ্টা হলো ফ্যাসিজমের অন্যতম উদ্দেশ্য। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে, যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যহীনতা এবং কর্তৃত্বের সর্বোচ্চতার ওপর জোর দেওয়া হয়। সমস্যা হলো- উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা ফ্যাসিবাদে করা হয়, তা বেশির ভাগ সময়ই হয় অতিরঞ্জিত এবং বৈষম্যে ভরা। অর্থাৎ এই জাতীয়তাবাদী বিশ্বাসকে একমাত্র সত্য ধরে যারা এর বাইরে থাকে, তাদের চরমভাবে দমন করা হয়।
বর্তমানে এ বৈশিষ্ট্য ও আচরণের সঙ্গে আওয়ামী লীগের শাসনামলের মিল থাকার কারণেই তাদের দেশজুড়ে ফ্যাসিবাদী বলে আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা জরুরি, যদি কেউ আওয়ামী লীগের সমালোচনার পাশাপাশি তাদের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে অথবা অপকর্ম, দুর্নীতি ও মানবতাবিরোধী কাজের চেয়ে রাজনৈতিক তাত্ত্বিক আদর্শ ও ইতিহাসের প্রতি সমর্থনসূচক মন্তব্য করে, তবে তাকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলা কিন্তু নিজেই চরম ফ্যাসিবাদী আচরণ।
ফ্যাসিবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করাই গণতন্ত্রের প্রকৃত চেতনা। তাই সমালোচনা বা বিরোধিতা করতে গিয়ে একই ধরনের দমনমূলক আচরণ করা নিজেও এক ধরনের অসহিষ্ণু ও ফ্যাসিবাদী মনোভাবের প্রকাশ। ফ্যাসিবাদের পুনঃআবির্ভাব যেন না ঘটে বর্তমান সরকারের কাছে সেটাই আমাদের কাম্য। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যেভাবে অস্থিতিশীল হয়েছে, তা বিগত ১৫ বছরে কখনোই এমন ছিল না। একইভাবে, মবক্রেসি এবং ‘মব জাস্টিস’ যেভাবে রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে, তা একেবারেই নজিরবিহীন।
এছাড়া যেভাবে অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিকভাবে অলীক দাবি নিয়ে রাস্তায় জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে, তা সহনীয় পর্যায়ে আর নেই। সরকারের ওপর জিম্মি করার চেষ্টা যেন আরও তীব্র হচ্ছে। দেশের কিছু শিক্ষার্থীরা যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, সেটি এখন লাগাম টানার পর্যায়ে চলে এসেছে। এমতাবস্থায়, সরকারকে হয়তো বেশি বল প্রয়োগ করতে হতে পারে এবং এখান থেকেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হতে পারে। ইতিহাসেও আমরা রোমান শাসনের সময়ে তেমনটাই দেখেছি। সত্যি বলতে, সবসময় সরকারের ইচ্ছে থাকে না ফ্যাসিবাদী হওয়ার, তবে মাঝে মাঝে পরিস্থিতির চাপে তাদের এই বিপজ্জনক পথে অবতীর্ণ হতে হয়। সুতরাং, সাবধান! এই সরকার কিংবা পরবর্তী কোনো সরকারকে যাতে আমরা তাদের ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য না করি।
লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য