গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান

ওয়ারেছা খানম প্রীতি
গ্রামীণ অর্থনীতিতে নারীর অবদান

আপনার কি গ্রামের বাড়ি আছে? অথবা আপনি কি গ্রামে বসবাস করেন? যদি উত্তর হ্যাঁ হয় তবে এই দুই ক্ষেত্রেই আপনি টের পেয়েছেন গ্রামের নারীদের কর্মকাণ্ড কেমন, কী নিয়ে এবং সেটা কত ব্যাপক! আমি যদি গেরস্তবাড়ির কিংবা দিনমজুরের ঘর থেকে শুরু করি তাহলে বলবো গ্রামের কোনো বাড়িতে হাঁস-মুরগির মাংস ও ডিম কিনে খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না, এমনকি কিনে খাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না সবজিরও।

উপরন্তু প্রতিটা বাড়ির গৃহিণীরা উঠান খামার করে পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পরে আয়ও করে থাকেন। যুগ যুগ ধরে উঠান খামার খুব জনপ্রিয় একটা মাধ্যম গৃহিণীদের হাত খরচের পয়সা জোগাড়ের জন্য। সেটাই বর্তমানে আধুনিকায়ন হয়েছে অর্গানিক খাবারের হাত ধরে।

বিভাগীয় শহরগুলোয় এখন অর্গানিক খাবার খুব জনপ্রিয়। সেখানে উল্লেখযোগ্যভাবে বাজারজাত করা হয় গ্রামের নারীদের উঠান খামার থেকে সংগৃহীত পণ্য। তালিকায় কী নেই! শুটকি, ডালের বড়ি কিংবা পিঠা থেকে শুরু করে হাতে তৈরি নানাবিধ ঘরোয়া শুকনা খাদ্যদ্রব্য ও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্য!

এত গেল শুধু খাবারের কথা। গ্রামের নারীদের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম সেলাই ও হস্তশিল্প। সেই ক্ষেত্রটাও ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া পেয়ে এখন সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। মধ্যসত্ত্বভোগী কিংবা বলা যায় আউটসোর্সিং করেন এমন ব্যক্তিরা দেশের বাইরে থেকে অর্ডার এনে গ্রামের নারীদের মাধ্যমে হস্তশিল্পের কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। ফলে নারীর আর্থিক সচ্ছলতা বহুগুণে বেড়েছে।

একটা ব্যাপার এখানে বেশ স্পষ্ট সেটা হলোÑ যতই প্রত্যন্ত গ্রাম হোক কোনো নারী চাইলেই তার নিজস্ব গণ্ডিকে এখন বর্ধিত করার ক্ষমতা রাখেন কারণ; ইন্টারনেট সুবিধা। প্রচুর নারীকে দেখেছি প্রথমে অন্যদের চাহিদা মতো সাপ্লাই দেওয়া শুরু করে পরবর্তীতে নিজেই অনলাইনে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী তার উঠান খামারের বা হাতে তৈরি খাবারের বা হস্তশিল্প ডেলিভারি দিচ্ছেন। প্রি অর্ডার নিয়ে পণ্য তৈরি করছেন।

গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি সম্পর্কে আমরা জানি। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। কৃষিভিত্তিক সেই কর্মযজ্ঞে মোট শ্রমদানকারীর ৫৭ শতাংশ যে নারী এটাও আমরা পরিসংখ্যানের মাধ্যমে জানি। আরও জানি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ২১ ধাপের মধ্যে ১৭টির সঙ্গেই নারী যুক্ত।

মূলত প্রাচীনকাল থেকেই বিষয়টা গ্রামীণ জীবনাচরণে ভীষণরকম সহজাত। কিছু কিছু কাজে তো আবার নারীই অগ্রণী। তবে যুগ বদলের সঙ্গে কৃষির সবক্ষেত্রেই নতুন নতুন প্রযুক্তি যুক্ত হয়েছে। সেখানে নারীর সম্পৃক্ততাও নতুনভাবে সৃষ্টি হয়েছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনতে কখনো একেবারে নতুন, দ্রুত ফলনশীল ও উন্নত জাতের বিদেশি কৃষিপণ্য গ্রামীণ নারীদের হাত ধরেই উৎপাদিত হচ্ছে ও প্রসার পাচ্ছে।

কৃষিবিভাগ এসব ট্র্যাক রাখে। বাৎসরিক তথ্য ডকুমেন্ট আকারে জনসম্মুখে শেয়ার করে। তবে খুব নীরবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে অনেক নতুন খাত। অর্থনীতিতে অবদান রাখা সেই খাতগুলোর কি ট্র্যাক রাখা হচ্ছে! ঠিক জানি না। সেসব নিয়ে কথা বলতে চাই।

গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেটকেন্দ্রিক কার্যক্রম শুধু শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠীর মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ নেই। সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল। মোবাইল মানেই ইন্টারনেট থাকা চাই। তাই প্রায় সবাই তথ্য সমৃদ্ধ। ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে ভিডিও ও রিলের মাধ্যমে উপার্জনের কথা সবার জানা।

অসংখ্য নারী এখন তাদের প্রাত্যহিক গ্রামীণ জীবনযাপনের ভিডিও ও রিল তৈরি করে ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে উপার্জন করছে। তাদের বলা হচ্ছে কনটেন্ট ক্রিয়েটর। মিলিয়ন মিলিয়ন ফলোয়ার তাদের। ডিজিটালাইজেশনের এই সময়ে ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে উপার্জন এখন শুধু গ্রামীণ নয় জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে নতুন এই খাত।

বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের ফ্রিল্যান্সিং খাতকে যেমন জিডিপিতে কাউন্ট করা হয় ঠিক তেমনভাবে ফেসবুক ও ইউটিউব মনিটাইজেশন থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রাকেও জিডিপিতে কাউন্ট করা হচ্ছে। কত নারী এই খাতে কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে কাজ করছেন এই ব্যাপারে বিশদ পরিসংখ্যান দরকার।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে নিঃসন্দেহে এটি নতুন মাত্রা। বিভিন্ন বয়সী নারীদের কেউ এককভাবে কনটেন্ট ক্রিয়েট করছেন, কয়েকজন মিলে কনটেন্ট ক্রিয়েট করছেন আবার কখনো পরিবারের সদস্যরা মিলে করছেন। সেই কনটেন্ট তৈরিতে বিশেষ মেধাবী হতে হয় এমন নয়। কোনো একটা ভিডিও এডিটিং অ্যাপের ব্যবহার শিখে নিলেই কাজ চালানো যায়।

গ্রামের সহজসরল জীবনাচরণ শহুরে মানুষকে মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতাকে কেন্দ্র করেই কনটেন্ট ক্রিয়েট খাত আস্তে আস্তে বিশাল হচ্ছে। এক মিনিটের রিল, ছোট ছোট একবার ভিডিও দেখতে শুরু করলে ঘণ্টা পার করে দেয় মানুষ। উপার্জনের এই খাতে সারাদেশের লাখ লাখ কনটেন্ট ক্রিয়েটরের মতো প্রচুর গ্রামীণ নারীও কাজ করছেন। এবং এই সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে।

মানুষের এলাকাভিত্তিক জীবনাচরণ অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। যেমন উত্তরবঙ্গের কৃষির সঙ্গে নারীর সম্পর্ক পুরোনো। শস্য লাগানো ও কাটার মৌসুমে শ্রমদানকারী বাঙালি বা সাঁওতাল নারীর সঙ্গে গেরস্ত বাড়ির নারীকেও যুগপৎ কাজ করতে দেখা যায়।

অনেকক্ষেত্রেই পুরুষ ঘরে বসে থাকে। উত্তরবঙ্গের শ্রমজীবী শ্রেণির ভেতরে বহু বিবাহের চল আছে। নিজে কাজ না করে তারা স্ত্রীদের কাজে পাঠায় কিন্তু দিনশেষে বা মাস শেষে পারিশ্রমিক স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়। সেটাই স্বামী খরচ করে। স্ত্রীদের কখনো টাকার প্রয়োজন হলে স্বামীর কাছ থেকে নিজের উপার্জিত টাকা চেয়ে নিতে হয়। প্রয়োজন মনে না করলে স্বামী টাকা দিতে অস্বীকারও করতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে উত্তরবঙ্গের শ্রমজীবী শ্রেণি বহু বিবাহ করেই স্ত্রীর উপার্জিত টাকা বসে বসে খাওয়ার জন্য। এটাও একটা জীবনাচরণ এবং সেখানে নারীই অর্থনীতির ধারক।

যত যাই বলি না কেন গ্রামীণ অর্থনীতিকে চিরকালই লিড করবে কৃষি, অন্তত যতক্ষণ না কৃষিজমি বসতবাড়িতে রূপান্তরিত হচ্ছে। হয়তো সময়ের ব্যবধানে ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় মাঝে-মাঝেই কিছু অর্থনৈতিক উৎপাদনশীল খাত ভেতরে ঢুকে পড়বে। হয়তো সেটা আবার কয়েক বছর গ্রামীণ অর্থনীতিতে অবদানও রাখবে।

একবিংশ শতাব্দী এত দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে যেকোনো কিছুরই স্থিতি নেই। এ ওকে টপকে যাচ্ছে তো, ও তাকে! মনে হচ্ছে সবই যেন ঘটছে চোখের পলকে। এই পরিস্থিতিতে কৃষির পাশাপাশি নারীর কাজেরও ডাইভারসিটি বাড়বে। গ্রামীণ নারীর অর্থনৈতিক অবদানের খাতগুলো যা মূলত চোখে দেখা যায় সেটারই কেবল পরিসংখ্যানগত মূল্যায়ন হয়, অথচ যা চোখে দেখা যায় না সেটা আরও অনেকখানি ব্যাপক! আমরা অনেকেই জানি আবার হয়তো অনেকেই জানি না ‘গ্রামীণ নারী’ দিবস নামক একটা ব্যাপার আছে। সেখানে নারীর জন্য কয়েকটা প্রপঞ্চ যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, সম্পদের মালিকানা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারের কথা উল্লেখ আছে। কথাগুলো শুনতে মনে হচ্ছে যেন অনেক দূর থেকে শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু আশা রাখি নিশ্চয় একদিন সবগুলো প্রপঞ্চই নারীদের অধিকারে আসবে।

লেখক : প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য