বাংলাদেশে সেবা খাতগুলোর মধ্যে সব চেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় পাসপোর্টে। পুলিশ ভেরিফিকেশন থেকে ফিঙ্গার প্রিন্ট পর্যন্ত ঘাটে ঘাটে টাকা দিতে হয়। পদে পদে হতে হয় হয়রানি। সরকারি ফির দ্বিগুণের বেশি অর্থ অনেক সময় লাগে পাসপোর্ট করতে। এ জন্য দায়ী এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী আর দালালচক্র। তবে এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা বলা যাবে না। পাসপোর্ট অফিসের এই দুর্নীতি যেন অপেন-সিক্রেট। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হলেও কোনো সরকারই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি বলেই প্রতীয়মান হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনেও বিষয়টি ওঠে এসেছে। এই দুর্নীতি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। পাসপোর্ট নবায়ন না হওয়ায় মালয়েশিয়ায় ২৬ হাজার বাংলাদেশি বিপাকে পড়েছেন। সেখানেও দালালচক্র আর বাংলাদেশি কর্মকর্তার ভূমিকা রয়েছে। এমন ভুক্তভোগীদের একজন অভিবাসী শ্রমিক খোরশেদ আলম। তিনি গত জুন মাসে তার মেশিন-রিডেবল পাসপোর্ট (এমআরপি) নবায়ন করতে চান। খুব দ্রুত তার এটা করার দরকার ছিল। কারণ ডিসেম্বরেই তার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। পাসপোর্ট নবায়নের জন্য একজন দালালকে তিনি প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেন এবং পাসপোর্টটি ই-পাসপোর্টে আপগ্রেড করার অনুরোধ করেন। কিন্তু দালাল তাকে জানায় বাংলাদেশিদের ই-পাসপোর্ট হয় না। পাসপোর্ট নবায়ন ফি ১৪৫ রিঙ্গিত হলেও দালাল তার কাছ থেকে ২৫০ রিঙ্গিত নেন। এমআরপি পেতে ২১ কর্মদিবস লাগলেও খোরশেদ এখনো তার নবায়নকৃত পাসপোর্ট পাননি। এ নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত। কারণ পাসপোর্ট ছাড়া তিনি ভিসা নবায়ন করতে পারবেন না। আর ভিসা নবায়ন না হলে তাকে দেশে ফিরতে হবে। শুধু খোরশেদ নন, তার মতো ২৬ হাজার বাংলাদেশি পাসপোর্ট নবায়নে বিলম্বের কারণে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। অথচ ভোগান্তি কমাতে ও প্রক্রিয়া সহজ করতে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল মালয়েশিয়ায় ই-পাসপোর্টসেবা চালু করে বাংলাদেশ। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত হাইকমিশন ই-পাসপোর্ট আবেদন প্রক্রিয়া করেছে মাত্র ২০ হাজার ৮২৯টি, একই সময়ে ৫৬ হাজার ৮০টি এমআরপি আবেদন জমা পড়েছে। ডিজিটাল প্রসেসের কারণে ই-পাসপোর্ট বিতরণ নির্বিঘ্ন হলেও এমআরপি বুকলেটের ঘাটতির কারণে প্রায় ২৬ হাজার ৯৬টি এমআরপি আবেদন আটকে আছে। ফলে খোরশেদের মতো আবেদনকারীরা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পড়েছেন বলে হাইকমিশন সূত্র বলছে।
এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ই-পাসপোর্ট পদ্ধতিটা বিশ্বের এক নম্বরে রয়েছে। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ এটা চালু করেছে। তারপরও কেন এমআরপি পাসপোর্ট ইস্যু করা হচ্ছে? সেখানে শুধু ই-পাসপোর্ট বাধ্যতামূলক কেন করা হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তো করাই যায়। দ্বিতীয়ত, যদি এমআরপি পাসপোর্ট করা হয়, ভালো। কিন্তু বুকলেটের ঘাটতি কেন থাকবে? বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় বুকলেট যেতে কতদিন লাগে? সাতদিনের বেশি তো লাগার কথা নয়। তার মানে এখানে কর্মকর্তাদের গাফিলতি রয়েছে। অবশ্যই তাদের এ ব্যাপারে জবাবদিহি করাতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরি। কারণ তাদের শাস্তি না হলে অন্যরাও একই অপকর্ম করবে; যা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকর। শুধু ক্ষতিকর তা নয়, অর্থনীতির মেরুদণ্ড রেমিট্যান্সও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং দুর্নীতিবাজদের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এছাড়া সেদেশে অবস্থানরত ২৬ হাজার বাংলাদেশিকে এক সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট দিতে হবে। লোকবলের অভাব থাকলে বাংলাদেশ থেকে নিতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে ওই দেশ থেকেই লোক হায়ার করতে হবে। কিন্তু কোনোভাবেই এই লোকগুলোকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলা যাবে না। আশাকরি সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবে। খেয়াল রাখতে হবেÑ অসন্তোষ যেন না হয়।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য