ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র। ভৌগোলিক কারণেই দেশ দুটির মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব প্রয়োজন। বন্ধুত্ব আছে বটে, তবে সেটা ন্যায্যতার ভিত্তিতে নয়। এই বন্ধুত্ব কিন্তু প্রভুত্ব দিয়ে হয় না। বন্ধুত্ব হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর ন্যায্যতার ভিত্তিতে। কিন্তু একটা কথা হলফ করে বলা যায়, আমাদের এই বন্ধুত্ব কখনো ন্যায্যতার ভিত্তিতে হয়নি। ফলে, বাংলাদেশকে ভারত শ্রদ্ধা করে বলে মনে হয় না। আর এ বিষয়টি বুঝতে কারো রকেট সায়েন্স জানার প্রয়োজন হয় না। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা কিন্তু সেটাই প্রমাণ করে। তারা এখনো শেখ হাসিনাতেই আটকে আছে। তারা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তন মেনে নিতে পারছে না। এছাড়া তুচ্ছ কিছু ঘটনা নিয়ে তারা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি করছে। তারা ভুলে গেছে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ। সেখানে নাক গলানোর অধিকার কারো নেই। দিল্লি তার দেশের উগ্র জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে বলেই মনে হয়। ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা এবং জাতীয় পতাকা অবমাননা কিন্তু তারই প্রমাণ।
প্রথমেই আসি বন্যা প্রসঙ্গে। কয়েক মাস আগে অসময়ের বন্যাকবলিত হয় বাংলাদেশের ফেনী, কক্সবাজার, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ কয়েকটি জেলা। এই বন্যার জন্য ভারতের পানি আগ্রাসনকে দায়ী করেছিলেন এদেশের মানুষ। যদিও ওই বন্যার জন্য প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢল দায়ী ছিল। ভারতের আসামও বন্যাকবলিত হয় এবং বেশ কিছু মানুষের প্রাণ যায় বন্যার কারণে। ভারতকে পানি আগ্রাসনে অভিযুক্ত করে বাংলাদেশর অনেক মানুষ ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি দেয়। কিন্তু আমাদের পুলিশ বাহিনী তাদের দূতাবাসের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। সর্বশেষ বিএনপির তিনটি অঙ্গ সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল ভারতের সাম্প্রতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পদযাত্রাও করে। কয়েক কিলোমিটার দূরে রামপুরা এলাকায় পুলিশ তাদের আটকে দেয়। কারণ সেখান থেকে হয়তো কেউ ভারতীয় দূতাবাসে হামলা করতে পারতোÑ এমন আশঙ্কা থেকেই পুলিশ তাদের ভারতীয় দূতাবাসের কাছে যেতে দেয়নি। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে পুলিশ চেয়েছে ভারতীয় দূতাবাস আক্রমণের শিকার না হোক। অথচ নির্লজ্জের ভূমিকা পালন করেছে ভারতীয় পুলিশ। কলকতায় উগ্রবাদী কয়েকশ মানুষ যখন বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করলো; পুলিশ তাদের বাধা দিল না। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখলো। আর উগ্রবাদীরা ভাঙচুর করলো, বাংলাদেশের পতাকায় আগুন দিলো। এই হলো আমাদের বন্ধুত্বের নমুনা। একই ধরনের ঘটনা ঘটলো ত্রিপুরায়। সেখানে উগ্রবাদীরা বিনা বাধায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা করলো। ভাঙচুর করলো। আমাদের জাতীয় পতাকা অবমাননা করলো আর পুলিশ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলো। এবার আসি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জন্য ভারতের মায়াকান্নার কথায়। তারা দেশের কোনো ঘটনা যাচাই-বাছাই না করে সেগুলোকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এমন একটি ঘটনা বাগেরহাটের। সেখানে এক মুসলিম ব্যক্তির সন্তান নিখোঁজ রয়েছে। তাকে উদ্ধারের জন্য মানববন্ধন করেছেন স্থানীয়রা। অথচ সেটাকে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ মানববন্ধন বলে গুজর ছড়িয়ে দিয়েছে ভারতের কতিপয় সংবাদ মাধ্যম। আর এ কাজ করছে দেশটির রিপাবলিক বাংলাসহ অন্তত ৪৯টি প্রতিষ্ঠান। ফ্যাক্ট চেকিংয়ে বিষয়গুলো ধরা পড়েছে। আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘের (ইসকন) সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার নিয়ে ভারতের উগ্রবাদীরা খুবই লম্ফঝম্ফ করছে। অথচ এই লোকটির বিরুদ্ধে শিশু নিগ্রহের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে সংগঠনটি তাকে বহিষ্কার করেছে অনেক আগেই। তাকে তো নির্যাতন করা হয়নি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রয়েছে। সেটা আইনী উপায়ে মোকাবিলা করাই তো উচিত ছিল। কিন্তু তার ভক্তরা সেটা না করে আদালতে একজন আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করলো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর তারা হামলা করলো। তারা যা করলো সেটা নজিরবিহীন। আদালত প্রাঙ্গণের এমন ঘটনা কোনো দেশই বরদাশত করবে না। এ ধরনের ঘটনা আপনাদের আদালতে হলে কী করতেন, সেটা জানতে চাই ভারতের কাছে। আপনাদের দেশে গো মাংস ভক্ষণ ও বহনের অভিযোগে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করছেন। সেটা কি নির্যাতন না? এ সবের বিরুদ্ধে আপনারা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা জানতে খুব ইচ্ছা করে। আপনাদের উচিত অন্যদেশের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে প্রতিক্রিয়া দেখানো। ভুলে গেলে চলবে নাÑ বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও স্বাধীন দেশ। আপনাদের অঙ্গ রাজ্য নয় এটি। সুতরাং সাবধানে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকারের পাশাপাশি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে বাংলাদেশকে মূল্যায়ন করতে হবে। আপনাদের ভূমিকায় যেন কূটনৈতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ভারত সরকারকে অবশ্যই দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
আবার বাংলাদেশ সরকারের উচিত কোনো একটি দলের ফাঁদে পা না দেওয়া। ভারতবিরোধী মনোভাব যেন তৈরি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ন্যায্যতা ও সমমর্যাদার ভিত্তিতে একটি বহুমাত্রিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা সময়ের অপরিহার্য দাবি। ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির গভীর আন্তসম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এ সম্পর্ককে আরও টেকসই ও গতিশীল করার মাধ্যমে উভয় দেশের জনগণের আর্থসামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি কেবল প্রয়োজনীয় নয়; বরং দুই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে উভয় দেশের সরকারের অবস্থান। সাম্প্রতিক তিক্ততার অবসান ঘটাতে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এতে উভয় দেশ সুসম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের আমন্ত্রণে আমি ঢাকায় এসেছি। অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মুহূর্তে আমি ঢাকায় এসেছি, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এ বছর আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে আমাদের উভয় দেশের নেতাদের মধ্যে প্রথম কথা হয়েছে। তাদের মধ্যে টেলিফোন আলাপ হয়েছে। নিউইয়র্কে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। আমার এ সফর তারই অংশ। নতুন সরকারের সঙ্গে এটা প্রথম ফরেন সচিব মিটিং। আজকের এই আলোচনা আমাদের উভয়পক্ষকে এই সুযোগটা করে দিয়েছে। আমাদের মধ্যে খোলামেলা এবং গঠনমূলক মতবিনিময় হয়েছে। আমাদের আকাক্সক্ষা হলোÑ ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক ও লাভজনক সম্পর্ক, যেটা বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আমরা অতীতে দেখেছি ও আমরা ভবিষ্যতেও এটা দেখতে চাই। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উভয় দেশের মানুষকেন্দ্রিক হবে জানিয়ে মিশ্রি বলেন, এই সম্পর্ক হবে মানুষ-কেন্দ্রিক। এটা উভয় দেশের জনগণের উপকারে আসবে এবং এর প্রতিফলন আমাদের প্রাত্যহিক ঘটনার মধ্যে পাচ্ছি। যার মধ্যে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ, পানি, এনার্জি, উন্নয়ন সহযোগিতা, কনস্যুলার সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রয়েছে। এই বিষয়গুলোর ওপর আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।
বিক্রম মিশ্রি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দুই দেশের মধ্যে কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং কূটনৈতিক বিষয়ে আক্রমণের বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা সার্বিকভাবে উভয়পক্ষের মধ্যে গঠনমূলক মনোভাব চাই। অপেক্ষায় আছি, আমাদের সম্পর্ক একটা ইতিবাচক এবং গঠনমুলক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যাবে। (ভোরের আকাশ, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৪)।
বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক (এফওসি) শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব এম জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই প্রেক্ষিতে এফওসিতে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সামনের দিনে আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। এফওসিতে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খোলামনে আলোচনা হয়। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের নিকট আমরা আমাদের দুদেশের মধ্যে বিদ্যমান সকল অনিষ্পন্ন বিষয়সমূহের দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি এবং এই লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করি। আমি দুই দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দেই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করি।’ পররাষ্ট্র সচিবের কথায় আমরাও ভরসা রাখতে চাই। নিজেদের স্বার্থেই উভয় দেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করবে বলে আশাকরি। পরিশেষে ভারতকে বলতে চাই ‘ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়’ কথাটি ভুলে যাবেন না।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য