অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনীতি এবং নতুন রাজনৈতিক দল প্রসঙ্গে

মোনায়েম সরকার
অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনীতি এবং নতুন রাজনৈতিক দল প্রসঙ্গে

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে তাদের অধীনে সংস্কার হোক। তাই তারা বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। তারা সংস্কারের পরিবর্তে নির্বাচনকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

১১ ডিসেম্বর ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ১০ ডিসেম্বর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে ব্রিটিশ রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল পার্টনার্স গভর্নেন্স-জিপিজির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে উপদেষ্টা এ কথাগুলো বলেন। প্রতিনিধিদলের সদস্য চিলির সাবেক সামাজিক উন্নয়নমন্ত্রী জর্জিও জ্যাকসন সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম উল্লিখিত মন্তব্য করেন।

স্কটিশ পার্লামেন্টের সাবেক সদস্য লর্ড জেরিমাই পুরভিস অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সমস্যা, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া ও বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ স্থাপন করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। তিনি আরও বলেন, একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। এটি একটি অভিনব ঘটনা, যা এর আগে কখনো ঘটেনি।

তথ্য উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে নানারকম অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। গণঅভ্যুত্থানকে অনেকেই ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারছে না। এত অল্প সময়ে এত বড় এক স্বৈরশাসকের পতন কীভাবে হলো, তা মানুষ বুঝতে পারছে না। ফলে দেশের ভেতরে ও বাইরে নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়েও অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই আন্দোলনটা যে গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান, তা অনেকেই অস্বীকার করার চেষ্টা করছে।

নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার সংকট চলেছে। মানুষ ভোট দিতে পারত না, কয়েক হাজার মানুষকে গুম করে ফেলা হয়েছে। একটা দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে দেশের মানুষ ছিল। তাই মানবাধিকার রক্ষা করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

নাহিদ ইসলামের এসব বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে। কারণ তার বক্তব্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা ফুটে উঠেছে, যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের মতভিন্নতা বা দ্বন্দ্বের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তার বক্তব্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে গভীর বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তার মন্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা, অন্তর্বর্তী সরকারের চ্যালেঞ্জ এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এসব বিষয় নিয়ে বিশদে আলোচনা করলে দেশের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বোঝার একটি পথ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা নিয়ে নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে একটি নির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। তার মতে, দলগুলো সংস্কারের পরিবর্তে নির্বাচনের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। এটি মূলত রাজনৈতিক দলের চিরাচরিত প্রবণতাকে নির্দেশ করে, যেখানে ক্ষমতায় আসার আকাক্সক্ষা সবসময় সংস্কার প্রক্রিয়ার চেয়ে প্রাধান্য পায়। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এমন ছিল যে, ক্ষমতায় থাকা দলগুলো নিজেদের স্বার্থে প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকারের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতার প্রকাশ খুব স্বাভাবিক কি?

জিপিজির প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নাহিদ ইসলামের আলোচনায় অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের প্রসঙ্গেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজনৈতিক সমঝোতাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো অভ্যুত্থান প্রসঙ্গ। তার মতে, এটি একটি গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান। যদিও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ‘অভ্যুত্থান’ শব্দটি সাধারণত নেতিবাচক অর্থ বহন করে, নাহিদ ইসলাম এটিকে গণতান্ত্রিক রূপ দিতে চেয়েছেন। এটি একটি সাহসী দাবি হলেও, বাস্তবে অভ্যুত্থানের বৈধতা প্রমাণ করা কঠিন। গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান কেবল তখনই বিশ্বাসযোগ্য হয়, যখন সরকার তার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা প্রদর্শন করে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মানবাধিকার ইস্যুতেও তার বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। অতীতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক ছিল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগও বহুবার উঠেছে। নাহিদ ইসলামের দাবি অনুযায়ী, এই ইস্যুতে অপপ্রচার চলছে। তবে, দেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় অপপ্রচারের অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবুও, সরকারের উচিত এই ইস্যুতে স্বচ্ছ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে শুধু অপপ্রচার বন্ধ নয়, বরং মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নও নিশ্চিত হয়।

আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র এবং সরকারের বৈধতা নিয়ে নাহিদ ইসলামের উদ্বেগ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ একটি কৌশলগত অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং ভারতের মতো শক্তিধর দেশগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগাতে পারে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ও সহযোগিতার গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নীতিমালা অনুসরণ করে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ইস্যুগুলোতে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তবে তারা বৈধতা অর্জনে সক্ষম হতে পারে।

নাহিদ ইসলামের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশ এখন এমন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে সঠিক সিদ্ধান্তই ভবিষ্যতের পথচিহ্ন নির্ধারণ করবে। অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা এবং বিরোধী দলগুলোর আস্থা অর্জন করা। অন্যদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করা।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের জনগণ একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ, এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রত্যাশা করে। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে যে উদ্বেগ ও অভিযোগ উঠে এসেছে, তা যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা যায়, তবে দেশ একটি নতুন গণতান্ত্রিক দিগন্তে পা রাখতে পারে। কিন্তু যদি এই সংকটকে সমাধান না করা হয়, তবে এটি আরও গভীর অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। এখন সময় সবারই দায়িত্বশীল এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়ার।

দুই. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল ঘিরে রাজনৈতিক আলোচনা একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক প্রসঙ্গ হয়ে উঠছে। কবে সংস্কার শেষ হবে, কবে নির্বাচন হবে এবং কবে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তী সরকার বিদায় নেবে তা স্পষ্ট বা সুনির্দিষ্ট করে বলা হচ্ছে না। বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যারা তাকে কেন্দ্রে রেখে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে চাইছেন, তাদের উদ্দেশ্য এবং প্রভাব নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা হতে পারে। বিস্তর জল্পনা-কল্পনা শোনা যাচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে। যদিও এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এমন কিছু সরাসরি বা ইঙ্গিতেও বলেননি। তারপরও যদি এরকমটি হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হচ্ছে, এই উদ্যোগ কতটা কার্যকর এবং টেকসই হতে পারে? বিশেষত যখন দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাস্তবতায় কিংস পার্টি তৈরির অতীত অভিজ্ঞতা খুব বেশি আশাব্যঞ্জক নয়।

২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলেও ‘সংস্কারপন্থি’ রাজনীতিবিদদের নিয়ে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গঠনের চেষ্টা হয়েছিল। ড. ইউনূসও তখন একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করতে গিয়ে থেমে যান। তখন ‘সংস্কারপন্থি’ রাজনীতিবিদদের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার কারণ ছিল সাধারণ জনগণের মধ্যে পর্যাপ্ত সাড়া না পাওয়া এবং ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক ভিত্তি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিক দলগুলোর শিকড় এতটাই গভীর যে নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব এবং টিকে থাকা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

এবারও যদি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ওই পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে। ড. ইউনূসের ক্ষেত্রে, তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান থাকলেও দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটি দলীয় অবস্থান তৈরি করা ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। তার সমর্থক এবং সমন্বয়কারীরা হয়তো বিশ্বাস করছেন, বাংলাদেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং বিদ্যমান দলগুলোর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একটি নতুন বলয় তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা এবং জনগণের বিশ্বাস অর্জন ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ ধরনের উদ্যোগের বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এ ধরনের দলগুলো সাধারণত ব্যক্তি-কেন্দ্রিক হয় এবং জনগণের চাহিদা পূরণে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দিতে ব্যর্থ হয়। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জনগণের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থানের সমন্বয়কারীদের নতুন উদ্যোগও ওই পুরনো ব্যর্থতার পথ ধরে হাঁটবে কিনা, তা ভেবে দেখা জরুরি। একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য শুধু ব্যক্তিত্ব বা আন্তর্জাতিক সমর্থনই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন একটি কার্যকর সাংগঠনিক কাঠামো, জনমুখী কর্মসূচি এবং জনগণের আস্থা। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতিতে একটি পরিষ্কার দিকনির্দেশনা চায়। তারা বিভক্তি বা ষড়যন্ত্রমূলক রাজনীতির চেয়ে উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা এবং গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার পক্ষে। তাই নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে সফল করতে হলে, জনমুখী এবং দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করতে হবে। শুধু ক্ষমতার সমীকরণে কৌশলী হওয়া যথেষ্ট নয়।

নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগকে একটি নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, এটি বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং অস্থিরতাকে চ্যালেঞ্জ করলেও, জনসমর্থন ছাড়া কখনোই টেকসই হবে না। ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য জনগণের আস্থা এবং অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই এরকম কোনো উদ্যোগের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে কতটা গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ এবং জনমুখী রাজনীতির ভিত্তি তৈরি করা হয় তার ওপর।

লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য