শিরোনাম

মুক্তিযুদ্ধকে ‘এড়ানো, মাড়ানো, তাড়ানো’ যায় না, যাবে না

জোবাইদা নাসরীন
মুক্তিযুদ্ধকে ‘এড়ানো, মাড়ানো, তাড়ানো’ যায় না, যাবে না

নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের সেরা অর্জন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন দেশ পাওয়া। আমি একেবারেই নিশ্চিত হয়ে বলছি এখন পর্যন্ত দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় আবেগের আর কিছুই নেই। এর হয়তো ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক কারণ রয়েছে। ১৯৭১ সালের আগে মানুষের মুক্তির লক্ষ্যের সংগ্রাম ছিল দীর্ঘদিনের। প্রথমে ব্রিটিশ, তারপর পাকিস্তানের শোষণ ভেঙে একটি স্বাধীন দেশের পতাকা, মানচিত্র, ভূখণ্ড পাওয়া একদিন কিংবা এক মাসের লড়াই-সংগ্রামের ফসল নিশ্চিতভাবেই নয়। তাই একাত্তরের এ দেশের মানুষের অনেক কিছুকেই ধারণ করে।

এটিও আমাদের বলতে হবে যে ৫৩ বছর বয়সী বাংলাদেশ স্বাধীনতার পরও ধুঁকেছে বারবার। এটা একেবারেই সত্যি যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে মুক্তির স্বপ্ন ছিল সে কাক্সিক্ষত মুক্তি দেশের মানুষের কাছে আসেনি। তাই অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশর মানুষকে লড়তে হয়েছে বারবার। এ দেশে ১৯৭১ সালের পরেও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, এর প্রায় ৩৪ বছর পর কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে হয়েছে জুলাই গণঅভ্যুত্থান। এর মূল আওয়াজ ছিল সমতা, ন্যায্যতা, প্রাপ্যতা এবং বাক-স্বাধীনতাসহ অন্যান্য স্বাধীনতা নিশ্চিত করা বাংলাদেশ।

এত বছর পরও কেন সত্যিকারের মুক্তির জন্য দেশের মানুষকে লড়াই করতে হচ্ছে? কিন্তু এই প্রশ্ন তুলে কি মুক্তিযুদ্ধকে খারিজ করা যাবে? মানুষের মুক্তির সংগ্রাম একটি চলমান প্রক্রিয়া। পৃথিবীতে কম-বেশি সব দেশেই তাদের মতো করেই জনগণ বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং অধিকারের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটিকে তারা ইতিহাস থেকে বিচ্যুত হয়ে করছে? তাহলে এখন কেন সেই প্রশ্নটি আসছে? আমরা কেন মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে দাঁড় করাচ্ছি? আর কেনই বা এসব আলাপ এখানে জরুরি? কারণ আমরা দেখেছি কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই ভাঙা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ভাস্কর্য। এমনকি মুছে দেওয়া হচ্ছে অনেক মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতি। প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে এসেছে রিসেট বাটনের কথা। এর আগে জাতীয় সংগীত পাল্টানোর জন্য কোনো কোনো পক্ষ থেকে দাবি ওঠে। জয় বাংলা সেøাগানকে জাতীয় সেøাগান থেকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়। এখন খুব জরুরি একটি জিজ্ঞাসাÑ কেন এই অল্প সময়েই অন্তর্বর্তী সরকারকে মুক্তিযুদ্ধকে টার্গেট করেই এত কিছু হলো, তা কিছুটা বোধগম্য হলেও সুর মেলে না। কেননা এই সরকার আরেকটি মুক্তির আকাক্সক্ষায় তৈরি হওয়া গণ-অভ্যুত্থান থেকেই জন্ম নেওয়া। তাহলে এই সরকারের টার্গেট কেন মুক্তিযুদ্ধ?

খুব স্বাভাবিকভাবেই আসে প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধ কি আওয়ামী লীগের? কিংবা আওয়ামী লীগ আর মুক্তিযুদ্ধ কি এক? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় যে গানগুলো সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল, যেগুলো দেশের মানুষের কাছে মুক্তির গান হিসেবে পরিচিত সেগুলো এবার ঠিক একইভাবে বাজছে না কেন? দেশাত্মবোধক গানগুলোও কি আওয়ামী লীগের? কেন শিল্পকলার ডিসেম্বর মাসের অনুষ্ঠানে ‘বিজয়ের উৎসব’ না লিখে ‘ডিসেম্বরের উৎসব’ লিখতে হলো? ‘বিজয়’ বা ‘জয়’ নিয়ে এত ভয় কীসের? এটি একেবারেই ঠিক আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে নিজের করে রাখতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং চর্চায় দলের বাইরে খুব কম মানুষকে জায়গা দিতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজের দলের মতো করে আকার দিতে চেয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ফেনা তুলেছে। কিন্তু জনগণ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আর সেখানেই ঘটেছে মুক্তির বিরুদ্ধতা। তাই মানুষও তেতে গিয়েছিল। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকারের পথে হাঁটেনি।

এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আপনারা যদি মুক্তিযুদ্ধকে খারিজ করার চেষ্টা করেন, অসম্মান করেন এবং গণ-অভ্যুত্থানকে মুক্তিযুদ্ধের সমান সমান দেখানোর চেষ্টা করেন তাহলে সেটি কিন্তু আপনাদেরই ভোগাবে। আর আওয়ামী লীগকে বাতিল করার জন্য যদি মুক্তিযুদ্ধকেই টার্গেট করেন তাহলে আদতে মুক্তিযুদ্ধকেন্ত্রিক আওয়ামী লীগের দাবিকেই আপনারা প্রতিষ্ঠিত করছেন না তো! তা না হলে হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ সেøাগান নিয়ে এখনই এত মাতামাতি করতে হবে কেন? জয় বাংলাকে আইনি বাধ্যবাধকতায় না রেখে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হওয়া মানে কী ‘জয় বাংলা’ বলা যাবে না? নাকি এটি আইনি বাধ্যবাধকতার পরিবর্তে ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া?

কোনটি আসলে ঠিক? এই ব্যাখ্যাগুলো আসলে সরকার থেকে আসা করছি। কেননা এর আগে আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, সরকারি টিকাদান কর্মসূচিতে বক্তব্যের শেষে জয় বাংলা বলায় বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদকে ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

আমাদের মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধ যেমন এ দেশের মানুষের, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের গান বা সেøাগানের মালিকানাও দেশের মানুষের। আওয়ামী লীগ এগুলোকে পকেটে রেখেছিল, জনগণের হতে দেয়নি, যার জন্য তাদের এই পরিণতি। তেমনই এই অন্তর্বর্তী সরকারও যদি এগুলোকে জনগণের মালিকানা হতে না দেয় অর্থাৎ এগুলোর ওপর একভাবে ‘সেন্সরশিপ’ তৈরি করে, তাহলেও আপনারাও একই দোষে দুষ্ট হবেন।

দেশের মানুষের সবচেয়ে বড় আবেগ নিয়ে আওয়ামী লীগ যেমন রাজনীতি করেছে, একই ধরনের রাজনীতি আপনারাও করছেন, আর সেটি হলো মুক্তিযুদ্ধকে যথাসম্ভব এড়ানো-মাড়ানো-তাড়ানোর কৌশলে, মুক্তিযুদ্ধকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে।

একটি স্বাধীন দেশেও অনেক গণ-অভ্যুত্থান হতে পারে, হয়তো ভবিষ্যতে আরও হবে। কিন্তু সেটি তার অস্তিত্বের যুদ্ধকে কখনোই অতিক্রম করতে পারে না। আপনাদের মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভিত্তি, বড় শক্তি। সব আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালু রাখার মন্ত্রের শক্তিও আমাদের কাছে একাত্তর।

লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য