জুলাই অভ্যুত্থানে দেশত্যাগী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একমাত্র মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক। পুতুল এই পদে থাকায় বাংলাদেশ সরকারকে একটা অসমর্থনীয় সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অনেক ব্যাপারেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিসের ওপর নির্ভর করে থাকে, যেমন - মহামারি প্রতিরোধ, টিকা দেওয়া, বিশুদ্ধ পানি সরবারহ এবং নানারকম স্বাস্থ্যসংক্রান্ত পরামর্শ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক অফিস ও এর পরিচালক সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের পরিবর্তে সংস্থাটির প্রধান অফিসের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকার। এই ইচ্ছে প্রকাশে যৌক্তিকতা থাকলেও বাংলাদেশের পক্ষে আঞ্চলিক অফিসকে এড়ানো খুব সহজ হবে না, কারণ এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রীতি-বিরুদ্ধ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের ৭৭তম আঞ্চলিক সভা হওয়ার কথা ছিল ঢাকায়, অক্টোবরের ৭ তারিখ থেকে তিন দিন। সেই সভার স্থান পরিবর্তন করে নেওয়া হয় নয়াদিল্লিতে। এই প্রতিবন্ধকগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পুতুলের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করা নিয়ে নতুন করে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কি চাইবে পুতুলকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদ থেকে সরাতে?
যারা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের নির্বাচন প্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছিলেন তারা এই নির্বাচন পদ্ধতি ও পুতুলের প্রোফাইল নিয়ে দারুণভাবে হতাশ ছিলেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সমস্ত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় ঘচিয়ে হাত বাড়িয়েছিলেন একটা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে - সেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক অফিস এই এলাকার ১১টি দেশের দুই শত কোটিরও বেশি মানুষকে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিভিন্নরকম সেবা দিয়ে থাকে।
হাসিনার সুযোগ ছিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক পদে বাংলাদেশের একজন সত্যিকার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে নির্বাচিত করে আনার। একজন উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচিত হলে, তার অভিজ্ঞতা ও কর্ম দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় তার নিজস্ব ফুটপ্রিন্ট রেখে বাংলাদেশের জন্য সুনাম কুড়িয়ে আনতে পারতেন। কিন্তু হাসিনা নিজের মেয়ে সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে এই পদে বসিয়ে শুধু বাংলাদেশের ভাবমূতি নষ্ট করেননি, এই সংস্থাটিরও যথেষ্ট ক্ষতি করেছেন।
পুতুল যখন আঞ্চলিক পরিচালক পদে প্রার্থী হলেন, তখন তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন নেপালের শম্বু আচারিয়া। ড. আচারিয়ার রয়েছে জনস্বাস্থ্যের নিয়ে কাজ করার ৪০ বছরের অভিজ্ঞতা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রোগ্রাম ম্যানেজার (১৯৯১) থেকে শুরু করে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জেনিভা অফিসের পরিচালক, কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সাপোর্ট, হিসেবে তিনি ১৫২ দেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
পুতুলের আগে যিনি তার পদে ছিলেন তিনি ভারতের পুনম ক্ষেত্রপাল। ড. ক্ষেত্রপাল ছিলেন ভারতের একজন আই.সি.এস. অফিসার। ছিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যসচিব। পরে বিশ্ব ব্যাংকের স্বাস্থ্য ও পপুলেশন বিশেষজ্ঞ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হেড অফিসে নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।
এদের সঙ্গে পুতুলের যোগ্যতা বিচার করলে মনে হবে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। পুরো নির্বাচনটাই ছিল একটা প্রহসন, যার স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই, ভারতও হাসিনার অনুরোধে প্রতিবেশী দেশগুলোকে প্রভাবিত করেছিল পুতুলকে ভোট দিতে। পুতুল যখন নির্বাচনে প্রার্থী হন, তখন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মধ্য থেকে প্রথম যে প্রশ্নটি শোনা গিয়েছিল, পুতুল হু, কে এই পুতুল? পুতুল যখন নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের ২০২৩ সালের অধিবেশনে মায়ের পেছন-পেছন ঘোরাফেরা করছিলেন, তখুনি এটা পরিষ্কার হয়, ভারতের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ককে কাজে লাগিযে শেখ হাসিনা পুতুলকে নির্বাচিত করে আনবেন।
শুরু হলো পুতুলের জীবনবৃত্তান্ত মাজা-ঘষা ও পরিবর্ধনের কাজ। পুতুলের উচ্চশিক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামিতে অবস্থিত বেড়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে। মায়ামির বেড়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা মাস্টার ডিগ্রি নেওয়ার পর তার একমাত্র কৃতিত্ব সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে অটিজমের ওপর একটা কনফারেন্স করা, যেখানে বেড়ীর একটা বিরাট গ্রুপ বাংলাদেশ সরকারের খরচে অংশগ্রহণ করেন। বেড়ী তাদের সম্মানিত প্রাক্তন শিক্ষার্থীর ভবিষৎকে আরো সম্মানিত করতে সাহায্যের ত্রুটি করেনি। ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের রেংকিংয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩৯টি বিশ্বাবিদ্যালয়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বেড়ীর অবস্থান ৩৯৫ থেকে ৪৩৫। মাত্র দুই শতাংশ বেড়ীর শিক্ষক ফুল টাইম। বেড়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুতুলের ডক্টরেট অফ অ্যাডুকেশন ডিগ্রি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ এবং ধোঁয়াশা রয়েছে। এছাড়াও বেড়ীর ওয়েব সাইটে পুতুলকে দেখেনো হয়েছে দীর্ঘকালীন এডজাঙ্ক প্রফেসর।
দেখা যাক পুতুলের লিঙ্কডিন প্রোফাইল কি লেখা আছে - বেড়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৩ সালে পান ডক্টরেট অব এডুকেশন, ক্লিনিক্যাল মনোবিদ্যায় মাস্টার্স ২০০২ সালে। মার্চ ২০০৩ সালে তিনি অনারারি ডক্টরেট পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি থেকে ভিসিটিং স্পেশালিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি, ভিসিটিং স্পেশালিস্ট, ভিসিটিং ফ্যাকাল্টি ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব মেন্টাল হেলথ, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাডুকেশন।
এইগুলো যে বাংলাদেশের ফরমায়েশি কাগুজে অভিজ্ঞতা এবং সন্মান তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এইসব ভিজিটিং এবং এডজাঙ্কট দিয়েই পুতুল নির্বাচনের আগে তার অভিজ্ঞতা সাজিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে নির্বাচনের একমাস আগে যোগ করেছেন বেড়ী থেকে অ্যাডুকেশনে ডক্টরেট। এখনো এটা তার লিঙ্কডিন প্রোফাইলে লেখা রয়েছে, যদিও তার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রোফাইলের কোনো উল্লেখ নেই। ধারণা করা হচ্ছে যে আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালগুলো যখন তার যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে একের পর এক প্রশ্ন তুলছিল, সেটাকে কিছুটা ধামাচাপা দিতে তার এই ডক্টরেটে ডিগ্রির সংযোজন।
দি ল্যান্সেট - মর্যাদাসম্পন্ন একটা আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নাল। নির্বাচনের পূর্বে পুতুলের প্রার্থিতা এবং তাকে নির্বাচিত করার জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিল তা নিয়ে এই পত্রিকায় একটা সমালোচনামূলক লেখা প্রকাশ করা হয়। তাতে পুতুলের স্বল্প অভিজ্ঞতার কথাও উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ‘একজন প্রার্থী, প্রার্থী-প্রদানকারী দেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে। যে নির্বাচন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে এবং পরে আঞ্চলিক পরিচালকের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’
ভারতীয় সাংবাদিক দিশা শেঠি নির্বাচনের দুই মাস আগে লিখেছিলেন, ‘দুইজন প্রার্থীর মধ্যে চক ও চিজের মতো পার্থক্য। এই নির্বাচন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক নির্বাচনে স্বজনপ্রীতির স্বাক্ষর রাখবে।’
নির্বাচনে পুতুলের প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমর্থন ও লবিয়িংয়ের ফলে নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই পুতুল যে নির্বাচিত হবেন, তা অবধারিত হয়ে যায়। ২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের ভোটাভুটি ছিল শুধু অনুষ্ঠানিকতা। পুতুল ১১টি দেশের মধ্যে ৮টি দেশের ভোটে নির্বাচিত হন এবং ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ পাঁচ বছর মেয়াদি।
পুতুল যদি যোগ্য হতেন অবশ্যই বাংলাদেশের কেউ এই নির্বাচনের পদ্ধিতিগত ভুলত্রুটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাত না। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ৬০০ মিলিয়ন ডলার বাৎসরিক বাজেট সামলানো এবং ১১টি দেশের ২০০ কোটি মানুষের স্বাস্থ্য পরিসেবা দেওয়ার কোনো যোগ্যতাই সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের নেই। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর, বাংলাদেশের প্রতিটি সংস্থায় চলছে পরিবর্তন, উচ্চ আসনে শেখ হাসিনার স্বজনপ্রীতি ও দলীয়করণে নিয়োগ দেওয়া সবাইকে বিদায় নিতে হচ্ছে একে একে। পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত। এখন পুতুলের কি হবে?
নতুন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কি নতুনভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালকের পদে নির্বাচন চাইবে? একজন যোগ্য লোক, সে যেকোনো দেশেরই হোক না কেন, এই পদে থাকা একান্তই জরুরি। বাংলাদেশ সরকার কি সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলকে প্রত্যাহার করতে পারবে? এগুলো নিয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো আলাপ-আলোচনা সম্ভবত এখনো হয়নি। তবে বাংলাদেশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অফিস থেকে তার প্রাপ্য সেবা ও সহযোগিতা না পায়, তাহলে বাংলাদেশকে আরো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সায়েমা ওয়াজেদ পুতুলের নির্বাচন পদ্ধতি এবং নির্বাচনে তার মিথ্যা জীবন-বৃত্তান্ত দেখিয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে বিভ্রান্ত করার অপরাধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইচ্ছে করলে তাকে পদচ্যুত করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় এই ধরণের পদচ্যুতি নতুন কিছু নয়। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে কর্মচারীদের সঙ্গে অসদাচরণ করা পদচ্যুত করা হয় ইস্টার্ন প্যাসিফিক এলাকার আঞ্চলিক পরিচালককে। পুতুলের অপরাধ এরচেয়েও লঘু তো নয়ই, বরং গুরুতর।
লেখক : রাজনীতি বিশ্লেষক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য