সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে অতিদরিদ্রের হার পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ। এই তথ্য কতটুকু সঠিক বা অতিরঞ্জিত ওই আলোচনায় যাব না। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালে দেশে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার হবে সাত শতাংশ। সম্প্রতি প্রকাশিত মাল্টিডাইমেনশনাল পোভার্টি ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২৪-এ দেখা গেছে, বাংলাদেশের চার কোটি ১৭ লাখের মতো মানুষ, অর্থাৎ দেশের প্রায় এক-চতুর্থাংশের কাছাকাছি জনগোষ্ঠী চরম দারিদ্র্যপীড়িত। বৈশ্বিক বহুমাত্রিক দারিদ্র্যসূচক ব্যবহার করে এই সংখ্যাটি নির্ণয় করা হয়েছে। এটি দারিদ্র্যের একটি পরিমাপক যা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং জীবনযাত্রার অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী যে একাধিক বঞ্চনার সম্মুখীন হয় তার প্রতিফলন ঘটায়।
এটি আমাদের জন্য খুবই শঙ্কার, বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন হয়েছে সেগুলোকে টেকসইভাবে ধরে রাখা যাচ্ছে না। এর পেছনে মূল প্রভাবকগুলো হলো কোভিড-১৯ মহামারির অর্থনৈতিক ক্ষতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দুর্যোগের সংখ্যা এবং মাত্রা বেড়ে যাওয়া, মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধের বৈশ্বিক প্রভাব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ইত্যাদি। দারিদ্র্যের হার কম এরকম অনেক জেলায় নতুন করে দারিদ্র্যের পকেট তৈরি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যের হার কমে আসা অনেক জেলাতেই ফের বাড়ছে দারিদ্র্যের হার।
বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সর্বস্ব হারানোসহ অন্যান্য সংকটের শিকার হয়ে শহরে অভিবাসিত মানুষের সংখ্যা। দ্রুত অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে প্রকট হচ্ছে নগর দারিদ্র্য। এর সঙ্গে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি। ফলস্বরূপ দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে আমরা যে গতি অর্জন করেছিলাম তা শ্লথ হয়ে এসেছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে গতানুগতিক দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমগুলোর কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারাই, যারা দুর্গম এবং পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে বসবাস করেন এবং আগে থেকেই সমাজে পিছিয়ে পড়া অবস্থানে রয়েছেন। দারিদ্র্যসীমার একটু উপরে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীও দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
আমাদের সমাজব্যবস্থায় প্রোথিত থাকা অসমতা এবং বৈষম্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত ৭টি জেলার মধ্যে ৬টিই দেশের সবচেয়ে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জেলা। এসব জেলায় দুর্যোগের কারণে অনেক জনগোষ্ঠী আয়ের দিকে থেকে দীর্ঘমেয়াদে যেমন - ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপদ পানির মতো মৌলিক অধিকারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার। নগরবাসী যখন শাওয়ার ছেড়ে দীর্ঘসময় ধরে গোসল করেন, একই সময়ে লবণাক্ততায় আক্রান্ত প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলের নারীরা কয়েক ঘণ্টা হেঁটে মিঠা পানির পুকুর থেকে সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন। এই দুটো ঘটনা শুধু পানি প্রাপ্তির বৈষম্যকে নির্দেশ করে তা নয়। পানি আনা-নেওয়া করতে গিয়ে উপকূলীয় শ্রমজীবী নারী আয়মূলক কাজ করতে পারেন না। কম পানি ব্যবহারের ফলে তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা নানাবিধ রোগব্যাধিতে ভোগেন। শিশুদের পড়ালেখা ও সুস্থসবলভাবে বেড়ে ওঠা, কর্মউপযোগী সদস্যদের কাজ করতে পারার সক্ষমতা ইত্যাদি বাধাগ্রস্থ হয়। সুপেয় পানির অভাব এই পরিবারগুলোর জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এটি তাদের দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকে রাখায় ভূমিকা রাখে।
উন্নয়ন পেশাজীবী হিসেবে দারিদ্র্য, অসমতা এবং বৈষম্যের মধ্যকার আরও কিছু মিথস্ক্রিয়া বর্তমানে প্রবলভাবে চোখে পড়ছে। তার মধ্যে একটি হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও ‘প্রান্তিকীকরণ’ করার প্রবণতা। দেশে এখনও অনেক জনগোষ্ঠী মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন। স্থানীয় সরকার তাদের খবর নেয় না, কারণ সমাজে এই জনগোষ্ঠী ক্ষমতাহীন অবস্থানে আছেন। বিপদাপদে তারা স্থানীয় সরকারকে পাশে পান না। বিভিন্ন কমিউনিটিতে কথা বলে আরও দেখতে পেয়েছি, দান করার ক্ষেত্রেও মানুষের উদারতা কমে যাচ্ছে। স্বচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের পরিচিত দরিদ্র মানুষকেই সহায়তা করে থাকেন। এলাকায় খুবই খারাপ অবস্থায় থাকা পরিবার খুঁজে বের করে সহায়তা করার মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা আমাদের সমাজে কমে যাচ্ছে। এই বিষয়গুলো সমাজে অসমতা ও বৈষম্যকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সামাজিকভাবেও দরিদ্র করে রাখছে।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন থেকে মানব উন্নয়নের জন্য অনেক সরকারি নীতি, কর্মকৌশল ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, বেদে, চা শ্রমিক ইত্যাদি প্রান্তিক ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা প্রদানের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। এই সকল নীতিমালায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেন বৈষম্য এবং অসমতার শিকার না হয় সেই লক্ষ্যেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা নেই। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮০ শতাংশের অন্তত এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা আছে। দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষাবিষয়ক একটি বিধিমালাও আছে। তারপরও গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ৮৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রতিবন্ধিতাজনিত বৈষম্যের সম্মুখীন হন। কর্মক্ষম বয়সীদের মধ্যে মাত্র ২৭ দশমিক ২১ শতাংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোনো কোনো ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের অগ্রগতির গাড়িটিকে সচল এবং দ্রুততর করতে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারিসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সমন্বিত হয়ে এই লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
এ বিষয়ক কিছু সুপারিশ প্রদান করা হলো -
১. আয়, সম্পদ এবং সুযোগ : প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেভাবে অসমতা বাড়ছে তার প্রেক্ষাপটে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে। দারিদ্র্য এবং অসমতাকে একসঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য গতানুগতিক কর্মসূচির বদলে নতুন এবং উদ্ভাবনী দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
২. সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করতে হবে। সদস্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ অন্যান্য ঝুঁকিকে বিবেচনায় নিয়ে ‘ভালনারেবিলিটি’ সূচক যুক্ত করার মাধ্যমে দারিদ্র্যে আটকে পড়া এবং দরিদ্রাবস্থায় চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর এগুলোতে অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. শহরাঞ্চলের জন্য দ্রুতগতিতে একটি কার্যকর সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
৪. দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে জীবিকায়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম, যেমন - স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ইত্যাদিতে জলবায়ু পরিবর্তনের লেন্স যুক্ত করতে হবে যেন সেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার সক্ষমতা তৈরি করতে পারে।
৫. সরকারি-বেসরকারি আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমে অর্থায়নও আরও বাড়াতে হবে এবং রিসোর্সের সঠিক এবং সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
৬. সমাজ থেকে অসমতা দূর করার লক্ষ্যে কমিউনিটিভিত্তিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পারিবারিকভাবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘সামাজিক সম্প্রীতি’ বিষয়ক পাঠদান করতে হবে।
৭. সরকার, বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তিপর্যায় - প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সুশাসনকে শক্তিশালী করতে হবে। সকল নাগরিক যেন প্রাপ্য সেবা ও অধিকারে অভিগম্যতা পায় তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বেসরকারি সংস্থার দায়িত্ব তাদের কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা এবং রিসোর্সের সর্বোচ্চ ব্যবহার করার মাধ্যমে কর্মসূচির কাক্সিক্ষত ফলাফল অর্জন। ব্যক্তিপর্যায়ে প্রতিটি মানুষের নিজ দায়িত্বে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার চর্চা করা এবং স্থানীয় সরকারসহ সকল সেবাপ্রদানকারী সংস্থাকে দায়িত্ব এবং কর্তব্য যথাযথভাবে পালনে উৎসাহিত করা। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যতই উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক না কেন শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো, সহমর্মিতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চা ছাড়া কোনো কার্যক্রমই সঠিক ফলাফল আনতে পারবে না। তাই সমতার বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য