বিশ্বব্যাপী যেসব অসংক্রামক রোগে মানুষের সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়, তার অধিকাংশই বায়ুদূষণজনিত। বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া দূষণের ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে অন্তত ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে বায়ুদূষণজনিত কারণে শুধু ২০১৯ সালেই ৮৮ হাজারের মতো মানুষ মারা গেছে। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি শহরের বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সে শহরগুলো বাসযোগ্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নাম। এ অবস্থায় দেশে অতিরিক্ত বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতাসহ সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর।
দেশের বায়ুদূষণপ্রবণ এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। বাতাসে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই বস্তুকনা এতটাই ক্ষুদ্র যে, এটি সহজেই মানুষের চোখ-নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। যার কারণে দেশে ফুসফুস, হার্ট, কিডনি, লিভারজনিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে এ দূষণের ফলে মানুষের গড় আয়ু কমে যাওয়া, নারীর গর্ভপাত, শিশুর জন্মগত ত্রুটি, শিশুর স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে বলে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন। এ ছাড়া বায়ুদূষণের ফলে গাছের খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়া বা সালোকসংশ্লেষণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে প্রাণিজগতের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ছে।
সাধারণত দেশের বায়ুর মান কখনোই স্বাস্থ্যসম্মত থাকে না। জুলাই-আগস্টে কিছুদিনের জন্য বাতাসের মান থাকে চলনসই। বছরের বাকি সময়ে কখনো অস্বাস্থ্যকর, কখনো খুবই অস্বাস্থ্যকর থাকে। বায়ুদূষণের কারণে দেশবাসীর যে স্বাস্থ্যহানি ঘটে, তার জন্য প্রত্যেককে প্রতি বছর ৮ হাজার ৩৩৪ টাকা খরচ করতে হয়। আর মোট ক্ষতির পরিমাণ ৬৫২ কোটি মার্কিন ডলার, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের শহরগুলোতে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ, সমন্বয়হীন সংস্কারকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ইটভাটা, শিল্প-কারখানার বর্জ্য, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ দিন দিন বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কয়েক দফা সুপারিশ করেছেন গবেষকরা। এর মধ্যে রয়েছে শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরগুলোয় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা, নির্মাণকাজের সময় নির্মাণস্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়া, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের পথে। যার জন্য বিভিন্ন ধরনের নির্মাণকাজ চলছে। এ জন্য পরিবেশদূষণও বাড়ছে। তাই পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এটি চ্যালেঞ্জ হলেও মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। প্রকৃত অর্থে বায়ুদূষণ তথা পরিবেশদূষণের হাতে থেকে দেশকে মুক্ত করতে চাইলে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রীয় আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে বায়ুদূষণ রোধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এ ছাড়া বায়ুদূষণ রোধে আইনের যে খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা দ্রুত পাস করিয়ে জরুরিভাবে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। সেই সঙ্গে শক্তিশালী রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হলে আগামী বছরগুলোতে বায়ুদূষণ আরও বাড়তে পারে। তাই যেসব কারণে দেশের বায়ুদূষণসহ সকল প্রকার পরিবেশদূষণ হয়ে থাকে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিচার-বিশ্লেষণ করে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ দূষণ রোধে বর্তমান সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। কারণ এই সরকারের পরিবেশবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান একজন পরিবেশবিদ। এর আগে তিনি এ বিষয়ে ব্যাপক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। এখন তিনি নিজেই সেই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। সুতরাং পরিবেশ দূষণ রোধে তিনি কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য