জানমালের নিরাপত্তা ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার অধিকার প্রত্যেক মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। দেশের সব নাগরিককে নিরাপদ রাখা ও বাঁচতে দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধানতম দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কোনো ব্যক্তি, সংঘ, সংগঠন, বহিঃশত্রু বা স্বয়ং রাষ্ট্র কোনো নাগরিককে এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না; বরং রাষ্ট্র তার নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা যেকোনো মূল্যে নিশ্চিত করতে বাধ্য থাকবে। কোনো কারণে সুরক্ষায় ফাটল দেখা দিলে তা সত্বর মেরামত করা ও ন্যায়বিচার করাও রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। এবং রাষ্ট্র যে তার দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, নাগরিকের মনে সেই আস্থা বাঁচিয়ে রাখাও তারই কাজ। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছে, রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব পালনে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েক দিন পুলিশবিহীন থাকায় চরম অবনতি ঘটেছিল আইনশৃঙ্খলার। কিন্তু পরে থানা সচল ও পুলিশ কাজে ফিরলেও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে জনমনে স্বস্তি ফিরছে না।
সঙ্গত কারণেই বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দায় বর্তায় অন্তর্বর্তী সরকার ও পুলিশের ওপর। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ এখনো যথেষ্ট তৎপর নয়। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশের প্রতি মানুষের ক্ষোভ ও আস্থাহীনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল ৫ আগস্ট। হামলা, লুট, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায়। অনেক পুলিশ সদস্য প্রাণও হারিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ধাপে ধাপে পুলিশ সদস্যরা কাজে ফিরলেও তাদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা কাটেনি। সহায়তার জন্য সেনাসদস্যরা থাকলেও পুলিশ সদস্যরা এ শঙ্কার কারণে পুরোদমে মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন না। এর সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা।
গত কয়েকদিন ধরে একের পর এক হত্যার ঘটনা ঘটছে। যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচভুলোট সীমান্তে ধারালো অস্ত্রের আঘাত ও পিটুনিতে তিন যুবকের মৃত্যুর ঘটনার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের ফতেপুর ইউনিয়নের মল্লিকপুর বাজারে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান দেখে ফেরার পথে দুই কিশোরকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। খোদ রাজধানীতে কয়েক দিনের ব্যবধানে দুর্বৃত্তদের হাতে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির দুই শিক্ষার্থীর হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়েছেন। এটি গুপ্ত হত্যাকাণ্ড কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
উল্লিখিত ঘটনার বাইরেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে চলেছে। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই কানুকে জুতার মালা পরিয়ে হেনস্তা করা হয়েছে ২২ ডিসেম্বর। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এই মুক্তিযোদ্ধা নিজ দলেরই সাবেক সংসদ সদস্য মুজিবুল হকের রোষানলে পড়ে বিগত ৮ বছর এলাকায় যেতে পারেননি।
বাড়িতে ফিরেছেন ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর। বাড়ির পাশের গ্রামে ৭৮ বছর বয়সী কানুকে একা পেয়ে স্থানীয় অন্তত জনা বিশেক লোক তার গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেয়। তাদেরই একজন ঘটনার ভিডিও করে, যেটি ছড়িয়েছে ফেইসবুকে।
ভিডিওতে দেখা যায়, একপর্যায়ে কানু জুতার মালা সরিয়ে এলাকায় থাকার আকুতি জানালেও তাকে এলাকা ছাড়ার হুমকি দিতে থাকেন ঘিরে থাকা লোকজন। ময়মনসিংহে এক নারীকে তিন মাস আটক রেখে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একজন কর্মী খুন হয়েছেন সেখানকার কয়েকজন সহকর্মীর হাতে। সম্প্রতি হানিফ ফ্লাইওভারের সায়েদাবাদ প্রান্তের ঢালে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কামরুল হাসান। এর ৩ ঘণ্টার ব্যবধানে রাত ১২টার দিকে মতিঝিলে বিমান অফিসের কাছে মারধরে আহত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল হালিম রাতেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। একই রাতে আফতাবনগরে ছুরিকাঘাতে খুন হন এক গৃহবধূ। রাজধানীর অদূরে টঙ্গীতে তুরাগতীরের বিশ্ব ইজতেমা মাঠের দখল নিয়ে তাবলীগ জামাতের দুই পক্ষের সংঘর্ষে চারজন নিহত এবং শতাধিক আহত হন। পুলিশ সক্রিয় থেকেও এই ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। নোয়াখালীতে সম্প্রতি মা-মেয়েকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ছিনতাইয়ের সময় চালককে হত্যা করা হয়েছে। সৈয়দপুরে ব্যাংক থেকে ক্ষুদ্রঋণের টাকা তুলে বের হওয়ার পর এক ব্যক্তি ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন। এদিকে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের একটি শাখায় কয়েকজন ডাকাত অস্ত্রসহ ঢুকে পড়ে ব্যাংকটির কর্মী ও গ্রাহকদের জিম্মি করে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে তারা গ্রেপ্তার হয়। এসব ঘটনা সামগ্রিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতিরই একটি খণ্ডচিত্র।
প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন হচ্ছে। পুলিশের তথ্যই বলছে, গত দুই মাসে দেশে অন্তত ৩৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনের পর লাশগুলো ফেলে দেওয়া হয় ঝোপঝাড়ে। এদিকে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিনতাই ও চুরি-ডাকাতি বেড়েছে। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় অস্ত্রধারীদের দৌরাত্ম্য এবং প্রকাশ্যে চাপাতি-রামদা নিয়ে হামলা কিংবা দৌড়াদৌড়ির বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানাহেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন— এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছেন মানুষ। বনানীতে এক সন্ধ্যায় জটে আটকে থাকা যানবাহনের সামনে চাপাতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই তরুণের ছিনতাইয়ের দৃশ্যও মানুষকে শঙ্কিত করেছে। রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা এতটাই বেড়েছে যে, মানুষ রাস্তাঘাটে চলাচল করতে ভয় পাচ্ছেন। নিয়মিত ঘটছে চুরি ও ডাকাতির ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ৫ আগস্ট থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাড়ে চার মাসে ছিনতাইকারীর হাতে নিহত হয়েছেন সাতজন।
ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির সব ঘটনার অভিযোগ থানা পর্যন্ত যাচ্ছে না। ফলে এসব অপরাধের প্রকৃত চিত্রও জানা যাচ্ছে না। সম্প্রতি সংঘটিত ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ঘটনা ঘটছে রাতে ও ভোরে। ছিনতাইকারীরা ধারালো অস্ত্র বেশি ব্যবহার করছে। তারা দলবদ্ধ হয়ে এসব অপরাধ ঘটাচ্ছে। কিন্তু অভিযোগ দেওয়ার পরও অনেক ঘটনায় অপরাধীরা ধরা পড়ছে না। রাতে ও ভোরে ঢাকার সড়কে পুলিশের উপস্থিতি থাকে কম। এ সুযোগ অপরাধীরা কাজে লাগাচ্ছে। ছিনতাই-চুরির মামলায় আসামিরা অনেক ক্ষেত্রে ধরা পড়ে না, সাজাও হয় না। এতে অপরাধও থামে না।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে অনেককে চাকরিচ্যুত করার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো বর্তমানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে না। অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক পুলিশ সদস্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে, যা জনজীবনে সীমাহীন উদ্বেগ তৈরি করছে।
একথা ঠক যে, সাম্প্রতিক সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে তারা নৈতিক সংকটে পড়েছে। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়ায় অপরাধীরা সুযোগ নিচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। যেকোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সক্রিয় করতে হবে। কোনো কোনো এলাকায় বেশি চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি সংঘটিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে পুলিশকে বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করতে হবে। এসব অপরাধপ্রবণ এলাকায় কারা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করে তা ভেঙে দিতে হবে। একই সঙ্গে জড়িত প্রত্যেক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। যেখানে অপরাধ, সেখানেই তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। তা হলেই মানুষের মন থেকে ভয় কাটতে থাকবে। পরিস্থিতিরও উন্নতি হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় পাঁচ মাস পূর্ণ হতে চলেছে। এই সরকারের কাছে মানুষ এখন আর কোনো অজুহাত শুনতে রাজি নয়। অবিলম্বে সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখতে চায়। মানুষের চাওয়া অনুযায়ী সরকারকে চলতে হবে। দেশের মানুষ একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় সরকারকে সহায়তা করেছে, সমর্থন করেছে। কিন্তু সরকারকেও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হবে। বিশেষ করে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
আগে যখন দলীয় সরকার ক্ষমতায় ছিল, তখন অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাত। খুঁটির জোরের কারণে অনেক অপরাধীর বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারত না। এখন সেই পরিস্থিতি নেই। দল-নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। দলীয় আনুকূল্য পাওয়া পুলিশরাও এখন দায়িত্বে নেই। তাহলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ভূমিকা পালন করা যাচ্ছে না কেন? বাধা কোথায়? কোথায় দুর্বলতা?
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বোঝা দরকার, সন্ত্রস্ত নাগরিককে আশ্বস্ত করার দায় তাদের। যেকোনো মূল্যে দেশের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। দীর্ঘদিন অগণতান্ত্রিক পথে চলার পর নতুন এক ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছে। একে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সবার আগে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে শঙ্কা থাকলে কোনো অর্জনই টেকসই হবে না।
লেখক : সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য