বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, ৫৩ বছরের ইতিহাসে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বর্তমানে সবচেয়ে ‘নাজুক’। বাংলাদেশের কোনো সরকারের সঙ্গে অতীতে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এতটা নাজুক হয়নি। চলতি বছরের ৫ আগস্ট পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘদিনের সুসম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়; যা বিভিন্ন ঘটনায় ক্রমশ বেড়েছে। বিশেষ করে, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ভারতের বিভিন্ন কার্যকলাপ নিয়ে কড়া ভাষায় বক্তব্য রেখেছেন। বিজেপি সমর্থিত ভারতীয় গণমাধ্যমে রাজনৈতিক সহিংসতাকে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা হিসেবে প্রচারের ক্রমাগত মিথ্যাচারের পাশাপাশি দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-সমর্থকদের উসকানি, ভারতে বাংলাদেশের উপ-মিশনে হামলা ও জাতীয় পতাকার অবমাননা, সীমান্ত হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশ সরকার কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেও দৃশ্যমান ভারতবিরোধিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অতীতে, শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পাশাপাশি ভারত সরকারের সমালোচনাও করা যেত না। একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল। এখন সরকারি তরফে কোনো বাধা না থাকায় বাংলাদেশের জনগণও প্রকাশ্য ভারত সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করছেন।
প্রকাশ্য ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গুম-খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ শোনা যায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) মধ্যম সারির জনপ্রিয় নেতা ইলিয়াস আলী টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণসহ দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। সরকারের একজন অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান সরকারবিরোধী লেখার কারণে যেসব লেখা ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় ছিল সে কারণে গুম হয়েছেন বলে মনে করেন।
জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে ব্রি. (অব.) আযমীও অভিযোগ করেছেন, তিনি ভারতবিরোধিতার কারণে গুমের শিকার হন। বুয়েটের ছাত্র আবরার ভারত ও বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের নীরবতা এবং ভারতবিরোধিতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখার কারণে নির্মমভাবে খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি বেসরকারি ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তাজবির হোসেন শিহানও ভারতীয় আধিপত্যবাদ নিয়ে লেখালেখি করায় খুন হয়েছেন বলে তার সহপাঠীরা অভিযোগ করেছেন। এমন উদাহরণ আরও অনেক রয়েছে।
বাংলাদেশে নরেন্দ্র মোদি যে কয়বার এসেছেন প্রতিবারই ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিবাদ করেছে। এসব রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে, ভারতে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙেছে মোদির দল বিজেপি ও আরএসএস। তারা মুসলমানদের হত্যা করেছে। গুজরাট দাঙ্গায় মোদির নিষ্ক্রিয়তার কারণে শত শত নিরীহ মুসলিম খুন হয়েছে।
এ কারণে মোদির ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নিষেধাজ্ঞাও পর্যন্ত আরোপ করেছিল। মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেক রাজ্যে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন বেড়েছে। মোদির সফরের বিরোধিতা করায় ইসলামী দলগুলোর নেতাকর্মীরাও গুম-খুন-হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। ইতোমধ্যে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সেসব ঘটনায় একাধিক হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হেফাজত নেতা ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মামুনুল হক তার বিরুদ্ধে সরকারের রোষানলের প্রধান দুটি কারণ হিসাবে মোদির বাংলাদেশ সফর এবং শেখ মুজিবের ভাস্কর্য (তাদের ভাষায় মূর্তি) স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কথা উল্লেখ করেন। এ দুটি ঘটনায় তার বিরুদ্ধে প্রায় ৫০টি মামলা হয়েছিল।
বাংলাদেশে বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের অতি আগ্রাসী হওয়ার পিছনে ভারত সরকারের সায় ছিল। কারণ, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে ভারতের একাধিক রাজ্যের স্বাধীনতাকামীদের (ভারত সরকারের দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী) প্রশ্রয়ের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেসব ঘটনায় ৭টি রাজ্য নিয়ে ভারত সরকারের দুশ্চিন্তা বাড়ছিল। এ কারণেই খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে সরানোর ঘটনা ঘটেছে। একই কারণে, পরবর্তী রাজনৈতিক প্রজন্মকে সরিয়ে দেওয়ার মানসে তারেক জিয়াকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলে দলের কেউ কেউ মনে করেন। জিয়া পরিবারের আরেক সদস্য আরাফাত রহমান পদ্ধতিগত খুনের শিকার হয়েছেন বলে স্বয়ং তারেক রহমান বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করেছেন। এতে আওয়ামী লীগ এক ঢিলে দুই পাখি নিধনের চেষ্টা করেছে। একদিকে প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশ্রয়দানকারীদের আওয়ামী লীগ সরকার কঠোরভাবে শায়েস্তা করেছে, যাতে ভারতের আরও বেশি আস্থা অর্জন করা যায়।
জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি এবং গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে - জামায়াতের দিক থেকে এমন অভিযোগ শোনা যায়। ৭১ সালে জামায়াত ও সহযোগী ইসলামী ছাত্র সংঘের (বর্তমান নাম ইসলামী ছাত্র শিবির) অনেক নেতা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল, অনেকে পাকিস্তান আর্মির সহযোগী হয়ে খুন-ধর্ষণে জড়িত ছিল। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিচার হয়েছে, যেভাবে গণজাগরণ মঞ্চের কারণে রায় পরিবর্তন হয়েছে সে প্রক্রিয়া নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞ অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানপন্থি জামায়াত নেতাদের ফাঁসির মাধ্যমে প্রকারান্তরে পাকিস্তানকে শায়েস্তা করা হয়েছে।
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি অংশ নেবে না - এমন ঘোষণা দেওয়ার পর ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে এরশাদকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। একটি স্বাধীন দেশের নির্বাচনে কোন দল অংশ নেবে, কোন দল নেবে না সেটি কোনোভাবেই ভারতের বিষয় হতে পারে না। নির্বাচনে নিতে না পারায় শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ র্যাবের সহায়তায় অনড় এরশাদকে জোরপূর্বক হাসপাতালে ভর্তি করে। অপরদিকে তার স্ত্রী রওশনকে ব্যবহার করে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি শুধু নয়, ছোট দল, প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন এবং বিভিন্ন ব্যক্তিও ভারতবিরোধিতার কারণে বিগত সরকারের রোষানলে পড়েছিল। প্রয়াত প্রকৌশলী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বে অরাজনৈতিক সংস্থা ‘তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’ বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরকার, পুলিশ ও প্রশাসন এবং সরকারি ছাত্র ও যুব সংগঠনের হামলা-মামলার শিকার হয়েছে। এর একটা বড় কারণ সুন্দরবনবিনাশী রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিরোধিতা, যেখানে ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে।
ভারত সরকারের বিরোধিতার ঘটনায় বাংলাদেশে গুম-খুন বা বাংলাদেশ সরকারের কঠোর প্রতিক্রিয়ায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সম্পৃক্ততা আছে কি নেই - সেটি এ লেখায় আলোচ্য বিষয় নয়। বাংলাদেশে গত ১৬ বছরের গুম-খুনের ঘটনাগুলো তদন্ত করলে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের সম্পর্কে জানা যাবে। তবে শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করতে ভিন্ন দেশে গিয়ে বা ভিন্ন দেশের সরকারি বা পেশাদার খুনি ব্যবহার করে এমন গুপ্তহত্যার ঘটনা পৃথিবীতে অস্বাভাবিক নয়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত বছর কানাডা তাদের দেশের নাগরিক হত্যা ও যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশের নাগরিকের হত্যাচেষ্টার ঘটনায় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-কে দায়ী করেছে। বিশেষ করে, ২০২৩ সালের ১৮ জুন কানাডার সারে-তে খালিস্তানপন্থি শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় কানাডা সরাসরি ভারত সরকারকে দায়ী করেছে। তিনি ভারত সরকারের কাছে মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসী ছিলেন। কাছাকাছি সময়ে কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত নাগরিক গুরপতবন্ত সিং পান্নুন হত্যাকাণ্ডে ভারতের সাবেক গোয়েন্দা অভিযুক্ত হয়েছেন। এসব ঘটনা ভারতের সঙ্গে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে প্রভাব ফেলেছে।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করছে নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। বিজেপির দীর্ঘদিনের মিত্র শেখ হাসিনার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হুট করে ক্ষমতা হারাবেন, এটি ভারত সরকার অনুধাবন করতে পারেনি। এতে দেড় দশকের সম্পর্ক (২০০৯-৪ আগস্ট ২০২৪) হঠাৎ করে ধাক্কা খেয়েছে। যে কারণে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার ক্ষমতা হারানো ও ভারতে পলায়ন নিশ্চিত হওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাতে ভারতের সময় লেগেছে। মোদি ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারক ও বাহক, রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ (আরএসএস) থেকে উঠে এসেছেন। আরএসএস বা বিজেপি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে। ভারতে বিজেপি যেমন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে, বাংলাদেশে জামায়াত ইসলামী, চরমোনাই পীরের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোটভুক্ত বিভিন্ন সংগঠনও ধর্মনির্ভর রাজনীতি করে। ভারতে বিজেপির প্রভাব ও মুসলমানদের সঙ্গে বৈষম্য যতটা বেড়েছে, বাংলাদেশেও ধর্মভিত্তিক দলগুলো ততটাই শক্তিশালী হয়েছে, একই কারণে বেড়েছে ভারতবিরোধিতা।
ভারত যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ, সীমান্ত হত্যা, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে বাঁধ ও বর্ষায় পানি ছাড়ার মতো ঘটনা বন্ধ করে, সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা দেয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা কমে আসবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে এ অঞ্চলের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। দুদেশের জনগণই উপকৃত হবে। কিন্তু এ সম্পর্ক ন্যায্যতা ও সাম্যের ভিত্তিতে হতে হবে, সেটিই বাংলাদেশের প্রত্যাশা।
লেখক : সাংবাদিক ও জননীতি, সুশাসন ও রাজনীতি বিশ্লেষক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য