বাংলাদেশে সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। ওই অর্থে সরকারের মেয়াদও তাই। সংবিধানের ৭২ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত নভেম্বরে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনের ফাঁকে কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘নতুন সংবিধানে নিয়মিত সরকারের মেয়াদ হয়তো চার বছর হচ্ছে’ বলে মন্তব্য করার পরে সংসদের মেয়াদের বিষয়টি নতুন করে সামনে আসে। যদিও ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের কালেই সংসদের মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশ এসেছিল। গণপরিষদে খসড়া সংবিধান পেশ করার পর কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তই এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। যদিও ওই প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।
প্রসঙ্গত, প্রধান উপদেষ্টা ‘নতুন সংবিধান’ বলতে কী বুঝিয়েছেন সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। তবে সংবিধান সংস্কারের জন্য সরকারের গঠিত একটি কমিশন এখন কাজ করছে। আগামী মাসে প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের রিপোর্ট দেওয়ার কথা। কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং তাদের মতামত নেওয়ার পরে সংবিধান বিষয়ে একটি প্রতিবেদন সরকারকে দেবে। তারপর সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। সম্ভবত কমিশনও সংসদের মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশ করবে।
ওই সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস তার অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, ‘আমরা স্থায়ী সরকার নই। উদাহরণ হিসেবে মনে করুন, আমাদের এখানে নিয়মিত সরকারের মেয়াদ হয় ৫ বছর। এটাই বিষয়। কিন্তু নতুন সংবিধানে হয়তো এর মেয়াদ করা হচ্ছে ৪ বছর। কারণ, জনগণ দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হতে চায়।’
রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান : সম্প্রতি সংবিধান সংস্কার কমিশনের কাছে দেওয়া প্রস্তাবে এবং প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় সংসদের মেয়াদ চার বছর করার সুপারিশ করেছে একাধিক দল ও সংগঠন। নাগরিক সংগঠন ‘সুজন’ যে লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি এর মেয়াদ ছয় মাস করা এবং জাতীয় সংসদের মেয়াদ কমিয়ে চার বছর করা এবং একজন ব্যক্তির দু-বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছে।
জাতীয় সংসদের মেয়াদ এক বছর কমিয়ে চার বছর নির্ধারণ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদও। পাশাপাশি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদের দাবিও জানিয়েছে দলটি। গত ৫ অক্টোবর রাতে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপ শেষে তার বাসভবন যমুনার সামনে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে এ কথা বলেন দলের সভাপতি নুরুল হক নূর। গণঅধিকার পরিষদের ১২ দফা সুপারিশের ১১ নম্বরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ এবং সংসদের মেয়াদ চার বছর করার কথা বলা হয়েছে। এরপর সংবিধান সংস্কার কমিশনের আহ্বানে জাতীয় নাগরিক কমিটি যে লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছে, সেখানেও সরকারের মেয়াদ হবে ৪ বছর করার সুপারিশ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে একই ব্যক্তির দু-বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিধান করারও সুপারিশ দিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। তবে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর পক্ষে নয় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। তারা এ পর্যন্ত সংস্কারের যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ কমানোর কোনো কথা বলা হয়নি। তবে এসব দল সংসদীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনা এবং এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না - এমন প্রস্তাব দিয়েছে।
বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, চার বছর পরপর নির্বাচন করা হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাড়বে। এছাড়া নির্বাচন করার জন্য বড় অঙ্কের অর্থব্যয়ের বিষয়ও রয়েছে। তারা আরও বলেন, দেশের রাজনীতিতে সহনশীলতার ঘাটতি রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরে নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এখনো অল্প সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন করার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে তারা মনে করেন। নাগরিক ঐক্যের প্রধান মাহমুদুর রহমান মান্নাও বলেন, ‘নির্বাচিত সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদ প্রতিষ্ঠিত একটা বিষয়। এই মেয়াদ কমানোর চিন্তা নতুন বিতর্কের জন্ম দেবে। যুক্তরাজ্যকে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূতিকাগার বলা হয়। সেখানেও সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর রয়েছে।’
বাংলাদেশের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ঐক্যমত্য হয়েছিল ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের পতনের পর, তার লিখিত রূপ ছিল - তিন জোটের রূপরেখা। ওই রূপরেখাতেও সরকার বা সংসদের মেয়াদ কমানো বা বাড়ানো নিয়ে কোনো বিষয় ছিল না।
সুরঞ্জিতের যে প্রস্তাব ছিল : ১৯৭২ সালে গণপরিষদে উত্থাপিত সংবিধান বিলের ওপর সংবিধান প্রণয়ন কমিটির বিরোধীদলীয় সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যে নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমতসূচক বক্তব্য) দিয়েছিলেন, সেখানে তিনিও সংসদের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাব করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, স্বল্প স্থায়িত্বের সংসদ জনগণের প্রতি তার দায়দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অধিকতর সচেতন থাকে। সংসদীয় আসন তিনশ-এর পরিবর্তে ৩৫০ করা এবং সংরক্ষিত আসনের বিধান বাতিলেরও সুপারিশ করেন সুরঞ্জিত। বলেন, ‘এই বিধানের দ্বারা সংবিধানে স্বীকৃত জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের ধারণার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ পায়। নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের বিধান জীবনের সর্বক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করে না বরং এর মাধ্যমে অন্যদের ওপর নারীদের নির্ভরশীল করে তোলা হয়।’
চার বছরের সুবিধা-অসুবিধা : পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মেয়াদ চার বছর হওয়ায় সেখানকার সরকারকে চার বছর মেয়াদি বলা হয় এবং এটিই চার বছর মেয়াদি সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী উদাহরণ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের মেয়াদ ২ বছর এবং সিনেটের মেয়াদ ৬ বছর। কানাডায় পার্লামেন্টের মেয়াদ পাঁচ বছর হলেও ২০০৭ সালে সেটি কমিয়ে চার বছর করা হয়। জার্মানি, সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক বা সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের অনেক দেশের প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদও চার বছর। যদিও বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় সরকারের মেয়াদ সাধারণত পাঁচ বছর।
অস্ট্রেলিয়ার হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের মেয়াদ ৩ বছর, তবে কিছু রাজ্য সংসদের মেয়াদ ৪ বছর। নিউজিল্যান্ডের সংসদের মেয়াদ সাধারণত ৩ বছর হলেও এটি পরিবর্তনযোগ্য। জাপানের নিম্নকক্ষ বা হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের মেয়াদ ৪ বছর। দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদের মেয়াদ ৪ বছর। সিঙ্গাপুরের সংসদ সদস্যদের মেয়াদও ৪ বছর। অনেক দেশেই নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে মেয়াদ কমানো বা বাড়ানোর বিধান রয়েছে। যেমন, সংসদ ভেঙে আগাম নির্বাচন ডাকলে মেয়াদ কমে যেতে পারে। সংসদের মেয়াদ ৪ বছর হওয়ার সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই আছে। এটা মূলত নির্ভর করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া এবং গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের ওপর। সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছরের কম হলে গণতান্ত্রিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা সহজ হয় বলে অনেকে মনে করেন। যে যুক্তিটি দিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাছাড়া চার বছরের মেয়াদে জনগণের কাছে সরকার ও সংসদ সদস্যদের নিয়মিত জবাবদিহি করার সুযোগ থাকে। এটি নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়া সহজ করে। খুব বেশি দীর্ঘ মেয়াদ জনগণের মধ্যে নির্বাচনের আগ্রহ কমিয়ে দিতে পারে বলেও অনেকে মনে করেন। ফলে চার বছর একটি ভারসাম্যপূর্ণ সময়। ৪ বছর মেয়াদে জনপ্রতিনিধরা জনপ্রিয়তা ধরে রাখার কৌশলে বেশি মনোযোগী হতে পারেন। তবে প্রতিবার নির্বাচনে যেহেতু রাষ্ট্রের অনেক অর্থ ব্যয় হয়, ফলে চার বছর পরপর এটি করতে গেলে খরচ বাড়বে। যেমন এখন প্রতি ২০ বছরে এরকম খরচ করতে হয় চার বার। কিন্তু চার বছর পরপর নির্বাচন করতে গেলে ২০ বছরের মধ্যে এই খরচ করতে হবে পাঁচবার। বিএনপি মূলত এই যুক্তিই দিচ্ছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন যে প্রতিবেদন দেবে, সেখানে সংসদের মেয়াদের বিষয়ে সুপারিশ থাকবে এবং তারাও চার বছর করার পক্ষে বলা জানা গেছে। এই প্রতিবেদন নিয়ে সরকার যদি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একটি বড় সংলাপের আয়োজন করে, সেখানে নিশ্চয়ই সংসদের মেয়াদেরও প্রসঙ্গটিও আসবে।
দ্বিকক্ষ সংসদ হচ্ছে কী : বাংলাদেশের সংসদ এককক্ষবিশিষ্ট। কিন্তু ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ রয়েছে। যার একটিকে বলা হয় উচ্চকক্ষ, আরেকটি নিম্নকক্ষ। একেক দেশে এর একেক নাম এবং নির্বাচনের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করা হয়েছিল ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময়কালেই। সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির জ্যেষ্ঠতম সদস্য হাফেজ হাবীবুর রহমান উচ্চকক্ষ-সংবলিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা একটি সর্বজনীন স্বীকৃত ব্যবস্থা উল্লেখ করে সংবিধানের ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে সংশোধনী প্রস্তাব এনে বলেছিলেন, একক হস্তান্তরযোগ্য ভোটের মাধ্যমে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ দ্বারা নির্বাচিত ষাট সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের সমান ক্ষমতা থাকবে, শুধু আর্থিক বিল প্রণয়নের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের একক অধিকার থাকবে। কোনো বিল নিয়ে দুই কক্ষের মধ্যে কোনো পার্থক্য হলে যৌথ সভায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
নোট অব ডিসেন্টে হাফেজ হাবীবুর রহমান বলেন, ‘উদার গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ফেডারেল বা একক— যা-ই হোক না কেন, বিশ্বের প্রায় সব রাষ্ট্রই এটি গ্রহণ করেছে। উচ্চকক্ষ গ্রহণের জন্য প্রথাগত যুক্তিগুলো বাদেও আমি এখানে লর্ড ব্রাইসের পর্যবেক্ষণ উদ্ধৃত করতে চাই, ‘একটি অ্যাসেম্বলির সহজাত প্রবণতা হলো এটি ঘৃণ্য, অত্যাচারী এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হতে পারে, সে কারণে সমান ক্ষমতাসম্পন্ন অন্য আরেকটি কক্ষের সহাবস্থান দ্বারা এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।’
বাংলাদেশে সংসদীয় আধিপত্যের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এখানে দ্বিতীয় কক্ষ থাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের কোনো অঙ্গকেই অনিয়ন্ত্রিত ও দুর্দমনীয় ক্ষমতা প্রদান করা উচিত নয়। সংবিধান সংস্কার কমিশনও দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুপারিশ করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ। অর্থাৎ তাদের প্রতিবেদনে বিষয়টি থাকবে। সেই সঙ্গে একই ব্যক্তির দু-বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে না পারার বিষয়টিও সংবিধানে যুক্ত করার বিষয়ে কমিশনের সদস্যরা একমত বলে তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
লেখক : সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য