বিদেশি শিল্পী দিয়ে বিপিএল উদ্বোধন

দেশীয়রা কেন বৈষম্যের শিকার?

আমিনুল ইসলাম সুজন
দেশীয়রা কেন বৈষম্যের শিকার?

প্রত্যক্ষ বিনোদন সাংবাদিকতার কারণে দেশের সঙ্গীত অঙ্গনকে খুব কাছ থেকে দেখা, শোনা, জানা ও বোঝার সুযোগ হয়েছিল ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। তখন অডিও ক্যাসেটের স্বর্ণযুগ। সিডি, ভিডিও তখন পর্যন্ত বাজারে আসেনি বললেই চলে। ইউটিউব বা অন্য কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও তৈরি হয়নি। ফলে, খেলাধুলা করা ও দেখার বাইরে মানুষের বিনোদনের জন্য রেডিও, টেলিভিশন, মঞ্চ অনুষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল লক্ষ্যণীয়। এর বাইরে, বিপুলসংখ্যক মানুষ অডিওতে গান শুনত, সিনেমা হলে গিয়ে ছবি (চলচ্চিত্র) দেখত।

অনেক কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পীর গান সামনে বসে শোনার সুযোগ হয়েছিল (মঞ্চে কিংবা রেকর্ডিং স্টুডিওতে) এবং সুনির্দিষ্ট গান বা অডিও অ্যালবাম নিয়ে সাক্ষাৎকার ও গানের বিষয়ে মানুষের অভিমত গ্রহণ, শিল্পীকলাকুশলী ও অডিও কোম্পানির প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে সঙ্গীত জগতের বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। ক্রমশ গান শোনা ও গানের শিল্পী, সুরকার, গীতিকার, বাদ্যকরদের সান্নিধ্য সঙ্গীতবিষয়ক ধারণাকে সমৃদ্ধ করেছে।

একটি গান অনেক মানুষের শ্রমের ফসল। একজন গান লেখেন (গীতিকার), একজন সুর করেন (সুরকার)। আরেকজন গানটির সঙ্গীত আয়োজন করেন, অর্থাৎ গানের সুর ও কণ্ঠের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের মিশ্রণে মিথস্ক্রিয়া তৈরি করেন। সর্বশেষ, গীতিকারের কথায়, সুরকারের সুরে, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রীদের বাজনার সঙ্গে একজন সঙ্গীতকারের রূপায়ণে কণ্ঠশিল্পীর কণ্ঠে স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে একটি গান সৃষ্টি হয় অর্থাৎ গানের অডিও ভার্সন তৈরি হয়। যা অডিও ক্যাসেট আকারে বাজারে প্রকাশ ও বেতারে প্রচার করা হয়। এরপর, সেই গানের সঙ্গে কোন স্টুডিও বা আউটডোরে শিল্পী গলা মিলিয়ে ভিডিও ধারণ করার পর সে গান বিটিভিতে প্রচার হতো তখন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে বিটিভির পাশাপাশি এটিএন বাংলা, ইটিভি, চ্যানেল আই গানের অনুষ্ঠানও প্রচার শুরু করে।

একটি গান গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতকার, কণ্ঠশিল্পীÑ সকলেই তাদের সন্তান মনে করতে পারেন। এছাড়া, যারা বাদ্যযন্ত্র বাজান তারাও গানটিকে নিজের সৃজনশীল কাজের অংশ বলে মনে করতে পারেন এবং করেন। অনেক সময় একই ব্যক্তি একাধিক ভূমিকায় থাকতে পারেন। যেমন : অনেক গানে সুরকার ও সঙ্গীত আয়োজন একজনকে করতে দেখেছি। গানের কথা, সুর ও সঙ্গীত আয়োজনভেদে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয়। সাধারণভাবে, হারমোনিয়াম, কি-বোর্ড, গিটার, তবলা ইত্যাদি অধিকাংশ আধুনিক গানে ব্যবহার হয়।

সঙ্গীতের কিংবদন্তি কলিম শরাফী, মোস্তফা জামান আব্বাসী, ফেরদৌসী রহমান কিংবা জনপ্রিয় ধারার আবদুল জব্বার, খুরশীদ আলম, সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, এন্ড্রু কিশোর, খালিদ হাসান মিলু বা শাহনাজ রহমতউল্লাহ, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, বেবী নাজনীন প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পীর গান, গায়কী, গানের প্রতি দরদ ও বাংলা গানের প্রসারে আন্তরিকতা দেখেছি।

ব্যান্ড সঙ্গীতেও ততদিনে অনেক তারকা তৈরি হয়েছেন, অনেকে হারিয়ে গেছেন, অনেকে মহাসমারোহে গান করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে ব্যান্ডসঙ্গীতের গুরু মুক্তিযোদ্ধা আযম খান, ফেরদৌস ওয়াহিদ, ফকির আলমগীর, নকীব খানদের সময় পেরিয়ে মাইলস, এলআরবি, নগরবাউল, সোলস, আর্ক তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড দলে পরিণত হয়েছে। এই সব ব্যান্ডের ভোকাল (মূল গানের কণ্ঠশিল্পী) শাফিন ও হামিন ভ্রাতৃদ্বয়, আইয়ুব বাচ্চু, জেমস, পার্থ বড়ুয়া ও হাসান নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তুলে ধরেছেন।

অডিও বাজারে অবশ্য এদের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন মনির খান ও আসিফ আকবর। গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের কাছে মনির খান এবং শহর-গ্রাম সর্বত্র আসিফের গান মানেই তরুণদের মধ্যে নতুন উন্মাদনা তৈরি করছিল। এ শতকের প্রথম দশকে অবস্থাটা এমন ছিল, আনাড়ি ১১ জন শিল্পীর ১১টি গানের সঙ্গে যদি আসিফের একটা গানও থাকত, তবে সেই অডিও ক্যাসেট সুপারহিট হয়ে যেত।

আরেকজনের কথাও বলতে হবে, তিনি মমতাজ। তার বেশকিছু গান শ্রোতাপ্রিয়তা অর্জন করেছে। তবে তিনি গণহারে গান করেছেন, সেই সময় তার অনেক গানের কথা অশ্লীল বলে অভিযুক্ত হয়েছে। অনেকে মনে করেন, বাংলা গানে অশ্লীলতা এনেছিলেন তিনি। আরো অনেকেই বিভিন্ন সময়ে এসেছেন এবং হারিয়ে গেছেন। লেখার কলেবর ঠিক রাখার জন্য অনেক কণ্ঠশিল্পী ও ব্যান্ডদলের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে এবং আড়ালের মানুষের (গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতকার) আড়ালেই রাখা হয়েছে।

পাকিস্তানের বিখ্যাত গায়ক রাহাত ফতেহ আলী খানকে তিন কোটি ৪০ লাখা টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশে গাইতে আনা নিয়ে কিছু বলব বলে ‘গান’ নিয়ে এই সব অতি কথা বলা। ২৩ ডিসেম্বর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লীগ (বিপিএল) মিউজিক ফেস্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান গাইতে রাহাত এই টাকাটা নিয়েছেন বলে বিসিবির বরাত দিয়ে খবর প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলো। অবশ্য জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে সহায়তার জন্য ‘স্পিরিটস অব জুলাই’ প্ল্যাটফর্ম ২১ ডিসেম্বর আর্মি স্টেডিয়ামে আয়োজিত ‘ইকোস অব রেভল্যুশন’ কনসার্টে বিনে পারিশ্রমিকে গান করেছেন তিনি।

যে সাড়ে তিন কোটি টাকার মতো পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছে রাহাত ফতেহ আলী খানকে তা দিয়ে কমপক্ষে দেশের ১০ জন জনপ্রিয় শিল্পী এবং পাঁচটি ব্যান্ডের উন্নয়নে ভূমিকা রাখা যেত। এতে দেশের সঙ্গীত অঙ্গনের উপকার হতো। শিল্পীরা পৃষ্ঠপোষকতা পেতেন। দেশীয় সঙ্গীতের বিকাশ ঘটত।

সংবাদমাধ্যমে দেখেছি, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ঢাকায় পাকিস্তানি শিল্পীর আগমন বেড়েছে। বিদেশি শিল্পীদের আগমন অবশ্য নতুন নয়। হাসিনা রেজিমের দেড় দশক বাংলাদেশে ভারতীয় শিল্পীদের আনাগোনা ছিল নৈমিত্তিক। প্রথম বছর, ২০১২ সালে, বিপিএলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে, ভারতীয় শিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী এবং সে সময়ের তরুণদের ক্রেজ শান গান গাইতে এবং হিন্দি চলচ্চিত্রের নায়িকা বিপাশা বসু ও আইটেম গার্ল মালাইকা অরোরা নাচ করতে এসেছিলেন। ২০১৫ সালে অংশ নেন হিন্দি চলচ্চিত্রের তারকা হৃত্বিক রোশন ও জ্যাকুলিন ফার্নান্দেজ। ২০১৯ সালের বিপিএল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সালমান খান ও কাটরিনা কাইফ। এবার ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তানের শিল্পী আনা হয়েছে। যে টাকা খরচ করে আমরা দিনের পর দিন বিদেশি শিল্পীদের আনছি, সেই টাকায় বাংলাদেশের শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হলে দেশের সঙ্গীতাঙ্গন বিকশিত হতো। দেশে যখন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি দৃশ্যমান, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণহীন এবং ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী, সে সময়ে কেন প্রায় ৩ লাখ ডলার একজন রাহাত ফতেহ আলী খানের জন্য খরচ করতে হবে?

ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস, সঠিকভাবে পরিকল্পনা করলে দেশের ১০, ২০, এমনকি ৫০জন শিল্পীকে দিয়ে একযোগে একটি দেশাত্মবোধক গানের মাধ্যমে বিপিএল ফেস্টের আয়োজন করা যেত। কিংবা ২০২৪-এর গণআন্দোলনকে ঘিরে কোনো নতুন গান তৈরি করে সেটি দিয়ে বিপিএলের উদ্বোধন করানো যেত। কিংবা আসিফের ‘বেশ বেশ বেশ সাবাশ বাংলাদেশের মতো অসাধারণ গানকে বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে ব্যবহার করে বৈচিত্র্য আনার মাধ্যমে ব্যবহার করা যেত। অথবা ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, লোকগান, কবিগান, পটগান, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, গণসঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন দেশীয় সুরের মিশ্রণে নতুন কোনো গান তৈরি করা যেত। এসব সৃজনশীল চিন্তায় আমাদের দীনতা কবে দূর হবে? বড় কোনো আয়োজনে কেন গুরুত্বপূর্ণ অর্থব্যয়ে বিদেশি শিল্পী আনতে হবে?

দীর্ঘদিন ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংস্কৃতি কর্মীরা কথা বলেছেন, কিন্তু সংশ্লিষ্টদের টনক নড়ানো যায়নি। স্যাটেলাইট টিভির শুরু থেকে ভারতের প্রায় সব টিভি চ্যানেল এখানে অবাধে প্রচার হয়ে আসছে। ফলে পোশাক-পরিচ্ছদ, ফ্যাশন, খাবার-দাবার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর প্রভাব আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে একাকার হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে বড় কোনো অনুষ্ঠান হলেই ভারতীয় তারকাদের আনতে দেখেছি। ফলে হিন্দি গানের প্রভাব আরও বেড়েছে। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসন ও এর প্রভাব বিভিন্ন সময়ে আলোচিত-সমালোচিত এবং নিন্দিতও হয়েছে। রাহাত ফতেহ আলী খানও দুদিন ধরে মূলত হিন্দি গানই শুনিয়ে গেলেন আমাদের দর্শকদের। হিন্দি টিভি চ্যানেলের প্রভাব বিষয়ক বই লিখতে গিয়ে হিন্দি টিভি চ্যানেলের আরো বহুমাত্রিক বিস্তার সম্পর্কে জানার সুযোগ হয়েছে আমার। কিন্তু, ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে, মোদি-হাসিনার সম্পর্কের স্বর্ণযুগে এসব বিষয় সংশ্লিষ্টরা কর্ণপাত করেননি।

শুধু ভিন্নমতের কারণে বেবী নাজনীন, জেমস, মনির খান, আসিফ আকবরের মতো শ্রোতাপ্রিয় অনেক তারকাকে নিষিদ্ধ করে রাখার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেছি। এখন বাংলাদেশ ভার্সন দুই (বাংলাদেশ ২ : ০)-এর সময়ে রয়েছি আমরা। যে সময়ে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলা হচ্ছে। মুখে বলছি, কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু কার্যকলাপে বৈষম্য প্রদর্শন করছি। ভারতীয় আগ্রাসন রুখে দিয়ে পাকিস্তানি সংস্কৃতির বাজার তৈরি করা বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিপিএল একটি ক্রিকেট উৎসব। বাংলাদেশে ক্রিকেটই এখন সবচাইতে বড় বিনোদন। সেখানে ভিন দেশের সঙ্গীত তারকা এনে আলাদা বিনোদনের কি দরকার আছে? বিষয়টি এ জাতীয় ভবিষ্যৎ ক্রীড়া উৎসবের ক্ষেত্রে বিবেচনার জন্য নিবেদন করে রাখা হলো। একই সঙ্গে প্রত্যাশা করব, ভবিষ্যতে এ জাতীয় অনুষ্ঠানে বিদেশি শিল্পীর পরিবর্তে দেশীয় শিল্পী ও সৃজনশীলতা যেন প্রাধান্য পায়, সেরকম নীতি গ্রহণের।

লেখক : সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য