শিক্ষা একটি সামাজিক প্রপঞ্চ এবং যা আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ এক হাতিয়ার। মানুষ জন্ম থেকে আমৃত্যু শিখন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই চলে। তবে শিখন প্রক্রিয়া আর শিক্ষার মধ্যে সংজ্ঞাগত কিছুটা পার্থক্য থাকলেও অংশীজন প্রায় একই। ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের পক্ষেই শিক্ষা জীবনের সময়ব্যাপী তথা জীবনব্যাপী চলমান একটি প্রক্রিয়া ধারা।
শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী অন্যতম প্রধান দুই অংশীজনের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। শিক্ষক হলেন আলোকিত, তিনি সমাজ গড়ার সুনিপুণ কারিগর। শিক্ষকতা নিঃসন্দেহে একটি মহান পেশা। একজন শিক্ষার্থীকে কেবল শিক্ষিতই নয় বরং ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার গুরু দায়িত্বটিও থাকে শিক্ষকের ওপর। তাই একজন শিক্ষককে হতে হয় অনেক বেশি সচেতন, অনেক বেশি ধৈর্যশীল। কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির জনক জার্মান মনোবিজ্ঞানী তথা শিক্ষাবিদ ফ্রেডরিক ফ্রয়েবেল এর মতে,‘শিশু হলো উদ্যানের চারাগাছ। শিক্ষক হলেন তার মালি। শিক্ষকের কাজ হলো সযত্নে চারাগাছটি বড় করে তোলা। শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সৎ ও সামাজিক গুণাবলির বিকাশ সাধন করা শিক্ষকের কর্তব্য।’
তবে হ্যাঁ এটাও সত্য যে, হাতের তালি যেমন এক হাতে অর্থাৎ দুই হাতের নিবিড় সংমিশ্রণ যতক্ষণ পর্যন্ত না ঘটে ততক্ষণ অবধি বাজে না ঠিক তেমনি শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়াও শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ের নিবিড় মিথস্ক্রিয়া হলেই সুচারুরূপে সম্পাদিত হয়। তবে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। একটি শ্রেণিকক্ষে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থী থাকে। তাদের মধ্যে কেউ একটি বিষয় সহজেই বুঝতে পারে, আবার কারও বুঝতে যথেষ্ট সময় লাগে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে আর শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আর আগ্রহ সৃষ্টির পেছনে মুখ্য সহায়ক হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন শিক্ষকরা তবে শুধুমাত্র মনোযোগই একমাত্র প্রভাবক নয়।
জার্মান দার্শনিক জন হার্বার্ট শিক্ষা ক্ষেত্রে শিশুর আগ্রহকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তার শিক্ষা পদ্ধতির মূল কথা ছিল, ‘পাঠ্যবিষয়কে এমনভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থী সহজে তাকে গ্রহণ করতে পারে’।গবেষণার তথ্যানুসারে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকের দিকে বিভিন্ন দার্শনিক ও শিক্ষা চিন্তাবিদগণ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আধুনিকভাবে ভাবতে শুরু করেন। যেখানে গতানুগতিক শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক চিন্তাধারা অর্থাৎ শিক্ষা ভাবনার প্রধান বৈশিষ্ট্য শিশু কেন্দ্রিকতা যেখানে শিশুরাই সর্বাধিক গুরুত্ব পাবে। তাদের চাহিদা, সামর্থ্য, আগ্রহ, পছন্দ ও অপছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থাকে অধিকতর বিজ্ঞানসম্মত করে তোলার ওপরে নজর দেওয়া হয়।
এই বিষয়ে অন্যতম পদক্ষেপ গ্রহণকারী হলেন ফরাসি চিন্তাবিদ রুশো। তিনি তার এমিল উপন্যাসে কাল্পনিক শিশু এমিল-এর শিক্ষাকে কেন্দ্র করে স্পষ্টভাবে তার শিক্ষা দর্শন ব্যক্ত করেন। তার মতে, ‘শিশুর প্রকৃতি অনুযায়ী শিক্ষাই হলো আদর্শ ও সার্থক শিক্ষা। শিশুর জীবনের প্রথম ও প্রধান শিক্ষক হলো প্রকৃতি। প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে শিশু যথার্থ শিক্ষা লাভ করতে পারে।’
শিক্ষা নিয়ে রুশোর চিন্তাধারা শিক্ষাক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করে। তৎকালীন সময়ে এই পরিবর্তনের অগ্রপথিকদের মধ্যে পেস্তালৎসি অন্যতম। যিনি শিশুদের সমস্যা অনুভব করেছিলেন। তিনি রুশোর এমিল-এর আদর্শে নিজের সন্তানের শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, নিজে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেন এবং শিক্ষা বিষয়ে কয়েকটি বই লেখেন। যেগুলোতে তিনি শিক্ষাকে সামাজিক উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন যেখানে; শিশুর দৈহিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশের পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজেও কল্যাণকর সংস্কার ও পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা বলেন।
শিশুর ব্যক্তিত্বের স্বাভাবিক বিকাশ প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ। পেস্তালৎসির মতে, ‘আদর্শ শিক্ষা হলো শিশুর সব শক্তির স্বাভাবিক প্রগতিশীল ও সুষম বিকাশ। শুধুমাত্র বই পড়ে বা তথ্য আহরণে এই শিক্ষাসম্পন্ন হতে পারে না।’অষ্টাদশ শতকের আগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া নিয়ে বিশিষ্টজনেরা বিভিন্ন শিক্ষা চিন্তার ওপর কাজ করে চলছেন। তাদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে উঠেছে বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক হচ্ছে শ্রেণিকক্ষ এবং শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদান পদ্ধতি। যেহেতু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে মেলবন্ধন হিসেবে কাজ করে শ্রেণিকক্ষ তথা বিদ্যালয় ফলশ্রুতিতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিক ও কার্যকর শিখন নিশ্চিতকল্পে সংশ্লিষ্ট পাঠে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষকই অন্যতম মুখ্য ভূমিকা রাখেন।
তবে বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখা আধুনিক বিশ্বের অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ যা থেকে উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন সবার আগে। এবারে আসা যাক, বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য কিছু কারণ।
যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিবারের সব সদস্যের অধিক ব্যস্ততা, সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা বা নির্দিষ্ট কাজের রুটিন না থাকা, কাজের মধ্যে হঠাৎ দিবাস্বপ্নে বুঁদ হয়ে যাওয়া, নিজের কাজকে অপছন্দ করা তথা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগা, পড়ার বা কাজের উপযুক্ত পরিবেশ না থাকা।
রাতে পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া। যার কারণে সারাদিন ক্লান্তি আর ঝিমুনি ভাব থাকে। পুষ্টিকর খাবার না খাওয়া কিংবা ফাস্টফুড বেশি খাওয়া; যা শরীরে অবসাদ তৈরি করে। খেলাধুলা বা শারীরিক ব্যায়াম না করা এতে মানসিক প্রশান্তি বিঘ্নিত হয়। শিক্ষাবিদদের বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল ও সুপারিশের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য নিম্নোক্ত কাজগুলো মেনে চলা যেতে পারে।
বিদ্যালয় ও শ্রেণিকক্ষের পরিবেশ : একটি শ্রেণিকক্ষের গঠনগত বিন্যাস সঠিক না হলে তার কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাদান এবং জ্ঞানার্জন ও বিতরণের ওপর পারে। শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্ধকার বা নোংরা ক্লাসরুম শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোট পরিবেশ শিক্ষার্থীদের মাঝে অস্থিরতা তৈরি করে। ফলে তারা অমনোযোগী হয়ে পড়ে। তাই শ্রেণিকক্ষের মেঝে, জানালা, দেয়াল, চকবোর্ড, আসবাবপত্রসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী করে সাজানো দরকার। একই সঙ্গে বসার পদ্ধতির সঙ্গে মনোযোগ ধরে রাখতে পারা না পারার একটি সম্পর্ক রয়েছে। অনেকটা সময় মনোযোগ ধরে রাখতে গেলে কষ্ট করে বসে থেকে তা সম্ভব হয় না। তাই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সঠিক পদ্ধতিতে বা আরামদায়ক বসার স্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
আই কন্টাক্ট ও শ্রেণিকক্ষে মুভমেন্ট : পড়ানোর সময় মাঝে মাঝে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আই কন্টাক্ট রাখার চেষ্টা করা সেই সাথে শ্রেণিকক্ষের সামনের দিকে না দাঁড়িয়ে থেকে একটু হাঁটাচলা করা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় তাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে তাদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে বক্তৃতা দেওয়ার সময় সঠিক বাচন ও অঙ্গভঙ্গি মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
তবে অবশ্যই ক্লাসে পাঠদানের সময় এমন কোনো দৃষ্টিকটূ বা আপত্তিকর বাচন ও অঙ্গভঙ্গি করা উচিত হবে না। বোর্ডে পড়ার বিষয়বস্তু লিখে রাখা যা একটু দেরিতে আসা বা অমনোযোগী কোনো শিক্ষার্থীর মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে ওষুধের মতো কাজ করে।
উদাহরণ সহকারে পড়ানো : কী পড়াচ্ছেন তা শিক্ষার্থীদের মাঝে সঠিকভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বাস্তব উদাহরণের কোনো বিকল্প নেই। উদাহরণের মাধ্যমে পড়ানো হলে শিক্ষার্থীরা পড়ানোর বিষয়বস্তু সহজে বুঝতে পারবে। ফলে তাদের মনোযোগও পাঠে কেন্দ্রীভূত হবে। সহজবোধ্য ভাষায় বোধগম্য উদাহরণের মাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপন করা উচিত। জটিল ভাষায় বোঝালে শিক্ষার্থীদের ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং বিষয়টি জটিল হওয়ার কারণে তাদের মনোযোগও নষ্ট হতে পারে। শিক্ষার্থীদের প্রচুর প্রশ্ন করার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যত বেশি প্রশ্ন করবে তত বেশি শিখবে এবং প্রশ্ন করার জন্য তাদের শিক্ষকের বক্তব্য শুনতে হবে। ফলে তারা পাঠে আরও মনোযোগী হয়ে উঠবে।
অংশগ্রহণমূলক আধুনিক পদ্ধতির ও আইসিটির ব্যবহার : শিক্ষক যদি ক্লাসে এসে গতানুগতিক ধারায় বক্তৃতা দিয়ে চলে যান, তাহলে পড়াশোনা আর মজার থাকে না। বর্তমান সময়ে সারাবিশ্বে অংশগ্রহণমূলক পড়াশোনার পদ্ধতিটিই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। শিক্ষার্থীদের যদি ক্লাসেই একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করার মাধ্যমে নোট তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়, তবে তারা আর অমনোযোগী হয়ে বসে থাকতে পারবে না। এতে শক্তিশালী হবে একের সঙ্গে অন্যের যোগাযোগ ও পারস্পরিক সহায়তার বিষয়টিও।
মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে বিজ্ঞান, গণিত বা ইতিহাসের নানা চিত্র বা ভিডিও ক্লাসে দেখালে শিক্ষার্থীরা বেশি তথ্য মাথায় রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রজেক্টর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করানো যেতে পারে। গৎবাঁধা একই নিয়মে না পড়িয়ে বিভিন্ন কৌশলে পড়ালে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে।
শিক্ষার্থীদের প্রশংসা ও হতাশাজনক কথা না বলা : শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে তাকে নিরুৎসাহিত না করা বা তার যদি কোনো বিশেষ গুণ থেকে থাকে তবে তা নিয়ে প্রশংসা করা উচিত। এতে করে তারা অনুপ্রাণিত হবে এবং শিক্ষকের বলা যেকোনো কথায় মনোযোগ দিয়ে শুনবে। নিজের ব্যক্তিগত হতাশার কথা বা শিক্ষার্থীদের নিয়ে কোনো কারণে হতাশায় পড়ে গেলেও সেটা তাদের কাছে প্রকাশ করা উচিত নয়। বরাবরই তাদের আশার কথা শোনাতে হবে; স্বপ্ন দেখাতে হবে সুদূর ভবিষ্যতের। তাদের কখনোই বলা উচিত না তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না। তারা একবার না বুঝলে ধৈর্য ধরে বারবার বুঝাতে হবে। তবেই তারা জীবনের প্রতি মনোযোগী হবে, শ্রেণিকক্ষেও মনোযোগ বাড়বে।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং শিক্ষক শিক্ষার মেরুদণ্ড। দার্শনিক প্লেটোর মতে, ‘শিক্ষক হবেন ভাববাদী চিন্তার প্রত্যক্ষ ফসল, শিক্ষার মাধ্যমে তিনি শিক্ষার্থীর ব্যক্তিত্বকে বিকশিত করবেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হলো শিক্ষকের দায়িত্ব।’ এভাবেই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মাঝে ভয়-ভীতিহীন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে তাদের উন্নত জীবনের স্বপ্নদর্শনে তথা বাংলাদেশের আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হতে উদ্বুদ্ধ করবেন।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য