দীর্ঘ ৫৩ বছর পরে বাংলাদেশের সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। ২০২৪ সালে আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানের পরে এটি অপরিহার্য হিসেবে সবার সামনে দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো, রাজনৈতিক দলগুলোর অপরিসীম ক্ষমতা, আমলাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রয়োগ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের সীমিত অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাই এখানে প্রথমে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকে সীমিত করা এবং ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থায় আনা দরকার। এর জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে-
রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকে সীমিতকরণ:
১. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পরপর দুবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। এতে তাদের দীর্ঘদিন একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগের সুযোগ থাকবে না।২. একই পরিবারের দুই জন একসাথে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন না। তাহলে তা আরেক সংকট তৈরি করবে এবং দেশে ক্ষমতার ভারসাম্য নষ্ট করবে।৩. একই সঙ্গে দলের এবং রাষ্ট্রের বা সরকারের প্রধান থাকতে পারবেন না। তাতে প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা একজনের হাতে চলে যাওয়া বন্ধ করা যাবে।৪. সংসদের মেয়াদ চার বছর হবে। কোনও অবস্থায় ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য দীর্ঘ সময় যেন না পাওয়া যায় সে ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ একবার নির্বাচিত হয়ে গেলে যেন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে না পারে।৫. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ হবে। সেখানে একটি থাকবে উচ্চকক্ষ এবং অপরটি থাকবে নিম্নকক্ষ। নিম্নকক্ষে থাকবে ৩০০ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ। সেখানে ৬৪ জেলা থেকে থাকবে আরও ৬৪ নারী সংসদ সদস্য। তারাও সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। অথবা বিকল্প হিসেবে প্রতিনিধিত্বমূলক ভোটের মাধ্যমে সব সদস্য নির্বাচিত হবেন। সব দল থেকে প্রাপ্ত প্রতিনিধিত্বমূলক ভোটের মাধ্যমে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন।৬. ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার জন্য দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রয়োজন অনুযায়ী দুই কক্ষেই আলাদা স্পিকার থাকবে এবং উচ্চকক্ষ ওয়াচ ডগ হিসেবে কাজ করবে। সংসদের উচ্চকক্ষ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে করা হবে, যার সদস্য সংখ্যা হবে ২০০। তারা প্রতি এক বছর পর পর ২০ শতাংশ করে পরিবর্তন হবেন। এখানে সদস্য হবেন দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সামরিক এবং বেসামরিক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।৭. সংসদ সদস্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে আদালত অথবা ফৌজদারি মামলা থাকলে বিশেষ করে ঋণখেলাপি, বিলখেলালি, নারী-শিশু নির্যাতনকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, অর্থপাচারকারী ইত্যাদি অভিযোগ থাকলে তাকে কখনও সংসদ সদস্য করা যাবে না। বিদেশি নাগরিকত্ব থাকলে তাকে কোনোভাবে সংসদ সদস্য বা মন্ত্রী করা যাবে না।৮. সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন ছাড়া অন্য কোনো উন্নয়ন কাজে জড়িত হতে পারবেন না এবং মন্ত্রী ছাড়া অন্য কোনও পদ গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে কেউ চাইলে তার ব্যক্তিগত টাকায় উন্নয়ন কাজ করতে পারবেন এবং তার পরিবারের কোনও সদস্য সেই কাজের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন না।৯. মন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সংসদীয় কমিটির/সংসদ সদস্যদের বা উচ্চকক্ষের সদস্যদের সামনে প্রার্থীর সামর্থ্যরে কথা তুলে ধরবেন এবং সংসদীয় কমিটির/ উচ্চকক্ষের মনোনয়ন পেলে কেবল তারা মন্ত্রী হতে পারবেন। প্রতি বছর তাদের সাফল্যের বিষয়ে সংসদীয় কমিটি বা উচ্চকক্ষের সামনে ব্যাখ্যা দেবেন এবং তারপর দ্বিতীয়বার সমর্থন পেলে কেবল তিনি মন্ত্রী হিসেবে নিজের দায়িত্ব চালিয়ে যেতে পারবেন। এভাবে প্রতি বছর একজন মন্ত্রীকে অনুমোদন নিতে হবে।১০. প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের রেজিস্ট্রেশন নিয়ে রাজনীতি করতে হবে। তারা প্রতি বছর তাদের দলের আয়-ব্যয়ের হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। তাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সব সদস্যের বার্ষিক সম্পদবিবরণীও সঙ্গে জমা দিতে হবে।১১. প্রতিটি রাজনৈতিক দলে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ মহিলা সদস্য থাকবেন এবং অফিস বেয়ারার মধ্যে ৩০ শতাংশ মহিলা থাকতে হবে।১২. সব সংসদ সদস্যকে সম্পদের দায়মুক্তি নিতে হবে। সংসদ সদস্যপদ শেষ হবার পর প্রত্যেকে নিজ নিজ দায়মুক্তি নেবেন।১৩. রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। সবার নিজ নিজ ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করা এবং অন্য ধর্মীয় লোকদের ধর্ম পালনে বাধা দেওয়া যাবে না।১৪. একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।১৫. রাষ্ট্রের জরুরি পরিস্থিতিতে সব দলের পরামর্শ গ্রহণ করবে সরকার।১৬. রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শন হবে ‘ওয়ান বাংলাদেশ থেকে নম্বর ওয়ান বাংলাদেশ’। যেখানে এক অপরের পাশে থাকবে এবং সবাই মিলে ‘নম্বর ওয়ান বাংলাদেশ’ তৈরি করবে। সব দ্বন্দ্ব-সংঘাত ত্যাগ করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে হবে।১৭. নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য ক্ষুদ্র আকারের একটি মন্ত্রিসভা নিয়ে তা পরিচালনা করতে হবে। কোনও দল থেকে যারা ভোটে অংশগ্রহণ করবেন না তারা এ সরকারে যোগ্যতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।১৮. বিচার বিভাগকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাদের নিয়োগের একটি নীতিমালা থাকবে। দেশে সব মামলা দায়েরের ছয় মাসের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করতে হবে। কোনও মামলাজট তৈরি করা যাবে না। পুরোনো মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে হবে।১৯. আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ব্যতীত অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ থাকবে। তাই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার প্রয়োজন হলে তা করা হবে।২০. রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত এবং বিশিষ্টজনের অভিমতের ভিত্তিতে স্বাধীন, দক্ষ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও দৃঢ়চিত্ত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কার্যকর নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সব কেন্দ্রে পেপার-ব্যালটের মাধ্যমে বা অন্য কোনও গ্রহণযোগ্য উপায়ে ভোট প্রদান নিশ্চিত করা হবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার বাতিল করা হবে।২১. সংকীর্ণ রাজনৈতিক দলীয়করণের ঊর্ধ্বে সব রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শুনানির মাধ্যমে সংসদীয় কমিটির ভোটিং সাপেক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব পদে নিয়োগের আগে তাদের নাম গণমাধ্যমে জনগণের মতামতের জন্য প্রকাশ করা হবে।২২. ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ - এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবে। কারও ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ করা যাবে না।২৩. বিচার বিভাগের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে, যাতে অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের কর্তৃত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি পৃথক সচিবালয় থাকবে।২৪. বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তা আলাদাভাবে যাচাইয়ের মাধ্যমে করা হবে। বিচারপতি অবসরে যাওয়ার পর তাকে একটি এনওসি গ্রহণ করতে হবে; যাতে তিনি কোনো দুর্নীতি বা অনিয়ম করেননি মর্মে প্রত্যয়ন করা হবে। এটি তদন্তপূর্বক তিন মাসের মধ্যে প্রদান করা হবে।২৫. সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অভিশংসন প্রশ্নে সংবিধানে বর্ণিত সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের লক্ষ্যে সংবিধানের ৯৫(গ) অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন করা হবে।
আমলাদের ক্ষমতা সীমিতকরণ :
২৬. রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দর্শন হবে ‘শাসক নয় সেবক’। এখানে সব সরকারি কর্মচারী জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে। কাউকে এর ব্যতিক্রম পাওয়া গেলে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। কোনও সরকারি কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী হবে না; বরং প্রতি তিন বছর বা পাঁচ বছর পরপর তা পর্যালোচনা করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বর্ধিত করা হবে।২৭. সব সরকারি কর্মচারীর ক্ষেত্রে দায়মুক্তি নিতে হবে। এটি ছাড়া কারও কোনও পেনশন চূড়ান্ত করা যাবে না।২৮. রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা কমলে আমলাদের ক্ষমতা কমবে কিনা? অবশ্যই আমলাদের ক্ষমতা কমবে, কারণ তখন রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চেয়ে বেশি ক্ষমতাধর আমলাদের দেখতে চাইবে না। আর রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা কমলে অপরাজনীতির সুযোগ কমে যাবে। আস্তে আস্তে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে বিতাড়িত হবে।
দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ :
২৯. সব মানুষের মতামত এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করতে হবে। প্রয়োজনে কোনও বিষয়ে সরকার চাইলে গণভোট পরিচালনা করতে পারবে।৩০. কোনও প্রতিষ্ঠানের নাম যদি কারও নামে করতে হয়, তবে তা সে ব্যক্তি মারা যাওয়ার কমপক্ষে ২৫ বছর পর করা যাবে। তবে তার নিজস্ব টাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না।
লেখক : বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ; চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল রিসার্চ (বিআইএসআর) ট্রাস্ট
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য