জন্ম নিলে মরতে হবে - এটাই তো স্বাভাবিক। এটা সব প্রাণীর জন্যই প্রযোজ্য। প্রতিদিন মানুষ জন্ম নিচ্ছে; প্রতিদিনই মরছে। ক্ষণে ক্ষণে জন্ম-মৃত্যু হচ্ছে। তবে কিছু মৃত্যু মানুষকে নাড়া দেয়। বিশেষ করে নৃশংস মৃত্যু বা শিশু-বয়স্ক মানুষের হৃদয়ে বেশি দাগ কাটে। এমনই একটি মৃত্যু হলো ছয় বছরের শিশু শ্রেষ্ঠার। মুখে কীটনাশক দেওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে ১৪ ডিসেম্বর গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হয়তো ভাবছেন - অযথা কেন পাগলের প্রলাপ বকছি। তাহলে একটু খোলাসা করে বলি। শিশু শ্রেষ্ঠার যে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে। একই কারণে মারা গেছে তার মা মাধুরী বিশ্বাস। খুলনার এই নারী ও তার মেয়েকে বিষ খাইয়েছেন মাধুরীর পরকীয়া প্রেমিক বিধান দাস। ২৪ বছর বয়সী পটুয়াখালীর এই ছেলের সঙ্গে মাধুরীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। পরে যা ঘটলো, তা ইতিহাস বটে।
ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের ৪ নম্বর গেটের সামনে ৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী এক নারী। পাশে পড়ে ছিল তার ছয় বছর বয়সী মেয়ে। স্থানীয় এক ব্যক্তি দুজনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। সেই রাতেই ওই নারীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। কোতোয়ালি থানা-পুলিশের এক কর্মকর্তা ঢাকা মেডিকেলে এসে ওই নারীর মরদেহের সুরতহাল করেন। চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, বিষক্রিয়ায় ওই নারীর মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নারীর পরিচয় জানত না পুলিশ। পরে তার আঙুলের ছাপ নিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বের করে নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়। মারা যাওয়া নারীর নাম মাধুরী বিশ্বাস। তার বাবার বাড়ি বাগেরহাট। এরপর কোতোয়ালি থানা-পুলিশ ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের ঘটনা জানায়। পরে মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার ঢাকায় এসে স্ত্রীর মরদেহ নিয়ে গ্রামে চলে যান। একই সঙ্গে মুমূর্ষু কন্যা শ্রেষ্ঠাকেও নিয়ে যান তিনি। মায়ের মৃত্যুর ৯ দিন পর ১৪ ডিসেম্বর মেয়েটি গোপালগঞ্জ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তারও মৃত্যু হয় বিষক্রিয়ায়। কীভাবে মা-মেয়ের এই পরিণতি হলো, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিতে পারছিলেন না পরিবারের সদস্যরা। মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার পুলিশকে জানান, বাগেরহাটে চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে গত ২৮ নভেম্বর খুলনার তেরখাদা উপজেলার কামাররোল গ্রামে তাদের বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে বের হয়েছিলেন মাধুরী। রাতে তাদের বাসায় ফিরে আসার কথা ছিল। কিন্তু মা ও মেয়ে ফিরে না আসায় মাধুরীর মোবাইল ফোনে কল দিলে তা তিনি বন্ধ পান। এরপর স্ত্রী-সন্তানের সন্ধান পেয়েছেন মাধুরীর মৃত্যুর খবরে। তদন্তে পুলিশ মাধুরীর মুঠোফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ড (সিডিআর) বিশ্লেষণ করে বিধান দাসের (২৪) সন্ধান পায়। ঢাকার কোতোয়ালি থানার ওসি মোহাম্মদ ইয়াসিন শিকদার বলেন, মুঠোফোনে পটুয়াখালীর ছেলে বিধান দাশের সঙ্গে মাধুরীর পরিচয় হয়। এরপর তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে ওই দিন মেয়েকে নিয়ে বরিশালে চলে যান মাধুরী। একসঙ্গে কয়েক দিন কাটানোর পর ৪ ডিসেম্বর তারা ঢাকায় আসার পর লঞ্চের মধ্যে মা ও মেয়েকে বিষ পান করিয়ে বিধান পালিয়ে যান। দায় স্বীকার করে বিধান দাস ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই দিন বিধানের বিরুদ্ধে বিষপ্রয়োগে স্ত্রী ও মেয়েকে হত্যার অভিযোগে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন মাধুরীর স্বামী পিংকু মজুমদার। বিধানের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর দশমিনা উপজেলার দক্ষিণ দাশপাড়া গ্রামে। তিনি বাল্কহেডে বালু পরিবহনের কাজ করতেন এবং থাকতেন পটুয়াখালীতে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ওসমান গনি বলেন, বাল্কহেডের আরেক কর্মচারীর কাছ থেকে মাধুরীর মুঠোফোন নম্বর পান বিধান দাস। মাস দুয়েক আগে ফোনে তাদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। এরপর নিয়মিত তারা মুঠোফোনে কথা বলতেন। বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে মাধুরী খুলনা থেকে চলে আসেন বরিশালে। পরে বিধান, মাধুরী ও তার মেয়ে বরিশালের একটি হোটেলে ওঠেন। ৪ ডিসেম্বর তারা ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। হোটেলে অবস্থান করার সময় মাধুরী বিধানকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। এতে ক্ষিপ্ত হন বিধান। এ জন্য হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। ৪ ডিসেম্বর লঞ্চে ওঠার আগে বরিশালের একটি দোকান থেকে কীটনাশক কেনেন। লঞ্চে মধ্যরাতে বিধান মাধুরী ও তার মেয়ে শ্রেষ্ঠার মুখে বিষ ঢেলে দেন। এরপর অচেতন হয়ে পড়লে তাদের সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে রেখে পালিয়ে যান তিনি। এ বিষয়ে বিধান দাশের পক্ষ থেকে আদালতের কাছে দাবি করা হয়েছে।
এমন পরিণতি আরও অনেক মানুষের হচ্ছে। সংসার ভাঙছে অনেক মানুষের। ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২’ নামের জরিপ বলছে, তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের দুই ধরনের হার পাওয়া পায়। একটি হলো স্থুল, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিবাহবিচ্ছেদের হার। আর অন্যটি সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার; যেখানে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হিসাব করা হয়।
বিবিএসের হিসাবে, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থুলবিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪-এ দাঁড়ায়। সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হারটি হিসাব করা হয়েছে নারী ও পুরুষ আলাদাভাবে। দেখা যায়, ২০২১ সালে নারীদের সাধারণ বিবাহবিচ্ছেদের হার ছিল ২-এর সামান্য কম। সেটা পরের বছর বেড়ে ৩ দশমিক ৬-এ দাঁড়ায়। একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রে হারটি ২০২১ সালে ছিল ২-এর সামান্য বেশি। পরের বছর তা বেড়ে ৩ দশমিক ৮-এ দাঁড়ায়।
বিবিএস বলছে, বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩ শতাংশ এ কারণ সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা - ২২ শতাংশ। এছাড়াও রয়েছে ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা ইত্যাদি। বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কারণে সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ঢাকা বিভাগে, কম ময়মনসিংহ বিভাগে। দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতায় বিবাহবিচ্ছেদ বেশি বরিশালে, কম সিলেটে। ভরণপোষণ দিতে অসমর্থতার কারণে বিবাহবিচ্ছেদ বেশি রাজশাহীতে, কম চট্টগ্রামে।
ইসলাম ধর্ম বলছে, বিয়ে জীবনের পবিত্র এক অনুষঙ্গ। বিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক। আল্লাহ তাআলাই পৃথিবীতে জোড়া মিলিয়ে পাঠিয়েছেন। বিয়ের পরও শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ জড়িয়ে পড়ে পরকীয়ায়। ইসলামে পরকীয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এর শাস্তিও ভয়াবহ।
কিন্তু এই রোগের কী কোনো ওষুধ আছে?
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য