বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতেই হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক
বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতেই হবে

শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকাল নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত। এর মধ্যে অন্যতম ছিল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। এই দুই বিষয় নিয়ে দেশে যেমন অসন্তোষ ছিল; তেমনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল ক্ষোভ ও নিন্দা। এসব বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা নিয়মিত বিবৃতি দিয়েছে। যদিও সরকার এটাকে পাত্তা দেয়নি। তবে র‌্যারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় সব বাহিনীর কানে পানে যায়। এরপর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয় গত ৫ আগস্ট। ছাত্র-জনতার অভ্যুস্থানে প্রধানমন্ত্রী ভারতে চলে যান। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই পটপরিবর্তনের পরও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেছে দেশের দুটি মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন। আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক) বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত প্রায় পাঁচ মাসেও অন্তত ১২ জন বিভিন্ন সরকারি বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন এবং ‘বিচার বহির্ভূত হত্যার’ শিকার হয়েছেন। এই পাঁচ মাসে ৯৮ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ এসেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিবেদনে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে এলেও তা ‘বন্ধ হয়নি’। অভিযোগগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচারও ‘নিশ্চিত করা যায়নি’। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে ২১ জনের। এর মধ্যে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর। এমএসএফএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে অগাস্টে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ছয়জন।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিচারকের ওপর ডিম নিক্ষেপ, চায়ের দাওয়াত দিয়ে ১২ বিচারককে ছুটিতে পাঠানোর মতো ‘নজিরবিহীন’ সব ঘটনা ঘটেছে। যশোরে একটি মামলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীসহ ১৬৭ জন হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়। এমনকি যে আইনজীবী তাদের আদালতে হাজির করলেন, রাতের বেলায় ওই আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ধরনের নজির বাংলাদেশে আগে কখনো ছিল না।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বছর দেশের বিভিন্ন কারাগারে অসুস্থতাসহ বিভিন্ন কারণে মারা গেছেন ৬৫ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৩ এবং হাজতি ৪২ জন। ২০২৩ সালে কারা হেফাজতে মারা যান ১০৬ জন। তবে বগুড়া কারাগারে পরপর চারজন আওয়ামী লীগ নেতার ‘কথিত হৃদরোগে’ মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করছে এই মানবাধিকার সংস্থা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ নভেম্বর থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯ দিনে বগুড়া কারাগারে বন্দি থাকা চারজন আওয়ামী লীগ নেতা কথিত ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’ হয়ে মারা গেছেন। এর মধ্যে গত ২৬ নভেম্বর বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শাহাদত আলম ওরফে ঝুনু (৫৭) কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান। ঠিক একদিন আগে ২৫ নভেম্বর মারা যান শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের কোষাধক্ষ আবদুল লতিফ (৬৭)। ১১ নভেম্বর কারাবন্দি অবস্থায় মারা যান বগুড়া পৌরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম ওরফে রতন (৫৮)। ৯ ডিসেম্বর গাবতলী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও দুর্গাহাটা ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল মতিন ওরফে মিঠু (৬৫) মারা যান। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় তথাকথিত ‘মব জাস্টিসের নামে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাগুলো ছিল উদ্বেগজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি সমালোচনার ঝড় তোলে। চলমান পরিস্থিতিতে পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিজের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ও কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। ২০২৪ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ১৪৬ জন। এর মধ্যে ৯৮ জন নিহত হয়েছেন আগস্ট পরবর্তী পাঁচ মাসে। বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য