জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতেই হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক
জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলতেই হবে

এবার খ্রিস্টীয় নববর্ষের সূচনা পুরোপুরি আলাদা। আর ১০টা নববর্ষের সঙ্গে এর মিল নেই। বহুদিনের জমাট ক্ষোভ কাটিয়ে আমরা নতুন এক দিনের উদ্দেশে যাত্রা করেছি। বহু বিভাজন রেখা ঘুচিয়ে আমরা এক অবিস্মরণীয় জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছুতে চাচ্ছি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার সম্মিলনে যে ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে; তার পরিণতিতে জাতি এখন এক কার্যকরী জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। যদিও এই ঐক্যের পথ কীভাবে-কোন পথে হবে তা নিয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন।

গত ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেবে বলে ডাক দিয়েছিল। এ নিয়ে এক সপ্তাহ ধরেই নানা আলোচনা চলেছে। চলেছে ব্যাপক প্রস্তুতি। শেষ মুহূর্তে ঘোষণাপত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে তাও বাতিল হয়েছে, পরিশেষে সমাবেশ হলেও ঘোষণাপত্র আর দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত গত সোমবার মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে, ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ প্রকাশ নয়, গত মঙ্গলবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হয়ে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি পালন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। পুরো বিষয়টিই একটি হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত আমরা দেখলাম ঐক্যের ডাকেও নানারকম বিভাজন ও ধোঁয়াশা। বলা হয়েছিল, ‘প্রোক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক’ ঘোষণায় মুজিববাদের কবর রচনা হবে।

‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ পাঠ বা ঘোষণা বা উপস্থাপনের কর্মসূচি নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা বা আলোচনার জন্ম দেয়। সরকার একবার বলে এ কর্মসূচির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই; আরেকবার বলে, সরকার থেকেই জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। নাগরিক সমাজও বুঝে উঠতে পারছিল না কী হবে সেদিন। সংবিধান বাতিলের ঘোষণা দেওয়া হবে? নাকি নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসবে? তাহলে কি সরকারের মধ্যে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা উপদেষ্টারা পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন?

শেষ পর্যন্ত ৩১ ডিসেম্বর বিকেলে শহীদ মিনারে যে সমাবেশ হয়েছে তা প্রত্যাশিত লোকসংখ্যার চেয়ে অনেক কম উপস্থিতিতে এবং ৩ আগস্ট সমাবেশে যে স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা গিয়েছিল সেটাও ছিল না। নারীর সংখ্যা ছিল অনেক কম। অবস্থা পরিদর্শন করে এটাই মনে হয়েছে, এ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এটিকে একটি ‘শোডাউন’ মনে হয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি যে রাজনৈতিক শক্তি আকারে হাজির হতে যাচ্ছে, তারই একটি প্রতিধ্বনি পাওয়া গেছে এ কর্মসূচিতে। সর্বস্তরের মানুষ ও সব রাজনৈতিক দলের কোনো ঐক্যের তৎপরতা এর মধ্যে ছিল না।

তাহলে ঐক্যের পথ কীভাবে তৈরি হবে? সিপিডির সম্মানীয় ফেলে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এক লেখায় লিখেছেন, ২০২৫ সালে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের জায়গা হলো সংস্কার এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তার পক্ষে ন্যূনতম কার্যকরী জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা। দেশের নাগরিক সমাজেরও সেটাই দাবি। আমরাও চাই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হোক। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে ঐক্যের পথ ততই দুরূহ মনে হচ্ছে। কেন যেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন রেখাই ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা চাই এই বিভাজন রেখা ঘুচিয়ে নতুন বছরে একটি কার্যকরী জাতীয় ঐকমত্য সৃষ্টি হোক, যাতে করে বাংলাদেশ সামনের দিকেই এগিয়ে যায়, আবার যেন পেছনে ফিরে না যায়। মনে রাখতে হবে বহু প্রাণের বিনিময়ে ৫ আগস্ট অভুত্থান হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তার শাসনামলে মূলত একটা বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল। সেই বিভাজন থেকে বের হয়ে আসার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগটা যেন হাতছাড়া না হয়ে যায়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য