সবজির দাম, কুটিল রাজনীতি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

চিররঞ্জন সরকার
সবজির দাম, কুটিল রাজনীতি ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

ফুলকপি অত্যন্ত উপাদেয় একটি শীতের সবজি। একটি ফুলকপি ফলাতে অনেক যত্ন, ত্যাগ, শ্রম লাগে। অনেক বিনিয়োগও লাগে। আমাদের হাতে এসে যখন এই ফুলকপি পৌঁছায় তখন এর পেছনে থাকে বহুজনের শ্রম-ঘাম। এই জিনিস আমরা সব সময় সস্তায় কিনতে চাই। কিন্তু একবারও ভাবি না, যারা এই ফুলকপিটি ফলাতে শ্রম-ঘাম দিয়েছেন, তাদের কথা!

ফুলকপির বাম্পার ফলন হয়েছে এ বছর। চাহিদার তুলনায় ফলন বেশি হওয়ায় দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। উৎপাদিত সবজির কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছেন বিভিন্ন জেলার চাষি। ফুলকপি বিক্রি করে পরিবহন ও শ্রমিক খরচের টাকাও উঠছে না। ক্রেতা কম থাকায় বেশিরভাগ সবজিই নষ্ট হচ্ছে জমিতে। অনেকে রাগে-ক্ষোভে ক্ষেতেই সবজি নষ্ট করে ফেলছেন। মেহেরপুর, মানিকগঞ্জ, বগুড়াসহ বেশ কয়েকটি জেলায় চাষিরা জমিতে ফুলকপি নষ্ট করছেন, এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। একটি জনপ্রিয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, বগুড়ার এক কৃষক ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, চড়া দামে সার, বীজ, কীটনাশক কিনে তারা সবজি চাষ করেছেন। এক কেজি মুলা ও ফুলকপি চাষ করতে খরচ পড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। অথচ দুই সপ্তাহ ধরে শীতকালীন সব সবজির দামে ধস নেমেছে। মুলা ও ফুলকপি মাত্র দুই টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

আমরা পোড় খাওয়া শহুরে নাগরিকরা এখন গণমাধ্যমের কথা খুব একটা বিশ্বাস করি না। কারণ গণমাধ্যম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিলকে তাল বানায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় হাতির খবরও চেপে যায়। ফুলকপি-বিষয়ক খবরও তাই খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি নিজে বাজারে গিয়ে প্রমাণ পেয়েছি যে গণমাধ্যমের খবরই ঠিক! গতকালের অভিজ্ঞতা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ঘরে ফেরার পথে গলির মুখে দেখি একটি ভ্যান ভর্তি তরতাজা ফুলকপি।

আমি ফুলকপির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাম জিজ্ঞেস করলাম। বিক্রেতা বলল, একটা ২০ টাকা, ২টা নিলে ৩০ টাকা। আমি ৩০ টাকা দিয়ে দুটি ফুলকপি কিনলাম। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে গেল। মানিকগঞ্জ থেকে ঢাকার মোহাম্মদপুরে এসেও এ জিনিসের দাম মাত্র ১৫ টাকা! তাহলে যে কষ্ট করে এই কপি ফলিয়েছে, সে কত পেয়েছে? আমাদের দেশে যারা ফসল ফলায়, তারা সব সময়ই কম দাম পায়, ঠকে! তাদের বঞ্চনা আর দীর্ঘশ্বাস দিয়েই তৈরি হয় আমাদের উপাদেয় সব রান্না! অথচ এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ নেই। নেই তেমন কোনো আলাপ-আলোচনা।

ফুলকপি, মুলা, বেগুন ইত্যাদির দাম এত কমে যাওয়ার কারণ কি? এর অনেকগুলো কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হচ্ছে পরিকল্পনার অভাব। দেশে কোন জেলায় কতটুকু সবজির চাহিদা আছে, কতটুকু উৎপাদন করতে হবে, এ ব্যাপারে আমাদের দেশে কোনো পরিসংখ্যান নেই। কৃষকরাও সাত-পাঁচ না ভেবে হুজুগে এসব সবজির আবাদ করেন। সবজি কখন বাজারে আসবে, তখন বাজারে চাহিদা কেমন থাকবে - এসব ব্যাপারে তারা মাথা ঘামান না। ফলে একই রকম সবজি ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা হয়। উৎপাদিত সবজি একসঙ্গে খেত থেকে বাজারে আসে। চাহিদার তুলনায় হাটে সবজির সরবরাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দামে ধস নামে। আর এসব সবজি সংরক্ষণ করা যায় না। পুষ্ট হওয়ার পর খেত থেকে তুলে ফেলার বিকল্প নেই। আর একবার খেত থেকে তুলে ফেললে তা বিক্রি করতেই হবে। না হলে সেটা নষ্ট হবে।

আসলে আমাদের দেশে কোথাও কোনো পরিকল্পনা নেই। সবজি উৎপাদনকারীদের যেমন নেই, রাজনীতিবিদদেরও নেই। তা না হলে সবজি চাষিদের মতো রাজনীতিবিদদেরই বা কেন এমন লোকসানের মুখোমুখি হবে? আওয়ামী লীগের কথাই ধরা যাক। যে দলটি দেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল, যে দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, যে দল একটানা দীর্ঘ ১৫ বছর দেশ শাসন করেছে, সেই দলটিকে কেন ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হবে? কেন দলটির শীর্ষ সব নেতাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হলো বা আত্মগোপন করতে হলো? এটা কি কেবল ষড়যন্ত্র? তাদের অপকর্মের ফল নয়? তারা কি সঠিক ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল?

বাস্তবতা হলো সঠিক নীতি, সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনার অভাবের কারণেই দলটিকে আজ ছন্নছাড়া দশায় পতিত হতে হয়েছে। এর জন্য অন্যরা যতটা দায়ী, তারা নিজেরা অনেক বেশি দায়ী। নিজেদের পাপের ওজনেই তারা ধসে পড়েছে। তাদের পাপ এখনো পুরো জাতিকে তাড়া করে ফিরছে।

পুরো দেশেই একটা হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। জুলাই-অগাস্টের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের পর সবাই ভেবেছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসবে, নির্বাচন হবে, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এসে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ রচনা করবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হলো না- দেশ চলে গেল একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে। যাদের শক্তি-সাহস ও বুদ্ধি জোগাচ্ছে মৌলবাদী শক্তি। রাজনৈতিক পালাবদলের পর আওয়ামী লীগ আমলে কোনঠাসা এবং দীর্ঘ ১৫ বছরে একটি কার্যকর সরকারাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ ছাত্রদল-যুবদল ও বিএনপির লোকজনের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হতে শুরু করেছে মানুষ। রাস্তার টয়লেট থেকে শুরু করে চাঁদাবাজি করার যত সুযোগ আছে, যা ছিল আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের দখলে, নতুন নতুন দখলদাররা সবই দখল করে নিয়েছে। অন্যদিকে দেশটাকে কয়েক মাসেই পাকিস্তানের আদলে ঢেলে-সাজানোর কাজও দেখতে পাচ্ছি আমরা।

মামলা-বাণিজ্য আগেও ছিল, এখন তা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুন, রাহাজানি বাড়ছে বল্গাহীন। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ বলে কিছু নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে দেশ। কেউ আর বলছে না, আওয়াজ উঠা!

সংবাদমাধ্যমে প্রকৃত সংবাদ অনুপস্থিত। উল্টো সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অস্ত্রাগারের লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এই অস্ত্র এখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রশাসনকে তছনছ করে ফেলা হয়েছে। অযোগ্য-অদক্ষদের হাতে গুরুভার দিয়ে পুরো প্রশাসন যন্ত্রকে স্থবির বানিয়ে ফেলা হয়েছে। দোষ থাকুক না থাকুক, রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা খুঁজে অনেক যোগ্য ব্যক্তিকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সব কিছু চলছে পুরনো কায়দায়। কেবল আদেশদাতারাই পরিবর্তিত হয়েছে।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে গেছে। অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিনোদন জগতে চলছে অচলাবস্থা। ধর্মীয় উন্মাদনা বাড়ছে। ধর্মীয় দলগুলোর আষ্ফালন বাড়ছে। প্রতিবেশী দেশকে উসকানি দিয়ে যুদ্ধংদেহী পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি বড় প্রচারণা ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থাকবে না। দেখা গেল ধর্মকে উপজীব্য করে রাজনীতি করা একটি দল বিভিন্ন ক্যাম্পাসে তাদের কমিটি ঘোষণা করছে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে কোনো প্রতিবাদ দেখা গেল না। তারা নিজেরাই রাজনৈতিক দল করার চেষ্টায় লিপ্ত হলেন। সারাদেশ থেকে বাসে করে লোকজন এনে ঢাকায় ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামে একটা কর্মসূচিও তারা পালন করলেন। কিন্তু কোথায় ঐক্য? মানুষ আগেও বিভক্ত ছিল। ‘কিংস পার্টি’ গঠনের চেষ্টা এই দেশে এর আগেও বহুবার হয়েছে। কিন্তু দুয়েকটি কিংস পার্টি পরে বড় রাজনৈতিক দলে পরিণত হলেও কিংস পার্টির অধিকাংশই টেকেনি।

দেশে রাজনৈতিক বিরোধ ক্রমেই বাড়ছে। এই বিরোধের পক্ষও বাড়ছে। এক দিকে বিএনপি নির্বাচনের জন্য ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করছে। ওদিকে জামায়াত অন্তর্বর্তী সরকারের আনুক‚ল্য নিয়ে দেশে প্রভাববলয় বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘দেশে পরীক্ষিত দুটি দেশপ্রেমিক শক্তি আছে, এর একটা সেনাবাহিনী আরেকটা জামায়াতে ইসলামী’ - এমন দুর্নীতি অহঙ্কারী মন্তব্যও করছে দলের শীর্ষ নেতা। জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সদ্ভাব থাকলেও বিএনপির প্রতি উভয় পক্ষই বাক্যবাণ নিক্ষেপ করছে। বিএনপিও একটু একটু করে এই দুই সংগঠনের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে। আগামী দিনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয়, বরং জামায়াত ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ ও সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। কেননা বিএনপি চায় এই মুহূর্তে নির্বাচন। নির্বাচন দেরি হলে তারা ক্ষমতা থেকে মাইনাস হয়ে পড়তে পারে— এই আশঙ্কা রয়েছে। অন্য দিকে জামায়াত চায় নির্বাচনের আগে দল গোছাতে আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চায় দল গড়তে। নির্বাচন যত দেরি হবে, তারা তত সুযোগ পাবে। এই সময়ে আওয়ামী লীগকে ‘নিশ্চিহ্ন করা’র উদ্যোগগুলোও বাস্তবায়নের সুযোগ মিলবে। যদিও রাজনীতি এত সরল অংক নয়।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য