উটপাখি হয়ে কতদিন বাঁচা সম্ভব?

শাহানা হুদা রঞ্জনা
উটপাখি হয়ে কতদিন বাঁচা সম্ভব?

উটপাখির মতো মাথা ঢেকে বেঁচে থাকতে চাই, কিন্তু পারছি না। আশপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা এড়িয়ে চলতে চাইছি, কিন্তু পারছি কই? গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে চোখ রাখলে মানুষের প্রতি মানুষের, পশুপাখির প্রতি মানুষের নিষ্ঠুর আচরণের খবরে চোখ পড়বেই। শুনেছি মন শান্ত রাখার জন্য অনেকে যোগাযোগমাধ্যম এড়িয়ে উটপাখি হয়ে বাঁচতে চাইছেন। অনেক সময় মনে হয় সেটাই ভালো পন্থা।

যেমন রাতে ঘুমানোর আগে দেখলাম সিলেটের গোয়াইনঘাটে গরু চুরির অভিযোগে ৪০ বছর বয়স্ক হেলাল উদ্দীনকে বাজারে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধোর করা হয়েছে এবং চুন-বালুর মিশ্রণ খাওয়ানো হয়েছে। চুন-বালুর মিশ্রণ খেয়ে মানুষটি কিছুক্ষণ পর মারা গেছেন। খবরটা চোখে পড়ার পর থেকেই ভাবছি কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের মানবিকতা? অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই বর্বর শাস্তি দেওয়া হলো কেন মানুষটিকে?

গাজীপুরে রাতভর ডিউটি শেষে ভোরে কারখানা থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই যুবককে ধরে এনে বাঁধা হয় গাছের সঙ্গে। চুরির অভিযোগ তুলে দিনভর রড, বাঁশ, রোল ও কাঠের খাপ দিয়ে ধাপে ধাপে পেটানো হয় তাদের। এরপর তাদের চোখে-মুখে ও সারা গায়ে লবণ ও মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেওয়া হয়। তাদের না পিটিয়ে পুলিশে কেন দিলেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে অভিযুক্ত লিমা বলেন, ‘চারের শাস্তি পেটানো। দেখেন না কোথাও চোর ধরলে গণপিটুনি দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। আমরা তো পিটিয়েছি মাত্র।’ এ ঘটনায় নিরাপত্তাহীনতায় ওই দুই যুবক ফের মারধরের আশঙ্কায় পুলিশের সহযোগিতা নিতেও সাহস পাচ্ছেন না।

কেন নির্দয় হয়ে উঠছি আমরা, এককথায় এর কোনো উত্তর নেই। সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী ও অপরাধবিজ্ঞানীরা নানাভাবে একে দেখছেন। তবে সবার কথার সারমর্ম হচ্ছে, সহিংস হয়ে কোনো শিশু জন্ম নেয় না। মানুষের বেড়ে ওঠার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই উত্তর যে কেন শিশু-কিশোর, তরুণরা সহিংস হচ্ছে? নিউরো-বায়োলজিক্যাল কারণ, মা-বাবার অবহেলা, শারীরিক নির্যাতন, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, টেলিভিশন, চলচ্চিত্রে কিংবা ভিডিও গেমসে ভায়োলেন্স, মাদক ও অস্ত্রের সহজ প্রাপ্যতা, অসামাজিক ব্যক্তি হয়ে বড় হওয়া, সাইকোপ্যাথ, ক্ষমতার লোভ, চাহিদা, লালসা ইত্যাদি কারণ খুব বেশি তাড়িত করে মানুষের মনোজগতকে। সমাজের মানুষ যখন সমাজবিরোধী ব্যক্তি কিংবা সাইকোপ্যাথ হয়ে ওঠে, তখন তারাই নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে। এই অপরাধবোধ তাদের কষ্ট দেয় না। এই যে কষ্ট না পাওয়ার মনোভাবটাই ভয়ঙ্কর। এই মনোভাবই মানুষকে আরো নৃশংস করে তোলে।

অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে আরেকটি বড় কারণ হলো অপরাধের বিচার না হওয়া এবং জবাবদিহি না থাকা। সমাজে এমনসব ভয়ংকর অপরাধ ঘটছে, দেখে মনেহবে যেন সিনেমার কোনো মারামারির দৃশ্য। প্রকাশ্য দিবালোকে শত মানুষের সামনে কোপানো হচ্ছে কাউকে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার পোশাক। আহত ব্যক্তির কণ্ঠে বাঁচার আকুতি। তবু কারও কোনও বিকার নেই। সবাই দেখছেন আর মোবাইলে ভিডিও করছেন এবং বীরদর্পে চলে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। সিসিটিভির ক্যামেরায় ধারণ হওয়া এই দৃশ্য দেখে সমাজ বিস্মিত হচ্ছে, ক্ষোভ প্রকাশ করছে কিন্তু শাস্তি হতে দেখছি না কারো।

অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে এক ধরনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রয়েছে। মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণে অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। অন্যদিকে মানুষের প্রতিবাদের নৈতিক ভিত্তিও নড়বড়ে হয়ে পড়ছে নানা কারণে। মানুষ এখন অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে ভয় পান, তাই চোখের সামনে নৃশংস ঘটনা ঘটলেও তারা ভিডিও করেন, প্রতিবাদ করেন না। এরমধ্যে আমি, আপনি সবাই আছি। আধুনিক সমাজের মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন। কেউ কারও বিপদে এগিয়ে আসেন না। অথচ ৬০ থেকে ৯০ দশকে, ছোট থেকে বড় হতে হতে দেখেছি পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা যেন এক হাত বাড়িয়ে আছেন সহযোগিতা করার জন্য। কারো কোনো বিপদে, কেউ আক্রান্ত হলে আরো পাঁচজন এগিয়ে আসতেন সাহায্য করার জন্য। একটা সুস্থ, সুন্দর সামাজিক জীবনে আমরা বড় হয়েছি। গত ২০-২৫ বছরে একটু একটু করে সেই হাত দূরে সরে গেছে এবং যাচ্ছে। তাই নির্বিচারে অপরাধ বাড়ছে।

এখন ঘর থেকে বের হয়ে যদি দেখি কোথাও পাতা পোড়ানোর কথা বলে পোড়ানো হচ্ছে নারীর খণ্ডিত দেহ, তা-ও আমরা অবাক হচ্ছি না। এরপর দেখা গেল অন্য জায়গা থেকে তার দেহ ও মাথা উদ্ধার করা হলো, সেটাও যেন স্বাভাবিক। সেদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত যুবক বা তার মতো অন্য অপরাধীদের আটক করা হলেও আর কোনো ফলোআপ আমরা জানতে পারি না। কেন, কে, কাকে হত্যা করল, এরচাইতেও বিভীষিকাময় হচ্ছে কীভাবে হত্যা করলো। মনের মধ্যে কেন এত বিষ জমা হয়ে আছে আমাদের? নানা ধরনের অপরাধ করছি আমরা, সেই অপরাধ পাবলিক দেখছে, কেউ কেউ ভয়ে শিহরিত হচ্ছে, কেউবা বোধশূন্যহীন হয়ে দেখছে। অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে অনেকসময় একজনের অপরাধ আরেকজনকে একই ধরনের অপরাধ করতে উৎসাহিত করে। যেমন এর আগে আমরা দেখেছি মানুষ তাদের ক্ষণকালের সুখের জন্য পৃথিবীতে একটি শিশুর জন্ম দেয়। এরপর সমাজের ভয়ে শিশুটিকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করে না। সেদিনও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনের ফুটপাত থেকে একদিন বয়সী এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। দুই-তিনটি কুকুর মরদেহটি নিয়ে টানাহেঁচড়া করছিল। খবরটা পড়ে চোখ বন্ধ করতে পারছিলাম না। শুধু ভেসে উঠছে শিশুটির নিথর দেহ, যেটি নিয়ে টানাটানি করছে তিনটি কুকুর।

ময়মনসিংহে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার কিশোরীটি শেষ পর্যন্ত মারা গেল। সে মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। চার মাস আটকে তাকে ধর্ষণ করেছিল দশম শ্রেণির এক মাদরাসা ছাত্র। একপর্যায়ে চোখ উপড়ে কিশোরীকে তার বাড়ির সামনে রেখে যায়। চার মাস চিকিৎসার পর পরিবার অপেক্ষায় ছিল মেয়েটি সুস্থ হলে আহত চোখে কর্নিয়া স্থাপন করা যাবে। দীর্ঘ দিন যন্ত্রণার পর স¤প্রতি কিশোরীটি মারা যায়। কিশোরীর মায়ের কথাটিও ভুলতে পারছি না যে। তিনি বলেছেন, ‘দমডা যাওনের আগেও আমার ধন আমারে কইছে, আম্মা আমার কাছে তার (অভিযুক্ত) চোখটা আইনা দেও। আমার দম যাওনের আগে দেইখা যাইতাম চাই। আমি এ হত্যার বিচার চাই।’

অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলেন মানুষের মধ্যে পশু প্রবৃত্তি থাকে, সেই প্রবৃত্তিকে সিভিলাইজড বা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় নানা ধরনের নিয়ম-কানুনের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে এখন সেই নিয়ম-কানুন, ভ্যালুজ, আইনের প্রয়োগ সব দুর্বল হয়ে গেছে। সমাজ ক্রমশ অস্থির হয়ে পড়েছে। সমাজের মধ্যে এত বেশি নেগেটিভ এলিমেন্ট ঢুকে গেছে যে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের বড় দায়িত্ব হচ্ছে অপশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা ও অপরাধীর যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করা।

এই যে গত কয়েক বছর ধরে সমাজে কিশোর গ্যাং বাড়ছে এটা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হচ্ছি। কিন্তু সেই অনুযায়ী বাড়েনি কিশোর অপরাধ সেন্টার, কিশোর অপরাধীদের কাউন্সেলিং করানোর মেকানিজম। কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, যৌনতা, মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। শুধু নামেই রয়ে গেছে নিম্নমানের সংশোধনাকেন্দ্র। সেই একই দুর্বল ব্যবস্থা চালু আছে প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের জন্যও। তাই ধরে নিতে হবে একজনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা, দেহ দ্বিখণ্ডিত করা, পুড়িয়ে ফেলা, একজন নারীকে ধর্ষণ করা বা টাকার জন্য বাবা-মাকে মেরে ফেলার ঘটনা সব একই সূত্রে গাঁথা। শুধু অপরাধ ও নৃসংশতার ধরণ ও মাত্রা বদলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে সমাজে দুর্বৃত্তরা থাকবেই কিন্তু মানুষ কেন নিস্পৃহ হয়ে পড়ছেন? কেউ কোন প্রতিবাদ করছেন না, প্রতিরোধেও এগিয়ে আসছেন না। ক্ষমতার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা অপরাধীকে বেপরোয়া করে তুলেছে। আরো দায়ী হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি বিচার প্রক্রিয়া। বিচারে এত সময় ও টাকা লাগে যে অপরাধীরা এমনতেই পার পেয়ে যায়। তাছাড়া দেশে অপরাধের কারণ ও বিচারের ধরণ নিয়ে কোনো গবেষণা হয় না।

আমাদের দেশের মানুষ সবসময় ধর্মের কথা বলেন কিন্তু অনেকেই মানুষ ও পশুপাখির প্রতি নির্দয় আচরণ যে ঘোরতর অন্যায় ও পাপ, তা স্বীকার করতে চান না। মানুষের এমন নির্দয় আচরণকে বুঝাতে গিয়ে আল্লাহ মানব হৃদয়কে পাথরের সঙ্গে তুলনা করেছেন : ‘অতঃপর তোমাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেল পাথরের মতো অথবা তার চেয়েও বেশি।’ (সূরা : বাকারা, আয়াত : ৭৪)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের ওপর আমার পক্ষ থেকে কোনো বিপদ আসে, তারা কেন বিনীত হয়ে কান্না করে না। কিন্তু তাদের অন্তর কঠিন হয়ে গেছে এবং তাদের কৃতকর্মকে তাদের নিকট সুশোভিত করে তুলেছে।’ (সূরা : আনআম, আয়াত : ৪৩)। আল্লামা ইবনে আশুর (রহ.)-এর মতে, আয়াতটি তাদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে, যারা দম্ভের সঙ্গে অপরাধ করে এবং অপরাধ সম্পর্কে জেনেও বিরত থাকে না। (আত-তাহরির ওয়াত তানভির : ৭/২৯৯)।

গত কয়েক বছরে ঢাকাসহ সারাদেশে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে নৃশংসতা। আসলে আমরা খুব দ্রতগতিতে একটি বিশৃঙ্খলাপূর্ণ সমাজের দিকে যাচ্ছি। দায়মুক্তির সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এক্ষেত্রে বড় ভ‚মিকা রাখছে। দেশে ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ খুব কম, তাই মানুষ পুলিশকে জানাতে চায় না বা আদালতে যেতে চায় না। তাই নির্যাতনের ঘটনা চলতেই থাকে।

প্রায় কাছাকাছি সময়ের মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় যতগুলো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এরমধ্যে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন ও নৃশংসতার বিবরণ মানুষকে হতবাক করেছে। সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণে প্রতিশোধ স্পৃহা যেমন বেড়ে গেছে, সেইসাথে বেড়ে গেছে আমাদের মতো নিস্পৃহ মানুষের সংখ্যাও। অপরাধ ও এর বিকৃত চেহারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র কবে এবং কীভাবে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেবে, তা দেখার বিষয়।

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য