বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের ‘বিছড়া হুয়া’ ভাই?

সালেহ উদ্দিন আহমদ
বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের ‘বিছড়া হুয়া’ ভাই?

‘বিছড়া হুয়া’ ভাইয়ের অর্থ কি? হারানো ভাই, বড় ভাই, ছোট ভাই, খুঁজে পাওয়া ভাই - যাই হোক না কেন; বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের ভাই হতে যাবে? গত ২ জানুয়ারি ইসলামাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার বলেছেন কথাটা। ইসহাকের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশ আমাদের হারিয়ে যাওয়া (‘বিছড়া হুয়া’) ভাই। বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব উপায়ে সহযোগিতা করবে পাকিস্তান।’

খবরটা চোখে না পড়লেই ভালো হতো। এটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাগে ক্ষোভে শরীরটা জ্বলে উঠল। যারা একাত্তর দেখেছেন বা একাত্তরের কথা শুনেছেন, তাদের প্রতক্রিয়া কি আমার মতো বা আমার চেয়ে বেশি হয়নি? কলমটা হাতে নিতে হলো যদি ক্ষোভটাকে ভাষা দেওয়া যায়, যদি ভাষা খুঁজে পাওয়া যায়। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের কত মা-বোন ট্রমায়-রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায়-অপমানে বোবা হয়ে গিয়েছিলেন, হারিয়ে ফেলেছিলেন তাদের কথা বলার সামর্থ্য! ওই অত্যাচারীদের নিয়ে বলতে গিয়ে, লেখার মতো ভাষা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়!

আজ যদি আমরা চুপ হয়ে থাকি, আমাদের ওই নির্যাতিত মা-বোনেরা আমাদেরকে ক্ষমা করবেন না। ১৯৭১ সালে গুলির নির্মম করতালিতে আমাদের দেশের যে লাখ লাখ মানুষের পিঞ্জর দুমড়িয়ে হৃদপিণ্ডটা টুকরো টুকরো হয়ে বের হয়ে গিয়েছিল, তারাও আমাদেরকে ক্ষমা করবেন না।

এই কথাগুলো আবেগ নিংড়ে বুক থেকে বের হয়েছে মোহাম্মদ ইসহাক দারের বক্তব্যের কারণে। বারবার মনে প্রশ্ন জেগেছে বাংলাদেশ কেন পাকিস্তানের ভাই হতে যাবে? ইসহাক দার বলতে পারতেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের গোয়াল থেকে ছুটে যাওয়া হারানো গাভী’, তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারতাম আমরা। সত্যি, একাত্তরের আগে বাংলাদেশ ছিল ওদের গোয়াল ঘরে রশি দিয়ে বাধা। তারা প্রতিদিন দুধটা নিয়ে যেত, মাখন ও ঘি বানিয়ে খেত - রশিতে বাঁধা গাভীটা গোয়াল ঘরে শুয়ে শুকনো ঘাস চিবাত। পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ ইসহাক দার হয়তো ওই গাভীটাকে খুঁজে পেয়েছেন, এখন শুধু চেষ্টা হবে যদি রশি দিয়ে বাঁধা যায় আবার।

বাংলাদেশকে গোয়াল ঘরে বেঁধে অর্থনৈতিক বঞ্চনার পাকিস্তানি চক্রান্তগুলো এখনো অনেকের স্মৃতিতে ভাস্বর। অধ্যাপক রেহমান সোবহান তার অনেক লেখায় পরিসংখ্যান দিয়ে এগুলোর বর্ণনা দিয়েছেন পাকিস্তান আমলেই। তিনি ‘ফোরাম’ নামে একটা সাপ্তাহিক সাময়িকী বের করতেন ষাটের দশকের শেষের দিকে, সেখানে থাকত এই বৈষম্যের বিস্তারিত বিবরণ। ২০২২ সালে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রেহমান সোবহান স্মৃতিচারণ করেছেন, ‘অধ্যাপক কবীর চৌধুরী সে সময়ে ব্যুরো অব ন্যাশনাল রিকনস্ট্রাকশন বা বিএনআরের কাজ করতেন। ১৯৫৯ সালের কোনো এক সময় তিনি আমাকে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পর্কে বিএনআরের প্রকাশিতব্য জার্নালে একটা অধ্যায় লিখতে বললেন। প্রকাশনাটির উদ্দেশ্য ছিল সম্ভবত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনব্যবস্থার কৃতিত্ব প্রচার করা। লেখাটির জন্য গবেষণা করতে গিয়ে আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বেশ কিছু প্রমাণ পেয়ে গেলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের নুরুল ইসলাম অথবা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকসহ আরও কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে আলোচনার সুবাদে এ সম্পর্কে আগেও কিছু ধারণা আমার ছিল। বিএনআরের প্রকাশনায় আমার লেখাটিও অন্তর্ভুক্ত হলো। লেখাটিতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্য বিশদভাবে তুলে ধরেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তান সরকার বিষয়টি একদমই পছন্দ করেনি। তাদের হুকুমে আমার লেখা প্রত্যাহার করে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল্লাহ ফারুকের লেখা একটি ইতিবাচক নিবন্ধসহ জার্নালটি আবার নতুন করে ছাপা হয়।

যখন এদেশের জনগণ পাকিস্তানের গোয়ালঘর থেকে রশি কেটে বের হওয়ার জন্য বিদ্রোহ করল, তখন শুরু হলো তাদের গাত্রদাহ। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় লক্ষ লক্ষ প্রাণ নিয়েছে পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী, পুড়িয়ে দিয়েছে হাজার হাজার গ্রামের ঘরবাড়ি, ধর্ষণ করেছে এদেশের মা-বোনকে এবং তাদের আল-শামস ও আল-বদর বাহিনী দিয়ে হত্যা করেছে এদেশের শীর্ষ সন্তানদেরকে। আমরা এখন তাদের ‘বিছড়া হুয়া ভাই’ হতে যাব কেন?

আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পর আমাদের যে কয়টি সরকার এসেছে তারা সবাই নিজেদের ক্ষমতার জন্য স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যে যার মতো করে লিখেছে নিজেদের অবদানকে আলোকিত করতে। সত্যিকার ইতিহাস কখনো লেখা হয়নি। তাই তাদের লেখা ইতিহাস কেউ খুলে দেখেনি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই এখনো অন্ধকারে, হয়তো জানে না এই অন্যায় ও অত্যাচারের বিভীষিকা, হত্যা ও নির্যাতনের নিষ্ঠুরতা এবং ধর্ম ও বিবেক বর্জিত ধর্ষণের ইতিহাস। এই সুযোগে, পাকিস্তানিরা এখন বলে, আমরা তাদের ‘বিছড়া হুয়া ভাই’।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এই আমাকে যেতে হয়েছিল খুলনায়। তখন রূপসা নদীর পাড়ে যা দেখেছিলাম তা কোনোদিন ভুলবার নয়। নদীর পাড়ে কয়েক মাইল জুড়ে ছড়ানো-ছিটানো ছিল নরকঙ্কালের, হাত-পা-পাঁজর-মাথার খুলি সবই বিচ্ছিন্ন। যদি কোনো টাইম মেশিন বানিয়ে পাকিস্তানিমন্ত্রী ইসহাক দারকে দেখানো যেত একাত্তরের নির্মমতার আংশিক নিদর্শনগুলো! হয়তো তিনি সবই জানেন, না জানার ভান করছেন, হয়তো ভাবছেন, ‘হারিয়ে যাওয়া ভাইকে’ আবার রশিবন্দি করা যায় কিনা? কষ্ট হয় আজ তাদের মুখে ‘বিচারা হুয়া ভাই’ শুনতে!

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, পাকিস্তান বাংলাদেশকে সবরকম সাহায্য সহযোগিতা করবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে মালামাল রপ্তানি করবে তাদের স্বার্থেই, তারা বিদেশি মুদ্রা পাবে রপ্তানি করে। এর বাইরে তাদের কী আছে বাংলাদেশকে সাহায্য করার মতো? তাদের দেশে রাজনৈতিক যে অস্থিরতা ও গণতন্ত্রহীনতা, তা ওই দেশের জন্মের পর হতেই আলোচনার বিষয় - সেখান থেকে আমাদের কিছু শেখার নেই। অর্থনৈতিকভাবে তারা বাংলাদেশের চেয়েও রুগ্ন। তাদেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২০২২ সালে ৯.৯ বিলিয়ন ইউএস ডলার, ২০২৩ সালে ১৩.৭৩ ইউএস বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ১৬.০ ইউএস বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের রিজার্ভ ওই বছরগুলোতে আরও ভালো ছিল। জিডিপি প্রবৃদ্ধিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে। বিশ্ব ব্যাংকের এক হিসেবে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের হার ৫.৮ শতাংশ এবং পাকিস্তানের হার-০.০ শতাংশ। সুতরাং পাকিস্তান থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে যারা বেশি আশা করবেন, তারা প্রতারিত হবেন।

আরেকটি খবর বাংলাদেশে অনেক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। বিবিসি বাংলার এক সংবাদে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি এসে ভিড়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে। পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের ওই জাহাজটি গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছিল। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পণ্য খালাস হয়ে গেলে পরদিনই জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করেছে। নতুন করে এই জাহাজ ভেড়ানোর খবর দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।’

উষ্ণতার ইঙ্গিত? পাকিস্তান থেকে কিছু শিল্পের কাঁচামাল, চুনা পাথর ও গাড়ির যন্ত্রাংশ আনতে পেরে আমরা কি উষ্ণতায় মজে যাব? এই সেই চট্টগ্রাম বন্দর যেখানে এই জাহাজ আসার আগে পাকিস্তান থেকে শেষ জাহাজ এসেছিল ১৯৭১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে, পুরো জাহাজটা ভর্তি ছিল অস্ত্রশস্ত্রে যা ব্যবহৃত হয়েছিল গণহত্যায়- পঁচিশে মার্চ এবং তার পরবর্তী নয় মাস ধরে। চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা তখন অস্বীকার করেছিল ওই জাহাজের অস্ত্রশস্ত্র খালাস করতে। পরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনীর লোক এনে সেগুলো খালাস করে ক্যান্টনমেন্টগুলোতে নিয়ে যায়। এত আগের ঘটনা, তবু মনে হয় এই সেইদিনের!

যারা উষ্ণতা জানাতে চান, তার কি জানেন না আজ পর্যন্ত পাকিস্তান বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা চায়নি। তারা কি জানেন না, স্বাধীনতার ঠিক আগে আমাদের যে সম্পদ পাকিস্তান লুট করে নিয়েছিল, তা ফেরত দেওয়া তো দূরের কথা, আজ পর্যন্ত তার কোনো হিসেব দেয়নি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফকে এক বৈঠকে বলেছেন, ১৯৭১ সালের ‘ইস্যুগুলো’ নিষ্পত্তি করুন।

জানি না ড. ইউনূস কী বুঝাতে চেয়েছেন! পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের অনেক অনেক পাওনা। প্রথম এবং অবশ্যই প্রথমে বলতে হবে, গণহত্যা ও অনাচারের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। এরপর আছে, বাংলাদেশের সম্পদ কড়ায়গণ্ডায় ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপার। এর মধ্যে, (১) পিআইয়ের বিমানের পঞ্চাশ শতাংশ, (২) পাকিস্তান স্থল-বিমান-নৌ বাহিনীর সম্পদের পঞ্চাশ শতাংশ এবং (৩) তখন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভে যে অর্থকড়ি ছিল তার পঞ্চাশ শতাংশ। এগুলো ন্যূনতম, দেশের যেকোনো সাধারণ লোকই দাবি জানাতে পারে। বাকিটা আমাদের অর্থনীতিবিদরা বলতে পারবেন।

অধ্যাপক রেহমান সোবহান এখনো বেঁচে আছেন - তিনি এ নিয়ে এত কাজ করেছেন যে, সম্ভবত তার আধাঘণ্টা লাগবে পুরো লিস্ট বানাতে। এদেশের লোক আশা করবে, পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফেরুয়ারিতে যখন বাংলাদেশ সফরে আসবেন, তার আগেই বাংলাদেশ সরকার এই লিস্টটা তৈরি করবে এবং জনসমক্ষে পাকিস্তানি মন্ত্রীকে এই পাওনাগুলো জানাবে - ‘বিছড়া হুয়া ভাই’য়ের পাওনাগুলো আগে বুঝিয়ে দিন, তারপর উষ্ণতার কথা ভাবা যাবে। যদি কেউ ভাবেন পাকিস্তানের গণহত্যা বা বাংলাদেশের পাওনা নিয়ে আমি কিছু বাড়িয়ে বলছি, তারা এদেশের ইতিহাস জানেন না।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য