প্রত্যেক সংকটের পেছনেই একটা সুুযোগ থাকে। তবে সংকট কাটিয়ে উঠা এবং সেই সুযোগটা কাজে লাগানোই বড় কথা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধ করে দেয় ভারত। তখন ধরেই নেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে গরুর মাংসের সংকট তৈরি হলো এবং এটা কখনো রিকভারি করা সম্ভব না। কিন্তু সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছে এ দেশের মানুষ। খামারি ব্যাপকহারে গরু পালন শুরু করেছে। ফলে মাংসের চাহিদা মিটছে। মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে এবং বিদেশি মুদ্রাও সাশ্রয় হচ্ছে। এবার ভারত বাংলাদেশিদের ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তারা চিকিৎসা ভিসায় কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এটাকে সংকট হিসেবে বিবেচনা করলেও আখেড়ে বাংলাদেশেরই লাভ হবে।
ক্ষমতার পালাবদলের পর বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েনের কারণে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে ভারত ভিসা সীমিত করায় স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এ সুযোগ বাংলাদেশ কতখানি নিতে পারবে, তা নির্ভর করছে অনেক কিছুর ওপর; যেখানে বহুদিন ধরেই সেবার মান নিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের নানা অভিযোগ রয়েছে। তাই রোগীর স্বজন, স্বাস্থ্য খাতের উদ্যোক্তা ও সরকারি কর্তৃপক্ষ বলছে, ভিসা সীমিত করার ফল সৃষ্ট সুযোগ নিতে হলে সেবার মান বাড়ানোসহ বেশকিছু সংস্কার করতে হবে।
কয়েকজন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সঠিক রোগনির্ণয়ের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় ওষুধ ও অযথা রোগনির্ণয়ের সুপারিশ বন্ধ করতে হবে। এছাড়া রোগীদের সঙ্গে চিকিৎসকদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, এখন রোগীরা দেশেই থাকছে, তারা দেশে খরচ করছে। এটা একটা বড় সুযোগ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সরকার স্বাস্থ্য খাতে সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছেও আবেদন করা হয়েছে যেন তারা চিকিৎসার খরচ কমিয়ে দেয়। অতিরিক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ লেখাসহ কয়েকটি বিষয়ে রোগীদের আক্ষেপের বিষয়ে ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের চিকিৎসকরা রোগীদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরীক্ষা করান - এটা একটা ধারণা। অতিরিক্ত পরীক্ষার যে কথাটা বলা হয় সেগুলো ক্যান্সার, ট্রান্সপ্ল্যান্টের মতো চিকিৎসায় হয়। পৃথিবীর যেখানেই যাক, অনেক পরীক্ষা করাতে হবে।
বাংলাদেশ থেকে ক্যান্সার, হৃদরোগ, কিডনি রোগ, প্রজনন স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা নিতে ভারতে যান অনেক বাংলাদেশি নাগরিক। প্রতিবছর কত লোক ভারতে চিকিৎসা নিতে যায় তার সঠিক পরিসংখ্যান বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাওয়া যায়নি। তবে ভারত সরকারের তথ্যের বরাতে দ্য প্রিন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে বাংলাদেশিদের জন্য প্রায় ১৬ লাখ ভিসা ইস্যু করেছিল ভারত। এর মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ ছিল মেডিকেল ভিসা। অনেকে ভ্রমণ ভিসায় গিয়েও ভারতে চিকিৎসা করিয়ে আসেন। ফলে চিকিৎসা নেওয়া বাংলাদেশিদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি হওয়ারই কথা। ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৫ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশিদের জন্য ৮ লাখ ভিসা ইস্যু করা হয়েছিল। যার মধ্যে মেডিকেল ভিসা ছিল ২ লাখ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সরকার পতন পরবর্তী প্রেক্ষাপটে মেডিকেল বা জরুরি ভিসা বাদে অন্য কোনো ভিসা দিচ্ছে না ভারত সরকার। মেডিকেল ভিসাও দেওয়া হচ্ছে সীমিত আকারে। এর মধ্যে আবার ৫ ভিসা আবেদন কেন্দ্রে সীমিত পরিসরে কাজ চলায় মেডিকেল ভিসাপ্রত্যাশীদের অনেকে পাচ্ছেন না ভিসা আবেদন জমা দেওয়ার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
গত ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সিরডাপ মিলায়তনে ‘চিকিৎসা সেবায় বিদেশমুখিতা : আমাদের উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব সারওয়ার বারীও বলেন, ‘আস্থাহীনতার কারণে’ বিপুল সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা নিতে বিদেশ ছোটে। অনুষ্ঠানে আইসিডিডিআরবির গবেষক আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, হৃদরোগ, চোখের রোগের মতো ১২ রোগের চিকিৎসায় ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ ১৯টির বেশি দেশে প্রতি বছর চিকিৎসা নিতে যান ৮ লাখের বেশি মানুষ; তাদের ৫১ শতাংশই ভারতে যান। তার উপস্থাপন করা তথ্য অনুযায়ী, বিদেশগামী রোগীদের ৫৩ শতাংশ মূলত রোগনির্ণয় বা চেকআপের জন্য বিদেশ যান। বাংলাদেশের সামনে যে সুযোগ এসেছে, তা কাজে লাগাতে হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। আস্থা বাড়বে মানুষের।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য