কোথায় নেই কোটা?

মো. মনিরুজ্জামান মনির
কোথায় নেই কোটা?

বাংলাদেশে কোনো না কোনো ইস্যুতে সরকারের পতন ঘটে। এবারও দেশে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলো, তার পেছনে শুরুতে ছিল সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতির ‘কোটা’ বাতিলের দাবির আন্দোলন। যদিও দেশের অধিকাংশ জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে কোটাবিরোধী আন্দোলন ছিল লোক দেখানো। আসল উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচার সরকারের পতন ঘটানো। এই কোটাবিরোধী আন্দোলন প্রতাপশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মসনদ তছনছ করে ফেলল। প্রাণ বাঁচাতে তিনি আশ্রয় নিলেন ভারতে। এতদিন তার তেমন সমালোচনাও করা যায়নি। তবে তার নামের আগে একটা বিশেষণ যোগ হয়েছে ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘স্বৈরাচার’। দেশের ছাত্র সমাজের আড়ালে আওয়ামী লীগবিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তি কৌশলে তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই স্বৈরাচার উপাধি দেয়। এর পেছনের গল্পটাও অবশ্য সবার জানা। তবে লেখার স্বার্থেই সেটা আবার সামনে আনতে চাই। সংবাদ সম্মেলনে কোটা আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন একজন সাংবাদিক। এই প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন শেখ হাসিনা। তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন—মুক্তিযোদ্ধার নাতি-পুতিরা (চাকরি) পাবে না তো, রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? তার এই বক্তব্যে চরম ক্ষুব্ধ হন আন্দোলনরতরা। তারা রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন। তারা স্লোগান দেন, ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।’ অবস্থা বেগতিক দেখে নমনীয় হন শেখ হাসিনা। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেন। আদালত প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে ৫৬ শতাংশ কোটা বাতিল করে মাত্র ৭ শতাংশ রেখেছিলেন। যদিও শিক্ষার্থীরা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আন্দোলনের বারুদ জ্বলতে শুরু করেছে পুরোদমে। এরই মধ্যে পুলিশের গুলিতে রংপুরে মারা যান আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী। আন্দোলন বেগবান হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রায় সারাদেশেই আন্দোলনকারীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। প্রায় হাজার খানেক তাজা প্রাণ ঝরে যায়। আহত ও পঙ্গু হয় বিপুল মানুষ। আন্দোলন চলাকালীন সময়ে সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের এবং সরকারের নির্দেশে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বহু সরকারি কর্মচারীর তাজা প্রাণ ঝরে যায়। অবশেষে গদি ছেড়ে চলে যান শেখ হাসিনা। সরকারি কর্মচারীর সন্তানদের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে কোটা সুবিধা নিয়ে কখনোই কোনো প্রকার আন্দোলন সংগ্রাম হয়নি। মুক্তিযোদ্ধার সন্তান নাতি পুতিরা মামলা করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগে কোটা চেয়ে মামলা করে রায় পেয়েছে। সেই রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে সরকার ৭% কোটা রেখে একটি পরিপত্র জারি করেন। কিন্তু যে সকল অধিদপ্তর পরিদপ্তরের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সন্তানদের বিশেষ কোটা রয়েছে সেগুলো কোনো পরিপত্র দ্বারা বাতিলের কোনো সুযোগ নেই এবং সরকারের বিশেষায়িত কারিগরি প্রতিষ্ঠানসহ এমন কিছু বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন—সেনাবাহিনী, পুলিশ, বর্ডারগার্ড, ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, রেলওয়েসহ সকল সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্মরত তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সন্তানের নিয়োগে এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ভর্তির জন্য বিশেষ কোটা সুবিধা দীর্ঘদিনের। কর্মচারীরা যে সামান্য বেতন পায় তা দিয়ে তাদের সন্তানদের ভালো কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করানো প্রায় অসম্ভব। সেই কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকে কর্মচারীর সন্তানদের কোটা সুবিধা দিয়ে পরিবারকে স্বাবলম্বী করে আসছে। কিন্তু নিয়োগ দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিন্ডিকেট নিয়োগ বাণিজ্য করতেই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সন্তানদের কোটার দিকে কালো বিড়াল চক্রের মত থাবা বসিয়েছ। কোটাবিরোধী আন্দোলন করে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক এবং পিএসসির ‘নিয়োগ বাণিজ্য’ কোটার অবসান কি করতে পেরেছেন; বিষয়টি তেমন নয়। এখনও তাদের কোটা বহাল আছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল; বর্তমান সরকার এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোটা আছে এবং থাকবে। প্রতাপশালীদের এই কোটা কখনোই বাতিল হবে না আর কেউ তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করতেও সাহস পাবে না।

উদাহরণ হিসেবে জনপ্রশাসনের কথাই বলি। সেখানে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এর পেছনে রয়েছে সংস্কার কমিশন প্রধান মুয়ীদ চৌধুরীর একটি বক্তব্য। তিনি বলেছেন, উপ-সচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭৫% কোটা থেকে কমিয়ে ৫০% প্রশাসন এবং অন্যদের ২৫% থেকে বৃদ্ধি করে ৫০% কোটা নির্ধারণ করতে চান। তাদের এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আন্দোলন শুরু করেছেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠের বাস্তবতা, অর্জিত জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকদের সহায়তা করতে পারেন। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা মাঠপ্রশাসনের সামগ্রিক কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী জায়গা সচিবালয়ে আসেন। স্বাভাবিক কারণেই তাদের উপ-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৭৫% কোটা যৌক্তিক। তাছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমে গঠিত বর্তমান যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রয়েছেন; সেখানে কী কোটা নেই? অবশ্যই আছে। কেননা, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক নিপীড়ন নির্যাতন আর স্বৈরশাসনের কারণে অতিষ্ঠ জনগণের আবেগকে পুঁজি করে সরকার পতনের প্রকাশ্য নেতৃত্বে থাকা ছাত্র নেতাদের থেকে ছাত্র কোটায় তিনজন উপদেষ্টা রয়েছেন (ছাত্র)। তারা হলেন—নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম। তারা কোটাবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রদের পক্ষ থেকে তাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। আবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন এনজিও কর্মকর্তাকেও উপদেষ্টা করা হয়েছে। একটি বিশেষ পত্রিকার লেখক কলামিস্টকেও উপদেষ্টা করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সুসম্পর্ক ও আঞ্চলিকতার কারণেও অনেকে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেয়েছেন। তারাও কিন্তু কোটারই অংশ! অন্যদিকে সরকারি সকল নিয়োগে সচিব, মন্ত্রী, এমপি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের স্লিপে মেধা তালিকার নামে টাকার কোটায় তাদের পছন্দের লোকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে এবং তাদের কোটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কোটা। এই কোটা বাতিলের ক্ষমতা কারো নাই। পিএসসির নিয়োগ দুর্নীতির মাধ্যমে মেধা তালিকার কোটা তো অদৃশ্য প্রভাবশালী কোটা এবং ভয়ঙ্কর কোটা।

আবার আসি রাজনীতিতে। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি তখন দেশের বাইরে ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতেই তাকে দলের কাণ্ডারি করা হয়। ওই সময় কী তার চেয়ে যোগ্য বিচক্ষণ ও পোড় খাওয়া নেতা ছিলেন না? তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী কী শেখ হাসিনার চেয়ে কম যোগ্যতাসম্পন্ন? না। তাহলে? তাকে দলের সভাপতি করা হয় বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে, নেত্রী হিসেবে নয়। এটাকেও কোটাই ধরে নিতে হবে। এবার আসি বিএনপির কথায়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর এক পর্যায়ে চেয়ারপারসন হন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। মওদুদ আহমেদ, বদরুদ্দৌজা চৌধুরীর মতো বষীয়ান নেতা থাকতে তাকে কেন চেয়ারপারসন করা হলো? এটাও কী কোটা নয়? এখানেই শেষ নয়; খালেদা জিয়া দণ্ডিত হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হলো তার ছেলে তারেক রহমানকে। এখানেও কী কোটা অনুসরণ করা হয়নি? হয়েছে। কারণ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতো পোড়খাওয়া রাজনীতিককে কিন্তু দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়নি। জাতীয় পার্টিরও একই অবস্থা। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেই মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান (প্রথমে ভারপ্রাপ্ত ও পরে নির্বাচিত) হন তার ভাই জিএম কাদের। সেখানে কিন্তু অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতা ছিলেন। তারপরও তাদের কপালে চেয়ারম্যানের চেয়ার জোটেনি। এমনকি জেলা উপজেলা ইউনিয়ন পর্যায়েও রাজনৈতিক দলের পারিবারিক এবং টাকার কোটায় নমিনেশন এবং নেতৃত্বের জন্য নির্বাচিত হয়ে থাকে।

এবার দেশের বাইরে নজর দিতে চাই। ভারতের অন্যতম প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। তার দলের নাম কংগ্রেস। তিনি আততায়ীর গুলিতে মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী হন তার ছেলে রাজীব গান্ধী; তখন তিনি টগবগে এক যুবক। একই সঙ্গে তিনি দলেরও প্রধান হন। অথচ তখনও দলটিতে অনেক প্রবীণ নেতা ছিলেন। সেই রাজীব গান্ধীও আততায়ীর হাতে নিহত হন। পরে দলের প্রধান হন তার স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী। কংগ্রেস বিজয়ী হলেও তিনি প্রধানমন্ত্রী হননি। কারণ তিনি বিদেশি (তার জন্ম ইতালিতে) বলে সমালোচনা হতে থাকে। এখনও দলের প্রধান তিনি এবং তার ছেলে রাহুল গান্ধী পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় নেতা। বিজেপির প্রভাবশালী নেতা অমিত শাহ’র ছেলে জয়শাহ যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিসিসিআই প্রধান হয়েছেন। এমনকি সম্প্রতি তিনি আইসিসি প্রধানও হয়েছেন। এটাকেও কোটাই ধরে নিতে পারেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি ফাঁসিতে ঝুলে মারা যান। পরে তার স্ত্রী নুসরাত ভুট্টো চেয়ারম্যান হন। তার মৃত্যুর পর ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো পার্টির চেয়ারম্যান হন। বেনজির ভুট্টো হত্যার শিকার হন। তার স্বামী আশিক আলী জারদারি দলের প্রধান হন। তার ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো এখন দলের প্রধান। এটাও তো কোটা। আমি বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছি না; এখানে কিছু বিষয় পরিস্কার—অপরাধী বা অপরাধী নয়, কোটার প্রয়োজনীয়তা ও প্রাসঙ্গিকতা ও বৈধতা সব জায়গায় আছে। আমি মনে করি, নেপোটিজম বা কোটা যে যেভাবে নেয় না কেন তা আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করে সঠিক যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচিত করাটাই কাম্য।

কোটার প্রভাব এক সময় সংকুচিত হয়ে আসবে এবং কোটার প্রয়োজনীয়তা আর থাকবে না বলে আমার বিশ্বাস।

লেখক : রাজনীতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য