প্রায় এক বছর ধরেই পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির চাপে পিষ্ট মানুষের মানুষের জীবন। বছরজুড়েই কোনো কোনো পণ্যের দাম থাকছে লাগামছাড়া। কখনও আবার বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে কোনো নিত্যপণ্য। মানুষের কষ্ট যে বেড়েছে, তা উঠে এসেছে ক্ষুধা সূচকে।
সবশেষ বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে তিন ধাপ নেমে ১২৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮৪তম অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের স্কোর ১৯ দশমিক ৪। এই স্কোর নিয়ে এই স্কোর অনুযায়ী বাংলাদেশে এখন মাঝারি মাত্রার ক্ষুধাবৃত্তে রয়েছে। আগের বছর ১৯ স্কোর নিয়ে এ সূচকে বাংলাদেশ ছিল ৮১তম স্থানে। ওয়েল্ট হাঙ্গার হিলফে বাংলাদেশ এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের তৈরি করা এই প্রতিবেদন বলছে, দেশের ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি অপুষ্টির কারণে থমকে গেছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৯ শতাংশ অপুষ্টির শিকার এবং ২ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর বয়স ৫ বছর হওয়ার আগেই মারা যায়। অপুষ্টির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ শিশুর বৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থাৎ বয়সের অনুপাতে তাদের উচ্চতা বাড়ছে না। আর অপুষ্টির জন্য পাঁচ বছরের কম বয়সী ১১ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ নষ্ট হয়ে যায় অর্থাৎ উচ্চতার অনুপাতে তাদের ওজন বাড়ছে না। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) থেকে ৯ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৬ শতাংশ নিম্নআয়ের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আগস্টের বন্যায় কৃষি ও সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর চাপ তৈরি হওয়ায় ৩৭ শতাংশ পরিবারের আয় কমে গেছে।
প্রতিবেদন বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। মূল্যবৃদ্ধির কারণে ৩০ শতাংশ পরিবার প্রয়োজনের চেয়ে কম খাদ্যগ্রহণ করছে এবং ৪২ শতাংশ পরিবার খাদ্য কিনতে ঋণ করতে বাধ্য হয়েছে। এছাড়া ২৬ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্য খরচ কমিয়েছে এবং ১৭ শতাংশ পরিবারের সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে সুস্থভাবে জীবনধারণের জন্য প্রতিদিন যে পরিমাণ খাদ্যশক্তি (২১০০ কিলোক্যালরি) নিতে হয়, তাতে প্রতি মাসে খরচ হওয়ার কথা ১৮০০ টাকা। সরকারিভাবে এটাকেই ফুড পোভার্টি লাইন বা খাদ্য দারিদ্র্যসীমা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ডব্লিউএফপির গত নভেম্বরে প্রকাশিত এক হিসাব বলছে, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম খাদ্যশক্তিসমৃদ্ধ খাবার নিতে এখন প্রতি মাসে মাথাপিছু খরচ করতে হচ্ছে ৩ হাজার ৫১ টাকা। সে অনুযায়ী সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাবার নিতে একজন মানুষের খরচ হচ্ছে খাদ্য দারিদ্র্যসীমার চেয়ে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বারবার সুদের হার বাড়ানো হলেও সুফল মিলছে না নিত্যপণ্যের বাজারে; চড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি ডিসেম্বরেও ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে পৌঁছায়। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশের কাছাকাছি। অন্যদিকে জাতীয় মজুরি বৃদ্ধির সবশেষ হার হলো ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ। প্রায় প্রতি বছরই মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম থাকে। সরকারি পরিসংখ্যানে দারিদ্র্যের হার ক্রমাগত কমলেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে মজুরি না বাড়ায় গত দুই বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ নতুন করে দরিদ্র বা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক। গত ১৫ ডিসেম্বর ঢাকায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) আয়োজিত এক কর্মশালায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. দীন ইসলাম এই তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দুই বছরে ৭৮ লাখ ৬০ হাজার মানুষ নতুন করে সহনীয় দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে এসেছে। একই সঙ্গে ৯৮ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অতিমাত্রায় দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে পড়ে গেছেন। এ সময়ে নতুন করে ৩৮ লাখ মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্রতে নেমে এসেছে।
সরকারকে যেকোনো মূল্যেই খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মানুষের খাদ্য-পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে হাড্ডিসার জাতি হবে; যা কারো কাম্য নয়। সুস্থ জাতি না হলে কোনো সূচকেই আমরা এগোতে পারব না। এখন যে প্রবৃদ্ধি আছে; তা বিঘ্নিত হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য