আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতে শত সংকটে নিমজ্জিত। তার ওপরে অনেক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে পাঠ্যবই পরিবর্তনের ও বিতরণের রাজনীতি। বিগত আওয়ামী আমল থেকে এই রাজনীতি শিক্ষাব্যবস্থায় শীর্ষস্থান অধিকার করে নেয়। ২০১০ সাল থেকে স্কুলে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের রেওয়াজ চালু হয়। তখন থেকে ১ জানুয়ারি উৎসবের মতো করে সারাদেশের সব স্কুলে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কয়েক বছর ঠিকমত চলার পরই শুরু হয় ঝামেলা। পহেলা জানুয়ারির আগে সব বই ছাপা সম্ভব হয় না, তাই দেয়াও যায় না। আবার থাকে ভুল-ভাল, ফলে ছাপানো পাঠ্যবই বাতিল করে পুনর্মুদ্রণ ও বিতরণ করতে হয়; যা শিক্ষাবর্ষ থেকে বেশকিছু সময় নিয়ে নেয়। আগের বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে পত্র-পত্রিকায় পাঠ্যবই নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয়, চলতে থাকে পরের বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। পাঠ্যবই পরিবর্তন-সংশোধন, ছাপানো ও বিতরণ- সব মিলে এক তুঘলকি কাণ্ড!
এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গতবারের মতো এবারও পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের পরিমাণ ব্যাপক। গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সেটাই স্বাভাবিক। তাই ছাপায় ভুলের ও সময়মত পাওয়ার ঝুঁকিও বেশি। ফলে যা শুরু হয়েছিলো কৃতিত্ব ও আনন্দময় উৎসব আকারে তা দীর্ঘদিন ধরে পরিণত হয়েছে ব্যর্থতা, বিতর্ক ও হতাশায়। এসব বিতর্কের বেশিরভাগটাই দীর্ঘমেয়াদে কোনো ফল দেয় না; বরং অপ্রয়োজনীয় উত্তেজনা, সমালোচনা ও বিদ্বেষ তৈরি করে। একটা পরিবর্তন যা ব্যাপক আলোচনায় আসে তা হলো কিছু লেখকের লেখা বাদ দেয়া ও কিছু লেখকের লেখা অন্তর্ভুক্ত করা। এই বাদ দেয়া ও অন্তর্ভুক্ত করার পেছনের যুক্তি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, বহুক্ষেত্রে সংকীর্ণ মতাদর্শ নির্ভর। এসব পরিবর্তনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষাগত ফলাফল থাকে না, থাকে কেবল মতাদর্শ চাপিয়ে দেয়ার স্বার্থ। এগুলো দীর্ঘস্থায়ীও হয় না, রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আবার পল্টি খায় সব। শিক্ষার্থীরা হয়ে যায় রাজনৈতিক মতাদর্শবাজদের হাতে পরীক্ষানিরীক্ষার গিনিপিগ।
পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক পরিবর্তন মানেই তো ব্যাপক মুদ্রণ ভুলের আশঙ্কা, তার মানে ছাপানো বই বাতিল কিংবা ভুলই পড়িয়ে যাওয়া। ভুল থাকে নামে, বানানে, সন-তারিখে সবচেয়ে বেশি। হয় নিম্নমানের কাগজ ও নিম্নমানের ছাপানো। মুদ্রিত বই বাতিলের মাধ্যমে হয় কোটি টাকার অপচয়। তবু এটি আমাদের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আর এর মাশুল গুণতে হয় শিশু-কিশোর প্রজন্ম থেকে সমগ্র জাতিকে।
তাহলে কি পাঠ্যপুস্তকে কোনো পরিবর্তন করা ঠিক নয়? অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন। তবে পরিবর্তন হতে হবে কেবল শিক্ষার্থীর মেধাবিকাশের দৃষ্টিকোণ থেকে, আধুনিক চিন্তাচেতনার সঙ্গে পরিচয়ের স্বার্থে ও উন্নত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, আমাদের দেশের পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তনের লক্ষ্য হয় ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ক্যাডার সংগ্রহ। তাই সব ক্ষমতাসীনরাই বিপক্ষের মতাদর্শ ঝেঁটিয়ে বিদায় করে ও নিজেদের মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ঘটায়। যা দৃষ্টিকটু পর্যায়ে পৌঁছে আওয়ামী আমলে। এতে ক্ষমতাসীনদের অনেক লাভ হয় ঠিক, শিক্ষার্থীর কোনো মানসিক বিকাশ ঘটে না।
আমাদের পাঠ্যপুস্তক ছাপানো হয় মতান্ধতা তৈরির লক্ষ্যে। অথচ শিক্ষার মূল কথাই হলো অন্ধতা দূর করা। শিক্ষার উদ্দেশ্য প্রাপ্ত ধারণাকে নির্বিচারে মেনে নেয়া নয়; বরং তাকে প্রশ্ন করা ও ক্রমাগত উত্তর সন্ধান করা। এই প্রশ্নের ও উত্তরের স্বাধীনতা নিজের ও অন্যের জন্যও। সবার জন্য ভিন্নমত, বিরুদ্ধমত ও বিপরীত মত পোষণের ও প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করতে শেখাই শিক্ষা। আর এজন্য শিক্ষার জগৎকে বড় করে দেখতে হয়- বদ্ধ ডোবার মত নয়, প্রবহমান নদী বা সমুদ্রের মতো।
আমাদের পাঠ্যবই তৈরি করা হয় বদ্ধ ডোবার মতো করে। তাই প্রতিবারই এত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার প্রয়োজন হয়। ছোট্ট ডোবার মধ্যেই দুনিয়ার সব চিন্তা ঢুকিয়ে দেয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা দেখা দেয়, তাতে অনাকাক্সিক্ষত জ্যামই বাড়ে। কারণ আমাদের শিক্ষাচিন্তায় ধরে নেওয়া হয়, পাঠ্যবইতে যা থাকবে তারচেয়ে বেশি কিছু শেখার দরকার নেই, সুতরাং যা পাঠ্যবইতে নেই তা মূল্যহীন। অতএব, যা কিছু মূল্যবান ও উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় তা খানিকটা করে হলেও পাঠ্যবইতে ঢুকিয়ে দিতে হবে। স্কুল-কলেজ থেকে ভালো রেজাল্ট করে পাস করে যাওয়ার পরে সারাজীবন ওটা বেচেই করে-কম্মে খাওয়া যাবে, আর কিছু দরকার নেই। এজন্য খুব কম শিক্ষিতজনই কর্মজীবনে ঢুকে আর বই পড়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেন, সে ক্ষমতাও থাকে না।
অথচ স্কুলে শিক্ষকের দায়িত্ব কী? শিক্ষার্থীদেরকে বদ্ধ ডোবায় নামিয়ে নাকানিচুবানি খাওয়ানো নয়। জীবনের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে ও নতুন নতুন দিগন্ত আবিষ্কার করতে শেখানো। পাঠ্যবই পড়িয়ে শিক্ষক যা করেন তা হলো পাঠ্যবইয়ের বাইরে বইয়ের যে বিরাট ভুবন তার সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় করিয়ে দেন, শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবইয়ের খাঁচায় বন্দী না করে বরং জ্ঞানের অনন্ত আকাশে উড়তে শেখান, পাঠ্যবইয়ের সুইমিংপুল থেকে তাকে ঠেলে দেন জ্ঞানের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে। এমন শিক্ষক হওয়া ও পাওয়া দুইই কঠিন, কিন্তু তার শিক্ষাই সার্থক। নিছক পাঠ্যবইয়ের গৎবাঁধা প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ নয়, এমন শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শই শিক্ষার্থীর জীবনকে সার্থক ও গৌরবান্বিত করে। আমাদের দেশে পাঠ্যবই পরিবর্তন ও সংস্কারের যে যুদ্ধ প্রায়ই দেখা যায় তা রবীন্দ্রনাথের গল্পে তোতাপাখির শিক্ষার জন্য অনুপম খাঁচা তৈরির সঙ্গেই বেশি মেলে। নদীমাতৃক দেশে নদীতে নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে ডোবাতেই আমরা মন মজিয়ে রাখি। আর তাই প্রতিবছর চলছে ও চলবে ডোবা পরিষ্কার, মশক নিধন, জীবাণুনাশ ও পুরোনো পানি সেঁচে নতুন পানি ঢুকানো- এইসব করতে করতেই বছরের তিন-চার মাস পার!
পাঠ্যপুস্তকে যেসব পরিবর্তন হয়েছে ও হচ্ছে তাতে কি শিশুকিশোদের মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশের কোনো উদ্দেশ্য পরিলক্ষিত হয়? বেশিরভাগ পরিবর্তনের উদ্দেশ্য শিক্ষাকর্তাদের করিৎকর্মা হিসেবে পরিচয় তুলে ধরার আকাক্সক্ষা- আমরা অনেক সংস্কার করছি- যেন ‘রাস্তা সংস্কার চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত,’ এইরকম। কিন্তু এই রাস্তা সংস্কারজনিত সাময়িক অসুবিধা যখন চিরস্থায়ী হয়, তখন একে কী বলব?
সরকারি উদ্যোগে পাঠ্যবই ছাপিয়ে বিনামূল্যে বিতরণের উদ্যোগটি মোটেও সফলভাবে সম্পন্ন হচ্ছে না। আর এখানে ছাপানোর কাজটা তো বেসরকারি প্রকাশনাগুলো দ্বারাই হয়, সরকার কেবল এতে বিনিয়োগ করে ও এটি সমন্বয় করে থাকে। এতে ব্যয়ই বরং বাড়ে, মানের উন্নতি দেখা যায় না। কিন্তু পূর্বে যখন বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থাগুলোই নিজ উদ্যোগে এটি করতো, তখন তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল। প্রকাশনার ভালোমন্দের দায়দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হতো। শিক্ষার্থীরা বই যত্ন করে রাখতো যাতে বার্ষিক পরীক্ষার পর সেগুলো কম দামে বিক্রি করে দেয়া যায়। অল্পদামে অনেকেই তা কিনে নিতো। কেবল যেসব বই পুরো নষ্ট হয়ে যেত, সেগুলোই নতুন করে কিনতে হতো। এর ফলে সামগ্রিক অপচয় রোধ হতো।
এবার নাকি এই বই ছাপাতে খরচ হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। যদি যখন-তখন খেয়াল-খুশিমতো পাঠ্যবই পরিবর্তন না করা হয় ও মুদ্রণের কাজটি পুরোপুরি বেসরকারি উদ্যোগে ছেড়ে দেয়া হয়; তবে বেঁচে যাবে অনেক টাকা। সবার বিনামূল্যে বই পাওয়ার প্রয়োজন নেই। দরিদ্র শিশু যারা বই কিনতে পারবে না, তাদের জন্য স্কুলে একটি অর্থ বরাদ্দ রাখা যেতে পারে কিংবা বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও সেবাসংস্থাকে দরিদ্র শিশুদের বই কিনে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। লক্ষণীয় যে, সরকার বিনামূল্যে বই দিলেও বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদেরকে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয় নোটগাইড বই কিনতে। নোটগাইড বই বন্ধ করতে পারলে নতুন-পুরনো মিলে পাঠ্যবই কেনাটা কারো জন্য তেমন কঠিন হবে না।
বিনামূল্যে পাঠ্যবই দেয়ার এই রেওয়াজ প্রতিবছর পাঠ্যবই পরিবর্তনকে আরও উৎসাহিত করেছে। এই চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। এবারের যে পরিবর্তন তা ধরে রাখা প্রয়োজন, যদি তা সম্ভব না হয় তবে এই যে দীর্ঘস্থায়ী ‘সাময়িক অসুবিধা’ তা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে না। শিক্ষা সংস্কার যেন ঠিকাদারদের হাতে রাস্তা সংস্কারের মতো না হয়, এই আমাদের কামনা। সেক্ষেত্রে বই উৎসব হবে না ও ফলে সরকারি কৃতিত্ব প্রচারের সুযোগ কমে যাবে বটে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা সঠিক সময়ে বই পাবে ও সরকারের অনেক ব্যর্থতাও ঘুচবে। যে খরচ বাঁচবে সেই অর্থ ব্যয় করা যাবে স্কুল-কলেজগুলোয় গ্রন্থাগার তৈরিতে, গ্রন্থাগারে নতুন নতুন বই কিনে দেয়ায় ও শিশু-কিশোরদের বইয়ের ভুবনের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর কাজে। দীর্ঘমেয়াদে লোকসান নয়, লাভই হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য