বাড়ি নিয়ে রাজনীতিবিদদের বাড়াবাড়ি-কাড়াকাড়ি

সালেহ উদ্দিন আহমদ
বাড়ি নিয়ে রাজনীতিবিদদের বাড়াবাড়ি-কাড়াকাড়ি

থাকার জন্য একটা বাড়ি সবারই দরকার। কিছু লোক গৃহহীন, এদের সামর্থ্য নেই বাড়ি কেনার। এরা কেউ থাকেন কোনো বস্তিতে। কেউ কেউ সংসার গড়েন রাস্তার পাশে। কেউ বা আবার রাত কাটান রেল স্টেশনে। কিছু মানুষ একটা বাড়ি জোগাড় করে নেন, নিজের বা পরিবারের জন্য। কারও থাকে সুরম্য অট্টালিকা, কারও মানানসই বিল্ডিং, কারও অ্যাপার্টমেন্ট, কেউ আবার টিনের ঘর বা ছনের ছাউনিতেই সন্তুষ্ট। যারা সরকারি কর্মকর্তা তারা থাকেন সরকারের দেওয়া সুরম্য ভবনে। আবার কেউ কেউ ভাড়া বাড়িতেই জীবনটা কাটিয়ে দিতে বাধ্য হন। মোটামুটি সৃষ্টিকর্তা ধনী-দরিদ্র সবার জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন থাকার।

কিন্তু রাজনীতিবিদদের কী হবে? তারা ক্ষমতার বাইরে গেলে থাকবেন কোথায়? তাদের এত সময় কোথায় জায়গা-জমি কিনে বাড়ি করার? আর তারা তো কোনো চাকরি-বাকরি করেন না, সবাই দেশের কাজেই ব্যস্ত। অর্থই বা পাবেন কোথায় বাড়ি করার কিংবা অ্যাপার্টমেন্ট কেনার? সৃষ্টিকর্তা তাদের জন্যও একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, যার যেমন দরকার। এই ব্যবস্থাগুলো খুবই চমকপ্রদ - সাধারণ মানুষ যারা নিজেরা নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থ সঞ্চয় করে একটা বাড়ি বানান বা ফ্ল্যাট কেনেন, ঠিক তাদের মতো নয়। এগুলো চমকপ্রদ এই জন্য যে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই বিষয়টা আলাদা ও অভিনব। সাধারণত রাজনীতিবিদরা চান, এগুলো যেন বাইরে প্রকাশ না পায়। কিছু কিছু প্রকাশ না করে উপায় থাকে না, আবার অনেকগুলো ধামাচাপা থাকে অনেকদিন। কিন্তু রাজনীতিবিদদের পেছনে লেগেই থাকে সংবাদপত্রের লোকগুলো। ওদেরইবা দোষ কোথায়? সংবাদ না থাকলে পত্রিকা চলবে কীভাবে? সুতরাং রাজনীতিবিদদের বাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি বা বাড়াবাড়ির খবরগুলো শেষপর্যন্ত আর চাপা থাকে না।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক অনাচার এবং ব্যাংকে জনগণের সঞ্চিত অর্থ নিয়ে যে লুটপাট হয়েছে, তা তিনি ক্ষমতায় থাকতেই দেশে না হলেও বিদেশি সংবাদমাধ্যমে অনেকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। পরিবারে একজনের সংক্রামক রোগ হলে, অন্যদের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তাই হলো, এই অর্থনৈতিক অনিয়ম তার প্রজন্ম এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও সংক্রমিত করেছে।

টিউলিপ সিদ্দিক : সংক্রামক রোগ কোনো ভৌগোলিক সীমা মানে না। এই ক্ষেত্রেও তা হলো, আক্রান্ত হলেন পরিবারের একজন ব্রিটিশ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দৌহিত্রী, শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক। এই সংক্রমণটা খুবই দুর্ভাগ্যের। ৪৩ বছরের টিউলিপ ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সেবাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী, এই ইকোনোমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারির একটা বড় দায়িত্ব দেশ থেকে অর্থনৈতিক দুর্নীতি নির্মূল করা। বাংলাদেশিরা তাকে নিয়ে গর্ব করতে পারত, গর্ব করত। সেই গর্ব ক্ষুণ্ন হয়েছে টিউলিপ নিজে মন্ত্রী হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ আসায়। অবশ্য আগেও যে আপামর বাংলাদেশি তাকে নিয়ে গর্ব করত এমন নয়, বাংলাদেশের দ্বিদলীয় রাজনীতি, ব্রিটেন প্রবাসীদেরও দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছে, তাই জিয়া পরিবারের যারা সমর্থক তারা শেখ পরিবারের কাউকে নিয়ে গর্ব করতে যাবেন কেন? এখন বরং শেখ পরিবার বিরোধীরা টিউলিপের দুরবস্থায় উল্লসিত হচ্ছেন বলে ধারণা করা যায়।

প্রথমে শুরু হয়েছিল খুব ছোট একটা অভিযোগ দিয়ে। আগস্ট মাসে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে, টিউলিপ নিজের উত্তর লন্ডনের অ্যাপার্টমেন্টটা ভাড়া দিয়ে, মাত্র কয় মাইল দূরে অবস্থিত এক ধনী ব্যবসায়ীর দেওয়া পাঁচ রুমের একটা বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকছেন। এই দুই মিলিয়ন পাউন্ডের বাড়িটার মালিকের নাম আব্দুল করিম, যিনি টিউলিপের খালা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে তার কাছ থেকে নানান সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন। আবার তিনি তার বাড়ি ভাড়ার অর্থ প্রাপ্তির কথা ব্রিটিশ সরকারকে জানাননি। পার্লামেন্টারি কমিটির কাছে ক্ষমা চেয়ে, এই ব্যাপারটা টিউলিপ কিছুটা ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার তাকে রক্ষা করেন এই বলে, এটা টিউলিপের একটা হিসেবের ভুল, এই জিনিসটা আগেই সরকারকে জানানো উচিত ছিল।

এরপর বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিযোগ আসলো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য ২০১৩ সালে তিনি রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতা করেছিলেন। বাজারদরের চেয়ে বেশি খরচের ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে তিনি ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন পাউন্ড (প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা) ‘আত্মসাৎ’ করেছেন।

এরপর তার বিরুদ্ধে বাড়ি নিয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তাতে ব্রিটিশ লেবার পার্টি দারুণ বিব্রত। এর ফলে টিউলিপ মন্ত্রিত্ব তো হারাতে পারেনই, তার রাজনৈতিক জীবনও চরম হুমকির মধ্যে পড়েছে। ব্রিটিশ পত্রিকা ফিনান্সিয়াল টাইমস ৩ জানুয়ারি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে একটা সুদীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়, ক্রয় না করেও টিউলিপ ২০০৪ সালে কিংস ক্রস এলাকায় একটা দুই বেড রুমের অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হন। আব্দুল মোতালিফ নামে একজন ব্যবসায়ী যার সঙ্গে আওয়ামী লীগের খুব ভালো সংযোগ রয়েছে, তিনি এর তিন বছর আগে এক লাখ ৯৫ হাজার পাউন্ড দিয়ে এটা কিনেছিলেন। তিনি এখন অ্যাপার্টমেন্টটার মালিক এবং এই ধরনের একটা অ্যাপার্টমেন্ট গত বছরের আগস্ট মাসে ছয় লাখ ৫০ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়েছে।

গত সপ্তাহে সানডে টাইমস প্রকাশ করে, টিউলিপ উত্তর লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড এলাকায় আরও একটা অ্যাপার্টমেন্টে বাস করতেন যেটা মঈন গনি নামে একজন আইন ব্যবসায়ী টিউলিপের বোন আজমিনা সিদ্দিককে উপহার দিয়েছেন। মঈন গনি বাংলাদেশ সরকারকে অনেকভাবে আইনি সহয়তা দিয়ে থাকেন। যেসব লোকজন টিউলিপ সিদ্দিককে জানেন তারা তার থাকার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করেছেন। এইভাবে শেখ রেহানার দুই মেয়েই জড়িয়ে পড়লেন খালা শেখ হাসিনার দুর্নীতির জালে। ফিনন্সিয়াল টাইমস আরও লিখেছে, লেবার পার্টির সিনিয়র নেতারা মনে করেন টিউলিপের ব্যক্তিগত আর্থিক কার্যকলাপ নিয়ে তার পক্ষ সমর্থন করা কঠিন। তার অবস্থা অগ্রহণীয় ও একটা মাইলফলকে পৌঁছে গেছে।

এইসব অভিযোগ নিয়ে এখন তদন্ত চলছে। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক হবে যদি খালার আছর লাগা টিউলিপ সিদ্দিকের মতো একজন প্রতিভাবান তরুণীর রাজনৈতিক জীবন এত অল্প বয়সে শেষ হয়ে যায়।

শেখ হাসিনা : বিবিসির বাংলার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘বাংলাদেশের যত সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন তাদের মধ্যে শুধু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই গণভবনে বসবাস করেছেন। এছাড়া অন্য কোনো সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধান সেখানে বসবাস করেননি। ... শেখ হাসিনা যখন ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন তখন তিনি গণভবন বরাদ্দ নিয়ে সেখানে বসবাস করতে শুরু করেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পরেও তিনি সেখানে বাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তীব্র রাজনৈতিক বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনা ২০০১ সালে গণভবন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

শেখ হাসিনা পরে আবার ক্ষমতায় আসেন, তার মেয়াদ শেষ করার আগেই, ২০০১ সালের ২০ জুন জাতীয় সংসদে জাতির পিতার পরিবার সদস্যগণের নিরাপত্তা আইন ২০০১ সংসদে পাস করানো হয়। তাতে বিধান করে দেওয়া হয় : ‘বাংলাদেশ নিরাপত্তা আইনে ভিআইপিদের জন্য যেরূপ নিরাপত্তার ব্যবস্থা আছে সেইরূপ নিরাপত্তা সরকার জাতির পিতার পরিবারের সদস্যগণকে আজীবন সর্বস্থানে প্রদান করবে। নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকার পরিবার-সদস্যগণের মতামতকে প্রাধান্য দিবে এবং পরিবার-সদস্যগণের প্রত্যেকের জন্য নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’

বাংলাদেশের একটা দৈনিকে পত্রিকায় লেখা হয়, ‘২০০১ সালের দোসরা জুলাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এই আইনের ক্ষমতাবলে শেখ হাসিনাকে গণভবন এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে ধানমন্ডির ছয় নম্বর সড়কে এক বিঘার একটি সরকারি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়। তৎকালীন বিভিন্ন সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে পূর্ত মন্ত্রণালয় বাড়ি বরাদ্দের প্রস্তাব উত্থাপন করে। সেখানে বলা হয় গণভবন তার ব্যক্তি মালিকানাধীন হবে না, সরকারি মালিকানাধীনই থাকবে। শেখ হাসিনাকে গণভবন বরাদ্দ দেওয়ার কারণ হিসেবে তার নিরাপত্তার বিষয়টিকে উল্লেখ করা হয়।’

বিএনপি সরকারে আসার পর, বেগম জিয়া সরকারি বাড়ি রেহানাকে দেওয়া পছন্দ করলেন না, হাজার হোক এই বাড়ির মালিকানা দেশের খেটে খাওয়া জনগণের। তার সরকার রেহানাকে দেওয়া ধানমন্ডির বাড়িটিকে একটা থানা বানাল। শেখ রেহানা পরবর্তীতে ২০১২ সালে এক বিঘার এই বাড়িটি ফিরিয়ে দেন সরকারকে। তার বোন শেখ হাসিনা তার এই বদান্যতা বেশি দিন টিকে থাকতে দিলেন না। তিনি ক্ষমতায় থাকতেই আবার রেহানাকে ১০১ টাকায় আরও একটু বড় বাড়ি দান করেন, যেটা গুলশানে ৮৪ নম্বর রোডে দেড় বিঘা জায়গার ওপর নির্মিত।

শেখ হাসিনা পরিবারের বাড়ি ও জায়গার বাড়াবাড়ি এখানেই শেষ নয়। রাজউকের আলোচিত পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে স্বয়ং নিজের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্লট নিয়েছেন, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। এছাড়া, প্লট বরাদ্দপ্রাপ্তদের তালিকায় আছেন হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তার দুই ছেলে-মেয়ে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিক। প্রত্যেকে ১০ কাঠা করে বাড়ি করার জায়গা বরাদ্দ পান। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের এই বরাদ্দটি যখন হাসিনা আদায় করে নিয়েছিলেন, তখনও পৃথিবী করোনা মহামারিতে ধুঁকছিল।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের হাসমত আলী বড় বেশি সৌভাগ্যবান, জীবদ্দশায় তার দেখে যেতে হয়নি বাড়ি নিয়ে শেখ হাসিনার জন্য সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে একখণ্ড জমি কিনে রেখে গিয়েছিলেন। এই সব ‘বিরল ভালোবাসা’কে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বাড়াবাড়ি। সেই হাসমত আলীর কথা বলছি, রিকশা-ভ্যান চালিয়ে জীবন নির্বাহ করা যে মানুষটি ‘এতিম’ শেখ হাসিনার করে দিয়ে গিয়েছেন হাসিনা।

শেখ রেহানা : কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পত্রিকায় একটা ছবি বেরিয়েছিল, দুজন ভূতপূর্ব প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বুড়িগঙ্গায় একটা নৌকার উপরে বসে আছেন। সেখানে একজন দাড়ি-গোফ কামিয়ে লুঙ্গি পরে মাথায় একটা গামছা বেঁধে মাঝির বেশে আছেন। যারা দেখেছেন, সবার জন্য খুব কৌতূহলের ছিল ছবিটা- বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক সালমান এফ রহমান এখানে কী করছেন নৌকার উপর গামছা মাথায়? পুলিশের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী, সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে তাকে নেয়া হয় ডিবি অফিসে, সেখানে তাকে দেওয়া হয় ফ্লোরে একটা মাদুরে ঘুমাতে। কেউ কি বিশ্বাস করবেন এত শক্তিধারী লোক যিনি, এখন খালি ফ্লোরে ঘুমাচ্ছেন তিনি? তার কত কত অট্টালিকা আছে পৃথিবীর কত বড় বড় শহরে! এমনি একটি অট্টালিকা আছে পশ্চিম লন্ডনে, লেডিবাজ প্রপার্টিজের নামে। বাড়িটির দাম ১.২ মিলিয়ন পাউন্ড। লেডিবাজ প্রপার্টিজের মালিক সালমান রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান ফজলুর রহমান।

এই বাড়িতেই থাকছেন শেখ রেহানা বিনা ভাড়ায় গত এগারো বছর ধরে। বাজার দরে বাড়িটার ভাড়া এখন চার হাজার পাউন্ড মাসে, প্রায় পাঁচ লাখ টাকা। এই হিসেবে শেখ রেহানা কত টাকা বাঁচিয়েছেন? অবশ্য সালমান রহমান বলেছেন, শেখ কামাল তার বন্ধু ছিলেন, তাই তিনি বন্ধুর বোন রেহানাকে থাকতে দিয়েছেন নিজেদের বাড়িতে। রেহানা বলেছেন, বাড়িটা পরিষ্কার পরিছন্ন রাখতে সালমানের কতো টাকা যে খরচ হতো, সেটা তিনি বাঁচিয়েছেন। পুরো ব্যাপারটা বেশ মজার। কিন্তু যে ব্যাপারটা মজার নয়, তাহলো স্বার্থের সংঘাত। বাংলাদেশের একটা শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক সালমানকে নিয়ে বলেছেন, ‘ব্যাংক লুট সংস্কৃতির স্থপতি’। এক হিসাবে বলা হয়েছে তিনি ৩৬ হাজার কোটি টাকার ‘ব্যাংক জালিয়াতি’ করেছেন বিভিন্ন ব্যাংক থেকে। টাকার অংকটা যদি ৩৬ হাজার কোটি টাকা না হয়ে ৩৬শ কোটি টাকাও হয় এবং এ থেকে রেহানার ১১ বছরের বাড়ি ভাড়া বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তবু বলা যায় এই রাজনৈতিক সম্পর্ক থেকে সালমান অনেক লাভবান হয়েছেন।

খালেদা জিয়া : আপনি যদি মনে করেন বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা শুধু হাসিনা পরিবারে সীমাবদ্ধ, তাহলে ভুল করবেন। ব্যাপারটা বহুদলীয়। তবে শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতাধর নন, তাই আমরা নির্বিঘ্নে তাদের কথা বলতে পারলাম। এই লেখাটাকে নিরপেক্ষ ও পরিপূর্ণ করতে হলে জিয়া পরিবারের ঘটনাগুলোও লেখা দরকার। তবে একটা রক্ষাকবচ আছে, জিয়া পরিবারের এই ঘটনাগুলো নিয়ে তৎকালীন পত্রপত্রিকায় এত বেশি লেখা হয়েছিল যে, এগুলো অনেকটা নথিভুক্ত সত্য। তখন অন্তত সংবাদমাধ্যমগুলো লিখতে পারত, যা শেখ হাসিনার রেজিমে অকল্পনীয় হয়ে গিয়েছিল।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে আচমকা কিছু সেনা অফিসারের গুলিতে নিহত হবার পর, প্রথমে তার মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। তারপর চট্টগ্রামের এক পাহাড়ের গোড়ায় পাওয়া গেল তার মৃতদেহ এবং এনে কবর দেওয়া হলো ঢাকায়। তখনকার ঘটনাগুলো জানাতে পুরো দেশের মানুষ আটকে রইল সংবাদত্রের পাতায় এবং টেলিভিশনের স্ক্রিনে। বাংলাদেশে তখন অবশ্য বিটিভি ছিল একমাত্র অবলম্বন। এই নিষ্ঠুরতায় দেশের জনগণের অনেক বড় একটা অংশ দারুণ শোকাভিভূত ও জিয়া পরিবারের প্রতি সহানুভুতিশীল হয়ে পড়েছিল।

জিয়ার মৃত্যুর পর তার ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হলেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধানের ৬৫ কাঠার সরকারি বাসস্থান যেখানে জিয়া পরিবার থাকতেন, সেটা জিয়া পরিবারকে এক টাকার বিনিময়ে দিয়ে দিলেন। সেখানেই শেষ নয়, তাকে আর একটা সরকারি বাড়ি দিয়ে দেওয়া হলো গুলশানে, তাও এক টাকায়। বাড়িগুলো ছিল সরকারের, তাই দেশের সাধারণ লোকের সবারই এমনকি শ্রমজীবী মানুষ যদু-মধুরও এগুলোতে মালিকানা ছিল। কেউ জিজ্ঞেস করতে সাহস পেল না, কেন দেশের সম্পদ এইভাবে দিয়ে দেওয়া হবে অন্যদেরকে। বিচারপতি সাত্তারের নিজস্ব একটা বড় বাড়ি ছিল ধানমন্ডিতে - তিনি সেটা তাদেরকে দিতে পারতেন থাকার জন্য। খালেদা জিয়াও বাড়ি নিতে কোনো আপত্তি করলেন না, কেনইবা তা করবেন?

যাই হোক শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ক্ষমতায় আসলেন। খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে তার গাত্রদাহ অনেকদিনের। সেই গাত্রদাহ থেকে হোক, যদু-মধু বা ফজু-নজুর মতো আমজনতার জন্য দুঃখবোধ থেকে হোক, তিনি বেগম জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়িছাড়া করার ব্যবস্থা করলেন। ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হলো খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ির দলিল বাতিল করে সরকার সেখান থেকে তাকে উঠে যেতে যে নোটিশ দিয়েছে তা বৈধ। এরপর খালেদা জিয়াকে উঠে যেতে হলো। সেখানে তড়িঘড়ি করে বানানো হলো অনেকগুলো অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সৈনিকদের পরিবারকে থাকতে দেওয়া হয়। এভাবে শেখ হাসিনা ব্যবস্থা করলেন যাতে জিয়া পরিবার বাড়িটা আবার দখল করতে না পারে। অবশ্য গুলশানের বাড়িটি এখনো বেগম জিয়ার মালিকানাধীন। দেশের জনগণ কৌতূহল ভরে দেখল একটা বাড়ি নিয়ে আমাদের দুই নেত্রীর কাড়াকাড়ি এবং বাড়াবাড়ি।

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ : ওই সময়ের আরেকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ির ব্যাপারে তিনিও পিছিয়ে ছিলেন না। তার প্রতি ন্যায্যভাবে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, তিনি সরকারি পুরানো বাড়ি নিয়ে কোনো কাড়াকাড়ি করেননি। এরশাদের পছন্দ ছিল নতুন বাড়ি। কিন্তু দুর্নীতির পথে অর্থ সঞ্চয়ের জন্য তিনি ছিলেন নানাভাবে অভিযুক্ত এবং এই অর্থ দিয়ে তিনি অনেক নতুন অট্টালিকা বানিয়েছেন। কারওয়ানবাজারে তার ছিল জানতা টাওয়ার নামে একটা ১১ তলা বিশাল বাণিজ্যিক ভবন। বারিধারায় প্রেসিডেন্ট কমপ্লেক্সে দুই-দুইটা বিরাট অ্যাপার্টমেন্ট, যেগুলোতে তিনি থাকতেন এবং গুলশান-বনানীতে অনেক বাড়ি-ঘর। আমরা শুধু বাড়ি নিয়ে রাজনীতিবিদদের বাড়াবাড়ি-কাড়াকাড়ি নিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বললাম। তবে রাজনীতিবিদদের বাড়ি-ঘর জায়গা জমি নিয়ে বাড়াবাড়ির ঘটনা অনেক অনেক পুরানো এবং এখানেই শেষ হলে ভালো হয়। তবে ভবিষ্যতের রাজনীতিবিদরাও যে বাড়ি নিয়ে বাড়াবাড়ি ও কাড়াকাড়িতে অংশ নেবেন, তা নিশ্চিত বলে দেওয়া যায় এবং এটা নিয়ে আরও অনেক লেখা হবে, তাও নিশ্চিত।

লেখক : ডাকসুর সাবেক সম্পাদক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য