প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বাংলাদেশের মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশ সরকার একটি সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনের নিমিত্তে পর্যাপ্ত প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহসহ টেকসই খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্য অর্জনের নিমিত্তে মৎস্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি, কর্মপরিকল্পনা ও কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - চাষি পর্যায়ে লাগসই ও জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ (যেমন মাছ চাষ নিবিড়করণ, পরিবেশবান্ধব চিংড়ি চাষ সম্প্রসারণ, মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন, ইত্যাদি), উন্মুক্ত জলাশয়ে সহ-ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন (যেমন ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নভেম্বর-জুন পর্যন্ত জাটকা ইলিশ সংরক্ষণ ও প্রজনন মৌসুমে ১২ অক্টোবর থেকে ০২ নভেম্বর পর্যন্ত মোট ২২ দিন ইলিশ আহরণ বন্ধ রাখা, মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন, জলজ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা মাছ অবমুক্তকরণ, বিল নার্সারি স্থাপন, হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রের উন্নয়ন, ইত্যাদি)।
সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা (যেমন প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মোট ৬৫ দিন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জলসীমায় সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধকরণ, গভীর সমুদ্রে মেরিন রিজার্ভ এলাকা ঘোষণা, নিঝুম দ্বীপ ও নাফ নদীর মোহনায় সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা, ইত্যাদি) এবং মৎস্যবিষয়ক গবেষণা।
২০২২-২০২৩ অর্থবছরে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ টন যা দেশের জিডিপিতে ২.৫৩ শতাংশ, দেশের মোট রপ্তানি আয়ে ০.০৮ শতাংশ এবং প্রাণিজ প্রোটিন সরবরাহে প্রায় ৬০ শতাংশ অবদান রাখছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে ২য় অবস্থানে উঠে এসেছে এবং বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বিশ্বে ৫ম স্থান ধরে রেখেছে।
বিশ্বে ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ ১ম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ স্থানে রয়েছে। ক্রাস্টাশিয়ান্স আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বে ৮ম এবং উপকূলীয় ও সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম স্থান অর্জন করেছে। বাংলাদেশের মৎস্য সেক্টরের এই অগ্রযাত্রাকে টেকসই করতে নিম্নবর্ণিত সমস্যাগুলোর প্রতি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
ক) চাষের জন্য গুণগত মানসম্পন্ন মাছের পোনার সরবরাহ নিশ্চিত করা : বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদনকারীদের নিকট থেকে প্রায়শই অভিযোগ আসে যে, পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার দিয়ে লালন-পালন করার পরও মাছের কাক্সিক্ষত বৃদ্ধি হয় না। তারা প্রাথমিকভাবে এর জন্য মাছের পোনার গুণগত মানকে দায়ী করে থাকেন। দেশের ১১২টি সরকারি ও ১,০০৭টি বেসরকারি হ্যাচারি থেকে প্রায় ৬ লাখ কেজি মাছের রেণু উৎপাদন হলেও সেগুলোর গুণগত মান সব ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত নয়। মাছের পোনার গুণগত মান নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ হলো - মাছের অন্তঃপ্রজনন এবং নিম্নমানের ও অপরিপক্ব মা-বাবা মাছ থেকে রেণু উৎপাদন।
মাছের অন্তঃপ্রজনন পরিহার করতে হলে একাধিক প্রাকৃতিক ও হ্যাচারির উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ করে মা-বাবা মাছের মজুত তৈরি করতে হবে এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মাছকে প্রজননের জন্য ব্যবহার করতে হবে। তাছাড়া, প্রাকৃতিক উৎসের পোনা উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে হালদা নদী ছাড়াও যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রসমূহের সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্রসমূহের মাছের কৌলিতাত্ত্বিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
দ্রুত বর্ধনশীল ও রোগ সহিষ্ণু মাছের পোনা উৎপাদনের জন্য নির্বাচিত প্রজননের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ওয়ার্ল্ডফিশ বাংলাদেশ কর্তৃক রুই মাছের জাত উন্নয়নের নিমিত্ত নির্বাচিত প্রজনন কার্যক্রম (জি-৫) চলমান আছে এবং জি-৩ চাষি পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়েছে বলে জানা যায়। বাংলাদেশ মাৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটও রুই মাছের উন্নত জাত (সুবর্ণ রুই) কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এখনো এর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে।
অন্যান্য চাষযোগ্য মাছের জন্যও নির্বাচিত প্রজননের উদ্যোগ গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সেক্স হরমোন বা কৌলিতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মাধ্যমে সব পুরুষ (যেমন তেলাপিয়া) এবং সব মহিলা (যেমন মৃগেল) পোনা উৎপাদন কার্যক্রমকে প্রসারিত করতে হবে।
খ) গুণগত মানসম্পন্ন মাছের খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা: মাছ চাষ নিবিড়করণের সঙ্গে সঙ্গে মৎস্য খাদ্যের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু খাদ্যের গুণগত মান নিয়ে চাষিরা সর্বদাই চিন্তিত থাকেন। বাংলাদেশে অনেক স্বনামধন্য খাদ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থাকলেও অনেক অসাধু ব্যবসায়ী মৎস্য খাদ্যে ট্যানারির উপ-পণ্য উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে জানা যায়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গুণগত মানহীন এসব খাদ্য ব্যবহার করে উৎপাদিত মাছ খেলে মানুষের স্বাস্থ্যও ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই, মৎস্য খাদ্যের গুণগত মান নিশ্চিৎকল্পে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের আশু পদক্ষেপ একান্ত প্রয়োজন। মৎস্য খাদ্যে ব্যবহৃত বেশিরভাগ উপকরণই বিদেশ থেকে আমদানি করে থাকে। ফলে মৎস্য খাদ্যের দাম বেশি হয়ে থাকে ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। তাই, দেশীয় উপকরণ ব্যবহার করে কিভাবে মানসম্মত মৎস্য উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা ও সরকারি উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি।
গ) নিবিড় ও অতি নিবিড় মাছ চাষে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা : মৎস্য খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত লাভজনক হলেও নিবিড় ও অতি নিবিড় মাছ চাষে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা অতীব জরুরি। আমাদের দেশের অনেক নতুন নতুন বিনিয়োগকারী শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিবিড় ও অতি নিবিড় মাছ চাষ (যেমন বায়োফ্লক, ইন-পন্ড রেইসওয়ে সিস্টেম, ইত্যাদি) এর সফলতার ভিডিও দেখেই এ খাতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
এধরনের চাষ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাদের কোনো বাস্তব জ্ঞান ও দক্ষতা থাকে না। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অসফল হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগকারীগণ শুরুতে আধা-নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে ক্রমান্বয়ে নিবিড় ও অতি নিবিড় মাছ চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
ঘ) প্রাকৃতিক জলাশয়ে দেশীয় ছোট মাছের সংরক্ষণ ও উৎপাদন : বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ নদীমাতৃক ব-দ্বীপ হওয়ার কারণে এদেশের নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, প্লাবণ ভূমি, ইত্যাদি এক সময় দেশীয় মাছে পরিপূর্ণ ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তনে পানি দূষণ, পলি জমে জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ ও রাস্তা নির্মাণ, মাছের প্রজননক্ষেত্র নষ্ট হয়ে যাওয়া, পর্যটন ও অন্যান্য কৃষি কাজের প্রভাব, শিল্পায়ন, অতি আহরণ, জলাশয় শুকিয়ে মাছ ধরা, নির্বিচারে মা ও পোনা মাছ আহরণ, ইত্যাদি কারণে ছোট মাছের উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
অথচ এ ছোট মাছ আমিষ, ভিটামিন ও মিনারেলস এ পরিপূর্ণ। অতীব পুষ্টিকর দেশের ছোট মাছকে সংরক্ষণের নিমিত্তে ছোট মাছের প্রজননের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে প্রতিটি প্রাকৃতিক জলাশয়ে ন্যূনতম একটি স্থায়ী অভয়াশ্রম স্থাপন করা আশু প্রয়োজন। কৃষি জমিতে কীটনাশক ব্যবহারের পরিবর্তে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
ছোট মাছের প্রজননক্ষেত্র ও নার্সারি হিসেবে অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বাদু পানির সোয়ম্প ফরেস্ট ও উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সংরক্ষণসহ পানিতে বেঁচে থাকতে সক্ষম এমন গাছ-পালা ও ঝোপঝাড়কে সম্প্রসারণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া, দেশীয় মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য অঞ্চলভিত্তিক লাইভ মিউজিয়াম তৈরি ও কৃত্রিম প্রজননের উদ্যোগ গ্রহণ আশু প্রয়োজন। অন্যথায়, অনেক দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
ঙ) মৎস্য মজুত ও আহরণের উপাত্ত এবং মৎস্য ব্যবস্থাপনা : উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য আহরণের সঠিক উপাত্ত কার্যকর মৎস্য সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য অতি প্রয়োজনীয়। অনুরূপভাবে, কোনো জলাশয়ে মাছের প্রজাতিভিত্তিক মজুত সম্পর্কে তথ্য ওই প্রজাতির আহরণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উদাহরণস্বরূপ উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের দ্বীপ রাষ্ট্র আইসল্যান্ড এর কথা উল্লেখ করা যায়।
আইসল্যান্ড সরকারের নিকট তাদের জলসীমায় পাওয়া যায় এমন প্রায় সব প্রজাতির মাছের বয়সভিত্তিক মজুত সম্পর্কে তথ্য আছে। সে তথ্যের ভিত্তিতে দেশের জলাশয় থেকে কী পরিমাণ মাছ আহরণ করলে মাছের মজুতের ওপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না প্রথমে তা নির্ধারণ করে। পরবর্তীতে, প্রজাতিভিত্তিক সে পরিমাণ মাছ আহরণের জন্য বিভিন্ন মৎস্য আহরণকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট কোটা হিসেবে বিক্রি করে।
কোনো মৎস্য আহরণকারী প্রতিষ্ঠান তার জন্য নির্ধারিত প্রজাতিভিত্তিক কোটার বেশি ও তার জন্য নির্ধারিত এলাকার বাইরে থেকে মাছ আহরণ করতে পারে না কারণ আহরণের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় মাছ আহরণ করার ফলে কোনো প্রজাতির অপ্রাপ্ত বয়স্ক মাছসমূহ বড় হয়ে পরের বছর আহরণ উপযোগী হয়।
এ পদ্ধতিতে মাছ আহরণ বছরের পর বছর চললেও মাছের মজুত হঠাৎ কমে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। ফলে টেকসই উপায়ে বছরের পর বছর মাছ আহরণ করা যায়। বাংলাদেশ সরকারের নিকটও যদি দেশের উন্মুক্ত জলাশয়ের সব মাছের বয়সভিত্তিক মজুত থাকে তাহলে আইসল্যান্ডের অনুরূপ পদ্ধতি অনুসরণ করে মৎস্য আহরণ করলে উন্মুক্ত জলাশয় টেকসইভাবে মৎস্য আহরণ সম্ভব হবে। অন্যথায়, উন্মুক্ত জলাশয় হতে নির্বিচারে মৎস্য আহরণ করলে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সর্বোপরি, বাংলাদেশের জলসীমা থেকে বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকে সে সময়, কোনো বিদেশি ফিশিং ট্রলার যেন মাছ ধরে নিয়ে যেতে না পারে সেদিকে সমুদ্র নিরাপত্তায় নিয়োজিত সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। তাছাড়া, মাছের মূল্য সংযোজন ও বাজার ব্যবস্থাপনায়ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মনিটরিং ও নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যন্ত জরুরি যাতে বাজারে মাছের দাম মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে।
লেখক : অধ্যাপক, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য