গরিব সিংহাসন চায় না। রাজনীতির জটিল হিসাব-নিকাশও তারা বোঝে না। কে ক্ষমতায় এলো আর কে গেল, তা নিয়ে তাদের ভাবনা নেই। তারা কেবল দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো তারা মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ে বহু বছর ধরে পিষ্ট। গত দুই বছর ধরে লাগামহীন উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে তারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, গেল বছর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের উপরেই। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশে।
দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নিলেও কার্যত কোনো ফল হয়নি। জনগণের জীবনযাত্রার ব্যয় ক্রমেই বেড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনের কারণে দেশের সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাত ঘটার কারণে মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে পৌঁছেছিল। গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের জনগণ আশা করেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নেওয়ায় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় কমবে; কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি পড়েছে। বছরের শুরুতেই তাদের ঘাড়ে চাপল বাড়তি শুল্ক-করের বোঝা। শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাদেশ জারি করেছে। দেশের মানুষের জানতে বাকি নেই এই সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আন্তজার্তিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে। গত শনিবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। বাজেটে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রাজস্ব আহরিত হয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা; যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা কম। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। এনবিআর বলছে, অতিরিক্ত ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বাড়াতেই শুল্ক-কর বাড়াতে হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার শুল্ক-কর বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে। আর এই পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খাত-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। প্রশ্ন উঠেছে, অর্থবছরের মাঝপথে এমন সিদ্ধান্ত না নিয়ে সরকার অন্যভাবে এর সমাধান করতে পারত কি না। অর্থনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ পাচার রোধ, সক্ষমতা বৃদ্ধি, কর ফাঁকি কমানো, অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ শুল্ক-কর কিছুটা কমানো যেত। কিন্তু তাতেও আগামী জুন মাসের মধ্যে ১২ হাজার কোটি টাকা আদায় সম্ভব হবে না। তাছাড়া আয়কর বছরের মাঝে বাড়িয়েও আদায় বাড়ে না, যেহেতু পূর্বের অর্থবছরের আয়ের ওপর এটা দেওয়া হয়। সহজ হিসেবে শুল্ক-কর বাড়ানোর পথ বেছে নিয়েছে সরকার।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সময়টা অনুকূল নয়। এমনিতেই মূল্যস্ফীতির বাজার তারপরও এই বাড়তি শুল্ক-কর অনিবার্যভাবেই জনসাধারণের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যদিও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এই শুল্ক-কর আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটা দিনকে রাত বলার মতো ব্যাপার। সরকার বলছে, সরকার আয় বাড়াতে চাচ্ছে, কিন্তু এতে যে জনগণের খরচ বাড়বেÑ সেটা অস্বীকার করা হচ্ছে। আর এই আকস্মিক শুল্ক-কর এমন এক সময় বাড়ানো হলো যখন সামনেই রোজা।
শুল্ক-কর বাড়ার কথা শুনে এর মধ্যেই মানুষের মাথায় হাত পড়েছে। বাজারের পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। অনেক জিনিসপত্রেরই দাম বেড়ে গেছে। শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে নাগরিক কমিটিসহ অনেক রাজনৈতিক সংগঠন। জনগণের দাবি, প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে জনসাধারণের ওপর থেকে এই পরোক্ষ শুল্ক-করের চাপ কমানো হোক। আকস্মিক এই শুল্ক-কর বাড়ানোয় বর্তমান সরকারের ওপর বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করছে জনগণ। আমরাও চাই এই শুল্ক-কর বাড়ানোর বিষয় সরকার পুনর্বিবেচনা করুক।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য