ঘটনাটি মাস কয়েক আগের। এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা হচ্ছিল। তিনি দেশের নাম করা একটি মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক। রোগ, রোগী, স্বাস্থ্য, ডাক্তার, চিকিৎসা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তার দর্শন একটু ভিন্ন ধরনের। তো, আলোচনার এক ফাঁকে আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘আচ্ছা বলো তো বাংলাদেশের মানুষের বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রবণতা এত বেশি কেন? দেশের রাষ্ট্রনেতা, নেত্রী, মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে সবাই কেবল বিদেশে যেতে চায়। বিদেশে কী পায়, বুঝি না!’
আমি চুপ আছি দেখে জানতে চাইলেন, ‘তোমার কী মনে হয়?’ আমি বললাম, ‘তোমার এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে একটু কঠিন। এর অনেক কারণ থাকতে পারে। খুবই সাধারণভাবে বলতে গেলে, মানুষ একটু আস্থার খোঁজে দেশের বাইরে যায়।’ তখন তিনি বললেন, ‘তুমি কি বলতে চাইছো আমাদের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা নাই?’ আমি বললাম, ‘বিষয়টি হয়তো তেমন নয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমাদের দেশের ডাক্তারদের ক্লিনিক্যাল সক্ষমতা অবশ্যই বিশ্বমানের। তবে যোগাযোগ সক্ষমতা খুবই নিম্নমানের।’ তখন তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি কি বলতে চাইছো, রোগীর আরোগ্য প্রক্রিয়ায় তোমার যোগাযোগই ভূমিকা পালন করে?’
জবাবে আমি বললাম, দেখো, আমি যোগাযোগ বিদ্যার মানুষ। যোগাযোগের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারি মাত্র। তবে এ সম্পর্কিত বেশিরভাগ গবেষণাই পশ্চিমা দেশের প্রেক্ষাপটে হয়েছে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। তারপর তিনি জানতে চাইলেন, রোগ নিরাময় প্রক্রিয়ায় যোগাযোগের ভূমিকা নিয়ে তার মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের সামনে কথা বলার সাহস আমার আছে কিনা। আমি বললাম আছে। আজকের লেখাটি মূলত সেই মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীদের সামনে যা বলেছিলাম তার ভিত্তিতেই।
হাসপাতালে ডাক্তারের চেম্বারে ডাক্তার ও রোগীর সঙ্গে দুই ধরনের যোগাযোগ হয়। যেমন, বাচনিক যোগাযোগ ও অবাচনিক যোগাযোগ। বাচনিক যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে মৌখিক কথাবার্তার মাধ্যমে রোগীর শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সম্পর্কে জানতে চাওয়া এবং সেই অনুযায়ী পরামর্শ দেওয়া। ডাক্তার সাধারণত রোগীকে বায়োমেডিক্যাল, ক্লিনিক্যাল ও সমাজ-মনোস্তাত্ত্বিক তথ্য দিয়ে থাকেন। রোগীকে আশা প্রদান, সাহস জোগানো, পরামর্শ ও নির্দেশনা দেওয়ার জন্য নানা ধরনের ইতিবাচক কথাবার্তা বলে থাকেন। এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে রোগীর দৈনন্দিন জীবনযাপন ও জীবনশৈলী সম্পর্কে তথ্য-পরামর্শ দেন। চেষ্টা করেন রোগী সঙ্গে এক ধরনের আস্থার সম্পর্ক গড়ে তুলতে। আর সেই আস্থার সম্পর্কটি গড়ে ওঠার অন্যতম শর্ত হলো পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও তার প্রকাশ। স্বাস্থ্যসেবাকর্মী তথা ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব সংঘাত নিরসনের জন্যও কার্যকর যোগাযোগ করতে হয়। অন্যদিকে অবাচনিক যোগাযোগের মধ্যে রয়েছে ডাক্তারের পক্ষ থেকে রোগীকে এমনভাবে স্পর্শ করতে হয়, যাতে রোগী আরামবোধ করেন, ভরসা পান। রোগীর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়। যথাযথ ক্ষেত্রে হাসির প্রকাশ থাকতে হয়। ডাক্তারের চাহনিও রোগীকে নানা বার্তা দিয়ে থাকে। এছাড়া ডাক্তারের চোখের ভ্রু নাড়ানো, মাথা নাড়ানো, করমর্দন, আবেগীয় সমর্থন ও সহায়তা প্রদানও কার্যকর যোগাযোগের অংশ।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই দুই ধরনের যোগাযোগ রোগীর শারীরিক ও মানসিক কল্যাণ নিশ্চিত করে। তার আত্মমর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। শারীরিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। সামাজিক সম্পর্ক ও প্রক্রিয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। রোগীর আত্মদায়িত্ববোধ ও সন্তুষ্টির মাত্রা বাড়ায়। রোগীর স্বাস্থ্য সাক্ষরতা বাড়ে। তার সমস্যাগুলো ঠিকমত গুছিয়ে ডাক্তারকে বলতে পারে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। রোগীর মাঝে ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলার প্রবণতা বাড়ে এবং সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মানও বাড়ে। তবে যোগাযোগ হতে হবে নিরাময়ী বা আরোগ্যমূলক।
এখন প্রশ্ন হলো এই নিরাময়ী যোগাযোগের রূপটি কেমন। জবাবে বলা যায়, নিরাময়ী হলো– ডাক্তার ও রোগীর মাঝে এমন এক যোগাযোগ যেখানে রোগ ও আরোগ্য সম্পর্কে তথ্য আদান-প্রদান ঘটে। ডাক্তার রোগীর আবেগের প্রতি যথাযথ সাড়া প্রদান করেন। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করেন সমানুভূতি ও সমবেদনা দিয়ে। ডাক্তার-রোগীর মানবিক ও আরোগ্যকারী সম্পর্ক গড়ে ওঠে ও বজায় থাকে। রোগীর আরোগ্যের প্রশ্নে যেকোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে রোগীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রোগী যাতে নিজ আরোগ্য প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে সেই প্রশ্নে তাকে সক্ষম করে তোলা হয়।
এই আরোগ্যায়ন প্রক্রিয়ায় যোগাযোগ দুইভাবে ভূমিকা পালন করে : প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ। ডাক্তার-রোগীর কার্যকর যোগাযোগের পরোক্ষ সুফল দুই রকম। যথা, প্রক্সিমিয়াল ও ইন্টারমিডিয়েট।
প্রক্সিমিয়াল সুফলগুলো : ডাক্তার ও রোগী উভয়ই একে অপরকে ভালোভাবে বুঝতে পারে। সুস্পষ্ট হয় তাদের ভূমিকা ও করণীয়। চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর সন্তুষ্টির মাত্রা বাড়ে। ডাক্তার ও রোগীর মাঝে ঐকমত্যের মাত্রা বাড়ে। রোগীদের মাঝে তাদের ডাক্তারকে বিশ্বাস করার প্রবণতা বাড়ে। অন্যদিকে ইন্টারমিডিয়েট সুফলগুলো হলো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ, আগ্রহ ও সম্ভাবনা বাড়ে। যথাযথ, কার্যকর ও প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়। রোগী ও তার স্বজনদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়ে। রোগ নিরাময় ও সুস্থ থাকার প্রশ্নে নিজস্ব দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ে। বৃদ্ধি পায় আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রকাশের সক্ষমতা।
অন্যদিকে প্রত্যক্ষ সুফলগুলো হলো : আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পাওয়া, রোগ নিরাময় সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাওয়া, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার মাত্রা তুলনামূলক কম হওয়া; মানসিক কল্যাণ নিশ্চিত হওয়া; বেদনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা, জীবনীশক্তির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, রোগী ও স্বাস্থ্যসেবাকর্মী তথা ডাক্তার-নার্স ও অন্যান্য কর্মীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রোগ নিরাময় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। প্রক্রিয়াটি কাজ করে বিভিন্ন উপায় বা পন্থার এক জটিল মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। আর সেই পন্থাগুলো হলো : নিউরোবায়োলজিক্যাল বা স্নায়ুজৈব পন্থা, ফিজিওলজিক্যাল বা শরীরবৃত্তীয় পন্থা, সাইকোলোজিক্যাল বা মনস্তাত্ত্বিক পন্থা, সমাজ-সাংস্কৃতিক পন্থা।
প্রথমেই বুঝে নেওয়া যাক রোগীর আরোগ্য লাভের প্রশ্নে স্নায়ুজৈব প্রক্রিয়ার কর্মপ্রণালিটি। বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে ডাক্তার-রোগীর মধ্যকার যোগাযোগ কার্যকর হলে রোগীর শারীরিক ও মানসিক চাপ কমে। রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বাড়ে। শারীরিক ব্যথা বা যন্ত্রণার অনুভূতি কমে। সমানুভূতি ও আবেগের প্রকাশকে সম্ভব করে। রোগীর মাঝে সংযুক্তিবোধ বা বিপদে পাশে অন্তত কেউ না কেউ আছেন এমন বোধের জন্ম হয়।
এখন প্রশ্ন হলো এসব কীভাবে কাজ করে? উত্তরটি বেশ জটিল। ডাক্তারের পক্ষ থেকে কার্যকর যোগাযোগ রোগীর লিম্বিক সিস্টেমকে সক্রিয় করে। বিশেষ করে অ্যামিগডালা ও হিপপোক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীলতা বৃদ্ধি পায়। মস্তিষ্কের এই দুটি অংশ আমাদের আবেগের জন্ম দেওয়া ও প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে যুক্ত। আমাদের শারীরিক ও মানসিক চাপের প্রতি সাড়া প্রদানকে নিয়ন্ত্রণ করে। এখান থেকেই নিঃসরণ হয় সেরোটোনিন, ডোপামিন ও অক্সিটোসিন। এসব হরমোন রোগ নিরাময়ের শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সরলভাবে বলতে গেলে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডাক্তারখানায় বিভিন্ন ইতিবাচক ও সমানুভূতিপূর্ণ বাচনিক ও অবাচনিক যোগাযোগ রোগীর বিভিন্ন স্নায়ুবিক ব্যবস্থা সক্রিয় হয়। ফলে হৃদযন্ত্রের গতির হার, রক্তচাপ ও করটিসল লেভেল কমে। ফলে রোগী এক ধরনের আরামবোধ করেন। রোগ নিরাময়ে এক ধরনের অনুকূল আবহ তৈরি হয়।
অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক ও মানসিক চাপে থাকলে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও মানসিক ক্ষত নিরাময় ক্ষমতা কমে যায়। মানবিক যোগাযোগ রোগীর দেহের হাইপোথালামিক-পিটিউইটারি-অ্যাড্রেনাল (এইচপিএ) অ্যাক্সিস-এর ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যোগাযোগের ফলে এই এইচপিএ অ্যাক্সিস করটিসল ও অন্যান্য চাপ উৎপাদনকারী হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এটি ক্রিয়াশীল হলে শারীরিক প্রদাহ ও মনোপীড়ার মাত্রা কমে যায়। ফলে রোগ নিরাময় ত্বরান্বিত হয়। এছাড়াও ইতিবাচক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া ও আবেগীয় প্রকাশের সঙ্গে রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতার প্রত্যক্ষ জোরালো সংযোগ আছে। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ায় ব্যক্তি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করলে দেহে সাইটোকিন হরমোনের উৎপাদন বেড়ে যায়। বাড়ে প্রাকৃতিকভাবে ঘাতক সেলের ক্রিয়াশীলতা। এছাড়া শরীর থেকে প্যাথোজেন দূর করে। শরীরের নতুন টিস্যু জন্ম হওয়ার প্রক্রিয়াকে গতিশীল করে।
মানব দেহে ভেগাস নামে এক ধরনের স্নায়ু আছে। ভাব ও আবেগের আদান প্রদানের সময় এই স্নায়ু ক্রিয়াশীল হয়। এই স্নায়ু আবার মস্তিষ্ক ও রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার মাঝে দ্বিমুখী যোগাযোগ পথ হিসেবে কাজ করে। এই ভেগাস স্নায়ুও সাইটোকিন, চেমোকিন ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধী হরমোনের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। ফলে যোগাযোগ আসলে মানবদেহে প্রদাহ ও আরোগ্য প্রক্রিয়াকেই প্রভাবিত করে।
আমাদের স্নায়ুতন্ত্র ব্যবস্থায় প্যারাসিম্প্যাথিক সম্পর্কজাল বা নেটওয়ার্ক আছে। থেরাপিউটিক কমিউনিকেশন বা নিরাময়ী যোগাযোগ এই প্যারাসিম্প্যাথিক নেটওয়ার্কের স্নায়ুগুলোকে সক্রিয় করে। এই স্নায়ুগুলো আবার মানব দেহে রক্তের প্রবাহ বাড়ায়; খাদ্য থেকে পুষ্টি পরিশোষণ করে; এবং আরাম বোধের জন্ম দেয়। এছাড়া শারীরিক ও মানসিক চাপ কিংবা বিপদের পর স্নায়ুবিক শিথিলতা অর্জনে সাহায্য করে। অন্যদিকে সমানুভূতিপূর্ণ যোগাযোগ ও পূর্ণাঙ্গ মনোযোগ দিয়ে সক্রিয়ভাবে শোনার ফলে রোগীর দেহে এনডোজেনাস ওপিয়েডস, এনডরফিন, অক্সিটোসিন ও অন্যান্য জৈবরসায়ন নিঃসরণ হয়। এসব জৈব রসায়ন দেহে ব্যথা উপশমকারী হিসেবে কাজ করে। কেননা এসব হরমোন নিঃসরিত হলে রোগী তার শরীরে তুলনামূলক কম ব্যথা অনুভব করে। ফলে ডাক্তারের পরামর্শমাফিক ওষুধ খাওয়া ও অন্যান্য পরামর্শ মেনে চলার প্রবণতা রোগীর মাঝে বাড়ে। আরোগ্যের প্রশ্নে সে অধিক ইতিবাচক প্রস্তুতি নেয়। ফলে রোগ নিরাময় প্রক্রিয়া তুলনামূলক সহজ ও দ্রুত হয়। এবার আরোগ্য প্রক্রিয়ায় যোগাযোগের সাইকোলোজিক্যাল বা মনস্তাত্ত্বিক ভূমিকাটি বুঝে নেওয়া যাক। ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য সেবাকর্মীর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ ও জোরালো নিরাময়ী বন্ধন রোগীর মনে এক ধরনের আস্থা ও নিরাপত্তাবোধের জন্ম দেয়। রোগী যখন অনুভব করে যে তার কথা-সমস্যা-আশঙ্কা ভালোভাবে শোনা হচ্ছে, গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে; ডাক্তার ঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করছে; চিকিৎসা সম্পর্কিত যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে; পছন্দ-অপছন্দকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে; জীবন ও মূল্যবোধকে শ্রদ্ধা করা হচ্ছে, তখন সে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয় ও সাড়া দেয়। তার এই আরোগ্য যাত্রায় তুলনামূলক কম একা বোধ করে। এর ফলে তার মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতার মাত্রা কমে যায়। ডাক্তারের সব পরামর্শ ও নির্দেশনা ঠিকমতো মেনে চলে।
বিভিন্ন শারীরিক অবস্থার ক্ষেত্রে ভিন্ন যোগাযোগ কৌশল কার্যকর বলে দেখা গেছে। যেমন দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা উপশমের ক্ষেত্রে রোগীর কথা মনোযোগ দিয়ে শোনা ও তার ব্যথার অভিজ্ঞতাকে আন্তরিকভাবে বুঝে ইতিবাচক সাড়া দিলে দ্রুত ব্যথা উপশম হয়েছে। এছাড়া রোগীকে মন খুলে কথা বলতে দেওয়া; আবেগের প্রকাশ করাকে উৎসাহিত করা; ব্যথার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যতটা সম্ভব ভালো থাকার কৌশল শেখানো ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে রোগীকে অগ্রাধিকার দিলে ভালো ফল পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ক্যানসার আক্রান্ত রোগীদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগের কৌশলগুলো হলো খারাপ সংবাদটি সমানুভূতি ও সমবেদনা-সহকারে দেওয়া; চিকিৎসার বিকল্পগুলো ও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রোগীর সঙ্গে সুস্পষ্ট ও সৎভাবে আলোচনা করা এবং চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় রোগীর পরিবার ও স্বজনদের যুক্ত করা। আর হৃদযন্ত্রের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর যোগাযোগ কৌশলগুলো হলো : জীবনশৈলীতে পরিবর্তন আনা ও চিকিৎসা পরামর্শ মেনে চলার ওপর জোর দেওয়া; রোগীর নিজস্ব জীবনবোধ, বিবেচনা, মূল্যবোধ, সমস্যার ও সুযোগের বিষয়টি ঠিকভাবে উপলব্ধি করার লক্ষ্যে প্রেরণাদায়ী সাক্ষাৎকার গ্রহণ কৌশল; রোগের অবস্থা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে রোগীকে সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য ভাষায় পরামর্শ দেওয়া এবং নিজের স্বাস্থ্য ও আরোগ্য প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য রোগীকে উৎসাহিত করা। ঠিক একইভাবে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, মৃত্যুপথযাত্রী রোগী, ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত রোগী, শ্বাসকষ্ট ও স্নায়ুবিক রোগ, যেমন - স্ট্রোক, পারকিনসন ইত্যাদি ক্ষেত্রে আলাদা যোগাযোগ কৌশল অবলম্বন করতে হয়।
আরোগ্যায়ন প্রক্রিয়ায় নিরাময়ী যোগাযোগ একটি বহুমাত্রিক ক্রিয়া ও কৌশল। এখানে বাচনিক, অবাচনিক ও মনস্তাত্ত্বিক মাত্রা আছে।
বাচনিক কৌশলের মধ্যে রয়েছে : রোগীকে এমনভাবে প্রশ্ন করা যাতে সে এক বা দুই শব্দে উত্তর দিয়ে না থেমে যায়। বরং তার অনুভূতি, আবেগ, রোগ, সমস্যা ও আশঙ্কার কথাগুলো বিস্তারিত বলতে পারে। এসব কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে আন্তরিকভাবে শোনা। এই শোনার সমস্যা হ্যাঁ বা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানো; রোগী যখন তার সমস্যার কথাগুলো বলবেন তখন কোনো কিছু না বুঝতে পারলে জানতে চাওয়া; রোগীর আবেগ ও রোগের অভিজ্ঞতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। রোগী যখন তার সমস্যার কথা বলবেন তখন তাকে মূল বিষয়ে মনোযোগ রাখতে সহায়তা করা; এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে সহজ-সরল-স্পষ্ট-বোধগম্য শব্দ ব্যবহার করা।
অন্যদিকে অবাচনিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কৌশলগুলো হলো : রোগীর চোখের দিকে যথাযথভাবে তাকিয়ে কথা বলা; এমনভাবে বসা যাতে করে রোগীর প্রতি ইতিবাচক ও অভ্যর্থনাসূচক বার্তা যায়; এবং রোগীর সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও বোধের সঙ্গে খাপ এমন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
আর মনস্তাত্ত্বিক কৌশলগুলোর মধ্যে রয়েছে : রোগীর প্রতি সমানুভূতিবোধের প্রকাশ করা; একেবারে শর্তহীনভাবে ইতিবাচক মনোভাব দেখানো; রোগীর সঙ্গে নিরাময়ী সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পেশাদারী সীমানা বজায় রাখা; পূর্বধারণা নয় বরং একেবারে খোলা মন নিয়ে কথা বলা; চিকিৎসা পরামর্শ কক্ষে এক ধরনের উন্মুক্ত আবহ তৈরি করা; রোগীর একান্ত সক্ষমতাকে শ্রদ্ধা করা।
এছাড়াও রোগীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেসব কৌশল নিরাময়ী ভূমিকা পালন করে তা হলো : রোগীর কথা বলা শেষ হওয়ার পরও তাকে কিছু না বলে চুপ থাকা। এসময়টুকুতে রোগীকেই নীরবতা ভাঙার সুযোগ দেওয়া। এই নীরবতার পর রোগী হয়তো নতুন কোনো বিষয় বা তথ্য দিতে পারেন। অন্যদিকে রোগীর সব কথাগুলো গ্রহণ করতে হবে। এই গ্রহণ করা মানে কিন্তু ক্লিনিক্যাল ইস্যুগুলো মেনে নেওয়া নয়। এটার মানে হলো তাকে কথা বলতে উৎসাহিত করা। তার চোখের দিকে বলা যে ‘হ্যাঁ, আমি বুঝেছি।’ কোনো ডাক্তার যদি রোগীর প্রেসক্রিপশনগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু আন্তরিকভাবে বলেন, ‘আমি দেখছি আপনি আপনার সব ওষুধই ঠিকমত খেয়েছেন।’ তাহলে রোগী কিন্তু মনে করবেন যে আরোগ্য প্রক্রিয়ায় তার চেষ্টাকে ডাক্তার স্বীকৃতি দিচ্ছেন। কাজেই রোগীর প্রতি অভিযোগ না করে বরং তাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এছাড়া রোগীর সঙ্গে আলোচনার শুরুটা এমনভাবে করতে হবে যাতে তিনি তার মনের আবেগ নিংড়ে সব কথা বলতে পারেন। যেমন, এক্ষেত্রে শুরুতেই বলা যেতে পারে, ‘বলুন তো কী সমস্যা আপনার? কী নিয়ে আজ কথা বলবেন?’ আর সেক্ষেত্রে খুবই জরুরি হলো মনোযোগ দিয়ে আন্তরিকভাবে সব কথা শোনা।
সেই মাফিক প্রয়োজনীয় সাড়া দেওয়া। এক্ষেত্রে ‘ও’, ‘আচ্ছা’, ‘হুম, হুম’, ‘তারপর’ ‘তারপর কী হলো’ এমন শব্দগুলো খুবই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। রোগী কোনও অস্পষ্ট তথ্য দিলে তাকে বলা যে, ‘হুম, কিন্তু আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবেন কী?’ রোগীর রোগ তথা সমস্যার একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকতে হলে তার পুরো বয়ানকে একটি সময় কিংবা পরম্পরায় সাজাতে হবে। তার কথা বলার ধরন, বসার ধরন, পোশাক, হাত নাড়ানো, মাথা নাড়ানো, লাল চোখ ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে সেই পর্যবেক্ষণ কোনোভাবে পূর্ব ধারণামূলক কিংবা পক্ষপাতমূলক হওয়া যাবে না।
রোগীর সঙ্গে এভাবে যোগাযোগ করলে ডাক্তার ও রোগীর মাঝে এক ধরনের আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। জোরদার হবে নিরাময়ী বন্ধন। রোগী মনে করবে যে তার কথা ডাক্তার ঠিকমতো শুনছেন, বুঝছেন, এবং সঠিকভাবে যত্ন নিচ্ছেন। ফলে তিনি ডাক্তারকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিতে উৎসাহিত হবেন। নিজের যত্ন নিতে আগ্রহী হবেন। মেনে চলবেন সব পরামর্শ ও নির্দেশনা। রোগ নিরাময় প্রক্রিয়ায় নিজেকে একা বোধ করবেন না। ডাক্তারের সঙ্গে তর্ক বা সংঘাতে জড়িয়ে পড়বেন না। ডাক্তার ও রোগীর মাঝে ভুল বোঝাবুঝির মাত্রা কমবে। ডাক্তার ও চিকিৎসা প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বাড়বে। কিন্তু উল্টোটি ঘটবে যদি রোগীর সঙ্গে কথা বলার সময় ডাক্তার বারবার প্রসঙ্গ বদলান, আক্রমণাত্মক বা অহংকারী ভঙ্গিতে কথা বলেন, গৎবাঁধা পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে বিচারমূলক মনোভাব নিয়ে কথা বলেন। কাজেই রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ এমনভাবে করতে হবে যাতে তারা মনে করেন যে ডাক্তার সঙ্গে কথা বলেই রোগ অনেকটা সেরে গেছে!
লেখক : সিনিয়র লেকচারার, মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব)
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য