অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণে আর্থিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়

এম এ খালেক
অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণে আর্থিক স্বাধীনতা বিপন্ন হয়

গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বক্তব্য দেন। সেই অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। মার্কিন অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কাক্সিক্ষত মাত্রায় কেন হচ্ছে না, সে সম্পর্কে তার গুরুত্বপূর্ণ মতামত উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিক্ষকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মার্কিন অধ্যাপকের বক্তব্য শ্রবণ করছিলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এক তরুণ শিক্ষক দাঁড়িয়ে মার্কিন অর্থনীতিবিদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা আমাদের অর্থনীতির ওপর নানাভাবে হস্তক্ষেপ করছেন বলেই আমরা কাক্সিক্ষত মাত্রায় উন্নয়ন অর্জন করতে পারছি না। মার্কিন অর্থনীতিবিদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর তরুণ অধ্যাপকের উদ্দেশে বলেন, যে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ৮০ শতাংশ অর্থ আমরা জোগান দিই, সেই অর্থনীতি কি আপনাদের নাকি আমাদের? আপনার যদি নিজস্ব উৎস থেকে উন্নয়ন কাজের অর্থায়ন করতে পারতেন তাহলে আমাদের পরামর্শ দেবার কোনো প্রয়োজন হতো না। তার এই বক্তব্য শুনে বাংলাদেশি তরুণ অধ্যাপক আর কোনো কথা না বলে বসে পড়েন।

এটাই বাস্তবতা। উন্নয়নের একটি পর্যায়ে বিদেশি ঋণের প্রয়োজন আছে; কিন্তু তাই বলে অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণনির্ভর হয়ে পড়া কোনোভাবেই একটি দেশের কাক্সিক্ষত হতে পারে না। কারণ ঋণগ্রস্ত জাতির সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো স্বাধীনতা থাকে না। তাকে পদে পদে অপমানিত-লাঞ্ছিত হতে হয়। কথায় বলে, ‘গবিব মানুষের বউ সবারই ভাবি।’ সম্পদহীন দেশকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়। বিদেশি সংস্থা থেকে ঋণগ্রহণ একটি দেশের অধিকার বটে। কারণ ঋণ গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট দেশটিকে সুদ সমেত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। আর দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো ঋণগ্রহণ করে বলেই উন্নয়ন সংস্থাগুলো তাদের ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে। ঋণ কোনো অনুদান বা কারও দয়া নয়। এটা এক ধরনের অধিকার; যা একটি দেশ ঋণের কিস্তি সুদসহ পরিশোধের মাধ্যমে অর্জন করে। স্বল্পোন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো যদি বিদেশি সূত্র থেকে ঋণগ্রহণ বন্ধ করে দেয়, তাহলে উন্নয়ন সহযোগীদের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাই তারা দুর্বল দেশগুলোকে ঋণ গ্রহণের জন্য নানাভাবে প্রলোভিত করে। বিশ্বব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) এই তিনটি ঋণদানের ক্ষেত্রে সবার শীর্ষে রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক এবং এডিবি ঋণদানকালে যেসব শর্ত দেয়, তা তুলনামূলকভাবে সহনীয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা পরোক্ষ শর্তারোপ করে; কিন্তু আইএমএফ যে শর্ত দেয় তা অত্যন্ত জটিল এবং একটি দেশ একান্ত বিপদে না পড়লে কখনোই আইএমএফের কাছে থেকে ঋণ নিতে চায় না। আইএমএফ মূলত ঋণদানের নামে সাম্রজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী দেশগুলোর স্বার্থ সুরক্ষা দেয় মাত্র।

আইএমএফ কোনো দেশকে শর্তহীন ঋণদান করে না। আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক মুক্তবাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমর্থক; কিন্তু তারা মুক্তবাজার অর্থনীতিকে শুধু পণ্য চলাচলের ক্ষেত্রে সীমিত করে রেখেছে। কারণ উন্নত দেশগুলোতে উৎপাদিত পণ্য যাতে দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল দেশের বাজারে অবাধে প্রবেশ করতে পারে, সেটাই তাদের মূল লক্ষ্য। তারা যদি সত্যিকারভাবে মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারক হতো তাহলে বিশ্বব্যাপী শ্রমশক্তির অবাধ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে কেন। শ্রমশক্তির অবাধ চলাচল সুবিধা দিলে দরিদ্র দেশগুলো থেকে ব্যাপক মাত্রায় শ্রমশক্তি উন্নত দেশগুলোতে অভিবাসন করবে। এটা তাদের স্বার্থের অনুকূলে নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে এমন কোনো কাজ আইএমএফ কখনোই করবে না।

আমাদের এলাকায় একটি প্রবাদবাক্য চালু আছে তা হলো, ‘গরম ভাতে বিলাই বেজার’। অর্থাৎ বিড়াল কখনোই গরম ভাতে মুখ দেয় না। কারণ সে জানে গরম ভাতে মুখ দিলে তার মুখ পুড়ে যেতে পারে। উন্নয়ন সহযোগীরা ঋণদানকালে বিভিন্ন শর্তারোপের ক্ষেত্রে এই নীতি অনুসরণ করে থাকে। তারা ঋণদানের ক্ষেত্রে সব দেশের বেলায় একই রকম শর্তারোপ করে না। দরিদ্র দেশের ক্ষেত্রে ঋণের শর্ত দেওয়া হয় অত্যন্ত কঠিন। আর তুলনামূলক উন্নত দেশের ক্ষেত্রে তাদের দেওয়া শর্ত হয় অত্যন্ত নমনীয়। কারণ তারা জানে শক্তিশালী অর্থনীতি সংবলিত দেশকে কঠিন শর্ত দিলে তারা ঋণ গ্রহণ করবে না। গত শতাব্দীর আশির দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি অতিমাত্রায় বিদেশি ঋণ নির্ভর হয়ে পড়েছিল। সেই সময় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৮০ শতাংশ অর্থায়ন আসতে বিদেশি ঋণ থেকে। সেই সময় অবস্থা এমন হয়েছিল যে, কোনো একটি ল্যাট্রিন তৈরি করলে তার দরজা কোন দিকে হবে তা বাতলে দিত উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে ম্যাটেরিয়াল ক্রয় করতে হতো তা নির্ধারণ করে দিতে ঋণদানকারী সংস্থাগুলো। পরামর্শকের নামে তারা নিজ দেশের মানুষকে আমাদের মতো দেশে প্রেরণ করত। তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হতো। কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য যে ঋণ দেওয়া হতো তার অন্যতম শর্ত ছিল তাদের দেশ থেকে কনসালট্যান্ট নিয়োগ দিতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, যেসব কনসালট্যান্ট বাংলাদেশে এসেছিল তাদের অনেকের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না।

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান একটি দেশ। এক সময় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাতের অবদান ছিল ৮০ শতাংশের মতো; কিন্তু উন্নয়ন সহযোগীরা কখনোই আমাদের কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য কোনো অবদান রাখেনি। বরং কীভাবে কৃষি খাতের উন্নয়ন বিঘ্নিত হবে তারা সেই কাজই করত। বাংলাদেশের কৃষকরা অত্যন্ত দরিদ্র। তারা চাইলেই নিজস্ব অর্থায়নে কৃষি যান্ত্রিকায়ন করতে পারে না। তাই সরকার কৃষি খাতের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে আসছে অনেক দিন থেকেই; কিন্তু আইএমএফ সব সময়ই কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদানের বিরুদ্ধে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আইএমএফ কৃষি খাতে ভর্তুকি বন্ধ করার জন্য ব্যাপক মাত্রায় সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে; কিন্তু সরকার তাদের সেই চাপকে উপেক্ষা করে কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখে। পরে বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারই কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রদান অব্যাহত রাখে। যে কারণে বাংলাদেশ এখন খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। নানা ধরনের বৈশ্বিক সঙ্কট সত্ত্বেও বাংলাদেশ কখনোই মারাত্মক খাদ্য সংকটে পতিত হয়নি। প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশ যদি খাদ্য উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এভাবে বাড়ছে কেন? খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি আর ভোক্তা পর্যায়ে তুলনামূলক স্বল্পমূল্যে খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার।

পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ; কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে চাইলেই প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন ও আহরণের মাধ্যমে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করা যায় না। প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও উত্তোলন এবং নতুন পণ্য উদ্ভাবন বা তৈরি করার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন হয়। তারচেয়েও বেশি দরকার পড়ে অর্থের। সেই অর্থ জোগাড় করাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করতে পারে, তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সাধন করতে পারে; কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় সম্পদ আহরণ করতে পারছে না। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও মাত্র ৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও অন্তত ২৩-২৪ শতাংশ হওয়া উচিত। যেহেতু অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে সম্পদ আহরণের পরিমাণ খুবই কম তাই উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য আমাদের বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ সর্বশেষ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদনের আগে অন্তত ১০ বছর এই সংস্থাটির নিকট থেকে কোনো ঋণগ্রহণ করেনি। ফলে তারা আমাদের ওপর কোনো কঠিন শর্ত চাপিয়ে দিতে পারেনি; কিন্তু সর্বশেষ ঋণ গ্রহণের ফলে সংস্থাটি বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে।

সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড শতাধিক পণ্যের ওপর ট্যাক্স ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। ফলে এই পণ্যগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পাবে; যা চূড়ান্ত পর্যায়ে বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে; কিন্তু অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, যেসব পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে তার ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে না। অর্থনীতি যদি তার নির্দেশনা মোতাবেক চলত, তাহলে কিছু বলার ছিল না। দেশের একজন অর্থনীতিবিদও নেই যিনি বলবেন, এই মুহূর্তে বিভিন্ন পণ্যের ওপর কর বাড়ানো যুক্তিসঙ্গত হয়েছে। কর হার না বাড়িয়ে বরং করের আওতা বাড়ানো প্রয়োজন ছিল। আইএমএফ অনুমোদিত ঋণ ছাড়ের শর্ত হিসেবে কর আদায় বৃদ্ধির কথা বলেছে। তাই এ মুহূর্তে সংস্থাটিকে দেখানো হবে, আমরা কর বৃদ্ধির মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি।

আমাদের মতো দেশে উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য নিজস্ব সূত্রের ওপর নির্ভর না করে বিদেশি ঋণ গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া হয়। তার কারণ হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে অর্থ সংগ্রহ করার বেশ কঠিন কাজ। এতে গণদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে। তাই সরকার চেষ্টা করে কিভাবে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়ন অর্থায়নের চাহিদা মেটানো যায়। আরও একটি ক্ষতিকর প্রবণতা প্রত্যক্ষ করা যায়। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নিজস্ব সম্পদ আহরণের চেয়ে বিদেশ থেকে সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানির প্রবণতা। যেমন, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ; কিন্তু প্রমাণিত গ্যাস মজুত দিয়ে আগামী ১২-১৩ বছরের চাহিদা মেটানো যেতে পারে। এর মধ্যে নতুন গ্যাস ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থা করা না গেলে দেশ বিপদে পড়তে পারে; কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে নতুন গ্যাস ক্ষেত্রে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের পরিবর্তে বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমা চিহ্নিত হলেও এখনো সেখানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের কোনো উদ্যোগ গৃহীত হচ্ছে না। বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করা হলে গোষ্ঠী বিশেষের কমিশন ভোগের সুযোগ থাকে।

বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করেছে তা মূলত অনুৎপাাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এসব ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, বাংলাদেশের গৃহীত বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১০ হাজার ৬৪ কোটি মার্কিন ডলার অতিক্রম করে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ১১ ট্রিলিয়ন বা ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমানে তা দ্বিগুনেরও বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ১২৯ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ৩২৮ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে ঋণের সুদ ও আসল বাবদ। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ৪০২ কোটি মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে। ২০২৯-২০৩০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের আসল এবং সুদ বাবদ পরিশোধ করতে হবে ৫১৫ কোটি মার্কিন ডলার। গত দশ বছরে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশি ঋণের ব্যবহার বেড়েছে আড়াই গুন। যেহেতু গৃহীত ঋণের প্রায় পুরাটাই অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় হয়েছে তাই এর মাধ্যমে রিয়েল সেক্টর প্রোডাকশন বাড়বে না। আগামীতে এমন এক সময় আসবে যখন নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক উন্নতি হয়েছে; কিন্তু এই উন্নয়নের পেছনে জাতিকে কিভাবে মূল্য দিতে হয়েছে তা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। ভারতে এক কিলোমিটার চার লেন সড়ক নির্মাণে যে ব্যয় হয় বাংলাদেশে তার চেয়ে চারগুন বেশি ব্যয় হয়েছে।

বর্তমানে বাংলাদেশকে ঋণদানের ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান চতুর্থ; কিন্তু চীনা ঋণের মাহাত্ম যারা বুঝেন তারা জানেন এর পরিণতি কি হতে পারে। চীন খুব সহজ শর্তে ঋণদান করে। এভাবে ঋণদানের মাধ্যমে একটি দেশকে ঋণের ফাঁদে আটকে ফেলা হয়। চীনা ঋণের পরিণতি কি হয তার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হচ্ছে শ্রীলঙ্কা। কাজেই আমাদের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিষয়ক লেখক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য