জ্বালানি খাতে নতুন ‘দায়মুক্তি’ কার স্বার্থে?

শুভ কিবরিয়া
জ্বালানি খাতে নতুন ‘দায়মুক্তি’ কার স্বার্থে?

শেখ হাসিনার শাসনামলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ছিল জবাবদিহিতাহীনতার অন্যতম খাত। এই খাতকেই ফ্যাসিস্ট শাসন তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সফল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

পরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহনসহ অন্যান্য খাতে সেটার বিস্তার ও বিস্তৃতি ঘটে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এই মডেলটি ফ্যাসিস্ট শাসনের রাজনৈতিক অর্থনীতিকেই শুধু পরিপুষ্ট করেনি, পুরো রাজনৈতিক সংস্কৃতিকেই স্বেচ্ছাচারী-দুর্নীতিপ্রবণ করে তুলেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের এই মডেলের ভিত্তি ছিল একটি কালো আইন। যে আইনটি সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থিই শুধু নয়, বরং সেটি ছিল জনস্বার্থক্ষুণ্নকারী ও দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিনাশকারী।

এই কালো আইনই শেখ হাসিনার সরকারের ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠার অন্যতম মালমসলা যোগানদারী উপাদান। এই কালো আইনকে প্রতিষ্ঠা ও বারংবার তার মেয়াদ বাড়ানোর মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদ শক্তিমান হয়ে ওঠে। ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে দ্রুতই এই কালো আইন বাতিলের দাবি ওঠে। সরকার কিছুটা কালক্ষেপণ করে। ইতোমধ্যে এই আইনের দুটি জনস্বার্থবিঘ্নকারী ধারা উচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং আদালত তা বাতিল করে। পরে সরকার এই আইনকে রহিত বা বাতিল করে অধ্যাদেশ দেয়। কিন্তু সেই অধ্যাদেশে এমন দুটি অনুচ্ছেদ যুক্ত করে; যা পূর্বের আইনের চেয়েও ভয়ংকর। এটা শুধু জনস্বার্থক্ষুণ্ন করেনি, বরং জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার মূল স্পিরিট ও আকাক্সক্ষাকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। কিন্তু ড. ইউনূসের সরকার এই জনস্বার্থ পরিপন্থি অবস্থানে কেন? এটা কি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের দুর্নীতিপ্রবণ অলিগার্ক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা? নাকি, এর অন্তরালে আছে এই সরকারকে অজনপ্রিয় করে বিপথগামী করার কোনো অন্তর্ঘাতমূলক আমলাতান্ত্রিক প্রচেষ্টা? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে দেখি এই দায়মুক্তির আইনে আসলে কি ছিল এবং বাতিলের পর কী দাঁড়াল।

কালো আইনের ইতিহাস ও বিবর্তন : এই আইন ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪ নং আইন)’ নামে পরিচিত হলেও জনপরিসরে এটি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ‘দায়মুক্তির আইন’ হিসেবে কুখ্যাতি পায়। ২০১০ সালে ২ বছরের জন্য এই আইন প্রণীত হলেও পরে চার দফায় ১৬ বছর এই আইনের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়।

এই আইনের পরিকল্পনা বা প্রস্তাবের প্রচার উপশিরোনামে ৬ (২) উপধারায় বলা আছে, উপ-ধারা (১) এ যা কিছুই থাকুক না কেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রীর সম্মতি গ্রহণক্রমে যেকোনো ক্রয়, বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা প্রস্তাব ধারা ৫ এ বর্ণিত প্রক্রিয়াকরণ কমিটি সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে উক্ত কাজের জন্য মনোনীত করে ধারা ৭ এ বর্ণিত পদ্ধতি অনুসরণে অর্থনৈতিক বিষয় বা সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। অর্থাৎ প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার বা দর প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে সীমিত সংখ্যক অথবা একক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ ও দরকষাকষির মাধ্যমে মন্ত্রীর সম্মতিক্রমে কাজ দেওয়া যাবে।

এই আইনের আদালত ইত্যাদির এখতিয়ার রহিতকরণ উপশিরোনামে (৯) ধারায় বলা আছে, এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোন কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোন আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আইনের ৬ (২) ও ৯ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক ও আইনজীবী তাইয়্যেবুল ইসলাম সৌরভ।

২০২৪ সালের ১৪ নভেম্বর বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরী হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আইনের ৬ (২) ও (৯) উপধারা অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ২৮ নভেম্বর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪ নামে অধ্যাদেশ জারির (অধ্যাদেশ নং ১৫, ২০২৪) মাধ্যমে এই দায়মুক্তি আইন রহিত করে।

অধ্যাদেশে নতুন ‘দায়মুক্তি’ : এই কালো আইন বাতিলের কথা বলে সরকার রহিতকরণ অধ্যাদেশের ২ নং (অধ্যাদেশ নং ১৫, ২০২৪) অনুচ্ছেদের (২) (ক), (খ) ধারায় নতুন দায়মুক্তির বিধান যুক্ত করেছে। সেখানে বলা হয়েছে- ২০১০ সনের ৫৪ নং আইন রহিতকরণ ও হেফাজত।

(১) বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০ (২০১০ সনের ৫৪ নং আইন), অতঃপর উক্ত আইন বলিয়া উল্লিখিত, এতদ্বারা রহিত করা হইল।

(২) উক্ত আইন রহিতকরণ সত্ত্বেও - (ক) উক্তরূপ রহিতকরণের অব্যবহিত পূর্বে উক্ত আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তি বা সম্পাদিত চুক্তির অধীন গৃহীত কোনো ব্যবস্থা বৈধভাবে সম্পাদিত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে; (খ) উক্ত আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তির অধীন চলমান কোনো কার্যক্রম এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে অথবা নিষ্পন্ন করিতে হইবে যেন উক্ত আইন রহিত হয় নাই; অর্থাৎ অতীতের দায়মুক্তির আইনে করা সব প্রজেক্টকে বৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং সেগুলো চলমান থাকবে। তার মানে সরকার দায়মুক্তি আইন রহিত করল বটে, কিন্তু আগের সব পাপকে পুণ্য হিসেবে গণ্য করলো। এটা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি; ভোক্তার ন্যায্য অধিকারের প্রতি অবিচারের শামিল; জ্বালানি সুবিচারের লঙ্ঘন। ন্যায্য জ্বালানি রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করে এই অধ্যাদেশ ভয়ংকর বাজে নজির স্থাপন করল। কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ইতোমধ্যে এই অধ্যাদেশের (২)(২)(ক) ও (২)(২)(খ) ধারা দুটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে তা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে জনস্বার্থে রিট করেছে। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত ইতোমধ্যে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে এই দুটি ধারা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই মর্মে রুল দিয়েছেন।

দায়মুক্তি কার স্বার্থে? প্রশ্ন হলো, সরকার এমন সিদ্ধান্ত কেন নিল? কার স্বার্থ রক্ষায় এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে হলো? কারা এর পিছনে কলকাঠি নাড়ল? কারা সরকারকে অজনপ্রিয় করতে এমন জনস্বার্থবিরোধি সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করল?

১. শেখ হাসিনার আমলে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় আদতে স্বৈরাচারের মানসিকতাই বহন করে। দুঃশাসনের চালিকাশক্তি হিসেবে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসাধু আমলাতন্ত্র, অসাধু ব্যবসায়ী ও অসাধু রাজনীতিবিদদের এক দেশবিরোধী নেক্সাস। এরা অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি করে জনগণের স্বার্থের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠা করেই লুটপাট চালিয়েছে। লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা তৈরি করে এই অলিগার্ক শ্রেণি জনগণের অধিকার ভূলুণ্ঠিত করেছে।

এরা প্রান্তিক মানুষের স্বার্থের বদলে করপোরেট ও লুণ্ঠনকারীদের স্বার্থ দেখেছে। তাদের কারণেই প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ২০০৯-২০১০ সালে যেখানে ছিল ২ টাকার কিছু বেশি, সেটা ২০২৩-২০২৪ সালে এসে দাঁড়ায় ১১ টাকার উপরে। তাদের কারণেই বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দেশীয় সক্ষমতা হারিয়ে আমদানির বাজারে পরিণত হয়েছে। এই অলিগার্ক শ্রেণিই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির পাবলিক খাতকে ক্রমশ দুর্বল করে সংস্কারের নামে বেসরকারি খাতকে পুষ্ট করেছে। তারাই বছরের পর বছর বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি করেছে। এই লুণ্ঠন অব্যাহত রাখতেই এবং ফ্যাসিস্ট আমলের দুর্বৃত্তদের অপরাধের বিচারের বাহিরে রাখতেই নতুন করে এই কালো আইনের সুরক্ষা দিয়েছে।

২. বিদেশি পরামর্শে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেশের সক্ষমতা বিনষ্ট করে বেসরকারিকরণসহ এই খাতকে বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত করে অবাধ লুটপাটের যে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাদি নেওয়া হয়েছে, সাবেক জ্বালানি সচিব হিসেবে কাজ করা জ্বালানি উপদেষ্টা সেই চক্রকে ভাঙতে উৎসাহী না। সে কারণে ১১টি বিষয়ে সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কোনো কমিশন আজও গঠিত হয়নি। অথচ এই খাতই ছিল লুটপাট ও টাকা পাচারের অবাধ ক্ষেত্র। সাবেক জ্বালানি সচিবের জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন যে স্বার্থসংঘাতমুক্ত নয়, সেটা এরকম জনবিরোধী সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে।

৩. ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মূল স্পিরিট ছিল বৈষম্য বিলোপ। কিন্তু জ্বালানিখাতে সবরকম প্রতিযোগিতা বন্ধ করে, অলিগার্ক গোষ্ঠিতন্ত্রের হাতে এককভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের লুটপাট নিশ্চিত করতেই এই বৈষম্যমূলক কালো আইন নতুন করে করা হয়েছে।

৪. প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রা রুখতেই এই সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরতন্ত্রের দোসর অসাধু আমলাতন্ত্র-অসাধু ব্যবসায়ী-অসাধু রাজনীতিবিদদের নেক্সাসই এলিট শ্রেণির মোড়কে জ্বালানি উপদেষ্টার পৌরহিত্যে নতুনভাবে আবির্ভূত হয়েছে। যারা গত ১৭ বছরের লুটপাটের বিচার তো চায়ই না, বরং এই খাতের ওছিলায় দায়মুক্তির আইন রহিতকরণের মোড়কে নতুন কালো আইন জারি করে পাচারকৃত অর্থের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।

পুনশ্চ : বিদ্যুৎখাতের দায়মুক্তি আইন রহিত করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেখানে আওয়ামী আমলের সব অনাচার-দুর্নীতি-অপরাধকে বিচারের আওতায় আনার কথা, সেখানে নতুন করে আইনি সুরক্ষা দিয়ে এই নতুন পাপাচার প্রমাণ করে, সরকারের ঘরেই রয়েছে স্বৈরাচারের ভূত। বলা ভালো, এই ভূত তাড়ানোর বদলে সরকার সযত্নে তাদের রক্ষা করছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য