মধ্যপ্রাচ্য সংকট : বাইডেন ব্যর্থ, ট্রাম্প কী পারবেন?

ইমরুল শাহেদ
মধ্যপ্রাচ্য সংকট : বাইডেন ব্যর্থ, ট্রাম্প কী পারবেন?

ধারণা করা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা বা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে অবশ্যই সফল হবেন। তিনি ক্ষমতায় আসার আগেই হামাস-ইসরায়েল, হিজবুল্লা-ইসরায়েল এবং হুথি, ইসলামিক জেহাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য বিদ্রোহী বা ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর যুদ্ধে গাজা এবং ইসরায়েল উভয়পক্ষই বিধ্বস্ত হয়েছে। তার মধ্যে গাজা পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধবিরতির পর গাজার ক্ষুধার্ত মানুষগুলো ঘরবাড়িতে ফিরে আসার পরও আশ্রয়হীন। মানবিক কারণেই গাজার প্রতি বিশ্বনেতা হিসেবে ট্রাম্পের একটা দায়বদ্ধতা আছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা গুড়ে বালি। কারণ তিনি শপথগ্রহণের পরই বলেছেন, গাজার যুদ্ধবিরতিতে তিনি আস্থাশীল নন। এটাকে অনেকেই এক ধরনের উস্কানি বলে মনে করছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জোট বাঁচিয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য এমনিতেই যুদ্ধ লাগিয়ে রাখার জন্য পাঁয়তারা করছেন। তার উপর ট্রাম্পের অভয় বাণী তাকে আরো বেপরোয়া করে তুলতে পারে।

ইতোমধ্যেই নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি লংঘন করে গাজায় ট্যাংকের গোলা ছুঁড়েছেন। একই সঙ্গে পশ্চিম তীরে সন্ত্রাসী আটক করার অজুহাতে জেনিনে সেনা অভিযান শুরু করেছেন। গাজার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির শর্ত হিসেবে ইসরায়েলি বন্দিশালা থেকে ৯২ জন ফিলিস্তিনিকে মুক্ত করার পর পশ্চিম তীর থেকে ধরে নিয়ে গেছে ৬৪ জনকে। ফিলিস্তিনে তাণ্ডব চালানো বা প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রাখা ইসরায়েলের যেন মজ্জাগত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। তার সঙ্গে নতুনভাবে যুক্ত হতে যাচ্ছে ট্রাম্পের উসকানি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও শপথ নেওয়ার পরপরই নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন এবং ইসরায়েলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।

গ্রীক দার্শনিক হেরাক্লিটাস বলেছেন, আপনি একই নদীতে দুবার পা রাখতে পারবেন না। ২০২১ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মধ্যপ্রাচ্য রেখে গিয়েছিলেন ২০২৫ সালের সেই মধ্যপ্রাচ্য এক নয়। বলা যায় একেবারেই আলাদা। মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনা দ্রুতই প্রবাহিত হয়ে চলেছে; যা হঠাৎ করে বোঝার উপায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যের চলমান বিভিন্ন সংকটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতন। সেটিও একটা পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।

২০২১ সালে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটা স্থিতিশীল ভারসাম্য বজায় ছিল। আপাতদৃষ্টিতে সেটাই মনে হয়েছে। কিন্তু গত বছর অক্টোবর মাসে সেটা ভেঙে গেছে। হামাস হঠাৎ ইসরায়েলে আক্রমণ করে কিছু বাসিন্দাকে জিম্মি করলে ইসরায়েল যুদ্ধ ঘোষণা করে হামাসের বিরুদ্ধে। পরে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুরু হয় হিজবুল্লার সঙ্গে। পরোক্ষে এই যুদ্ধ চলে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে। কারণ হামাস ও হিজবুল্লার নেপথ্য শক্তি হলো ইরান। এই নিয়ে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে। বাশার আল আসাদের পতন হলো মধ্যপ্রাচ্যে বিরাজমান সংকটের যে গভীরতা তৈরি হয়েছে তার আংশিক পরিণতি এবং ক্ষমতার নতুন ভারসাম্যহীনতারও একটা প্রতিফলন।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা যেমনÑ ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে, তেমনি কিছু সুযোগও তৈরি করেছে। ট্রাম্প প্রশাসনকে ঝুঁকি এবং সুযোগ - দুটোর সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। ঝুঁকি হলো ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের সামরিক শক্তি বাড়ানো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। পরে উপসাগরীয় অঞ্চলে তেলের শিপিং এবং উৎপাদন সুবিধাগুলো আক্রান্ত হলে বৈশ্বিক এনার্জি ও অর্থনীতির ওপর চাপ পড়তে পারে। এই ঝুঁকির বিপরীতে ইরান দ্রুতই তার পরমাণু শক্তি বাড়ানোতে তড়িঘড়ি শুরু করতে পারে। এক্ষেত্রে ইরানের অবশ্যই লক্ষ্য হবে, দেশটিকে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে মোকিবলার সামর্থ্য অর্জন। আর সুযোগ হলো, যদি ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে কূটনৈতিক পন্থায় বশে আনা যায়, তাহলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের ভালো জিনিসগুলো বিনা দ্বিধায় মেনে নেবে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লোগান নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেবে সেদিকে সকলের নজর। ২০২৫ সালে এসে প্রথম তিন মাসের জন্য জরুরিভাবে প্রয়োজন সিরিয়ায় আসাদ সরকারের আকস্মিক পতনে যেসব ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সর্বাগ্রে সে ঝুঁকি হ্রাস করার বিষয়ে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। আসাদ এবং তার পিতা গত অর্ধ শতাব্দী ধরে লেভান্টের উপর একটি দীর্ঘ এবং অন্ধকার ছায়া ফেলেছে। এজন্য সিরিয়ানরা আসাদের পতনকে উদযাপন করেছে। ট্রাম্প হয়তো বলতে পারেন যে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। সিরিয়ায় একটি সফল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ইরান ও রাশিয়ার পরাজয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের কেন্দ্রস্থল থেকে আসাদের প্রস্থানকে একীভূত করবে। একইসঙ্গে সিরিয়ানদের নিজেদের জন্য স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন গড়ে তোলার সুযোগ দেবে এবং তাদের আঞ্চলিক প্রতিবেশীদেরও তা করার সুযোগ দেবে। অন্যদিকে সিরিয়ার এই রূপান্তর ব্যর্থ হলে তা অতীতের মতো দেশটিকে আবারও গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাহলে ইরান ও রাশিয়া দেশটিতে পুনরায় ফিরে আসার সুযোগ পাবে। তাতে মার্কিন মিত্র কুর্দিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি আইএসআই’র বড় ধরনের উত্থান ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে তুরস্ক, ইউরোপীয় ও আরব দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে একটা সফল পরিবর্তন আনতে পারে। তাতে খরচ কম। কিন্তু ব্যর্থতার খরচ অনেক বেশি হবে।

ট্রাম্প শেষবার হোয়াইট হাউস ত্যাগ করার সময় যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তার তুলনায় আজকের মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ফিলিস্তিন ইস্যু তীব্রভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ২০২০ সালে তার প্রশাসন ইজরায়েল এবং বেশ কয়েকটি আরব দেশের মধ্যে আব্রাহাম অ্যাকর্ডস স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির উপসংহারে পৌঁছেছিল। এই চুক্তিগুলি মূলত ফিলিস্তিন ইস্যুকে এড়িয়ে গেছে। ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং অনেক আরব নেতা ভুলভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি আর কেন্দ্রীয় ছিল না এবং ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েল-আধিপত্যের স্থিতাবস্থা স্থিতিশীল এবং এখানেই থাকবে। সিরিয়ায় আসাদ-আধিপত্যের ওপর সিলমোহর তারাই দিয়েছেন।

আজ ডানপন্থি নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন সরকার গত বছরের হামাসের আক্রমণকে কাজে লাগিয়েছে। প্রথমত, গাজা উপত্যকা এবং উপত্যকার বাসিন্দাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার জন্য একটি একতরফা যুদ্ধ ৪৬৯ দিন চালিয়েছে, দ্বিতীয়ত, পশ্চিম তীরের বেসামরিক জনগণের উপর চাপ তৈরি করছে। কিন্তু এই যুদ্ধ বৃহত্তর আরব ও মুসলিম বিশ্বে গাজার বেসামরিক জনসংখ্যার ধ্বংসলীলা ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সমর্থনে জনমতকে এমনভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছে যা বিগত কয়েক দশক ধরে দেখা যায়নি।

ট্রাম্প প্রশাসন আব্রাহাম অ্যাকর্ডের দেশগুলোতে (বাহরাইন, ইসরায়েল, আরব আমিরাত) সৌদি আরবকে যুক্ত করতে আগ্রহী হবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিবে তখনই যখন পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেটেলারদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়িয়ে অংশ বিশেষ ইসরায়েলের সংযুক্ত করতে চাইবে। আর গাজায় দখলদারিত্ব বজায় রাখার অভিনাষও থাকতে পারবে না। এতে ফিলিস্তিন ইস্যুকেই কবর দেওয়া হয়।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতহানিয়াহু যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পরেও যুদ্ধ লাগিয়ে রাখার পায়তারা করছেন। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর বন্দি বিনিময়ও শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে হামাস দুই দফায় সাতজন বন্দিসেনাসহ সাতজন ইসরায়েলিকে মুক্তি দিয়েছে। সর্বশেষ চার সেনার মুক্তির বিনিময়ে ইসরায়েল দুশোজন ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু নেতানিয়াহু শর্ত দিয়েছেন তাদের ফিলিস্তিনে ফিরতে পারবেন না। মুক্তি পাওয়া এসব ফিলিস্তিনিরা প্রায় সবাই হাই-প্রোফাইল বন্দি। তাদের কেউ মৃত্যুদণ্ড পাওয়া, কেউবা ইসরায়েলিদের হত্যার অভিযোগে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া। তাহলে তাদের ঠাঁই হবে কোথায়? তিউনিসিয়া, তুরস্ক এবং আলজেরিয়া তাদের আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে।

এরমধ্যেই হামাস-ইসরায়েল নিয়ে আসল চেহারায় ফিরে এসেছেন ডোনাল্ড ট্রম্প। তিনি জর্ডান ও মিসরকে আরও ফিলিস্তিনিদের গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন। জর্ডানের রাজা এবং মিসরের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন ট্রাম্প। সেখানেই তিনি তাদের প্রতি ওই পরামর্শ দেন। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, গত ১৫ মাসে ইসরায়েলের ক্রমাগত হামলায় গাজার মানবিক পরিস্থিতির বেশ অবনতি হয়েছে। ইসরায়েলি হামলায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হওয়ার পর কাতার, মিসর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে রাজি হয়েছে হামাস ও ইসরায়েল। কিন্তু গাজার বর্তমান অবস্থা এতটাই নাজুক যে সেখানে প্রবল খাদ্য সংকটে সময় পার করছেন ঘরবাড়ি হারানো গাজাবাসী। মূলত এমন পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করেই ট্রাম্প ওই পরামর্শ দিয়েছেন। তবে ওই পরামর্শ দীর্ঘস্থায়ী নাকি অস্থায়ী সে বিষয়ে তিনি বলেন, এর যেকোনোটি হতে পারে।

গাজার মানবিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। প্রশ্ন হচ্ছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও বাস্তুহারা গাজাবাসীকে শরণার্থী শিবিরগুলোতেই আশ্রয় নিতে হচ্ছে। যদিও গত বছর ওয়াশিংটন বলেছিল তারা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার বিরোধিতা করে। একজন আরব উপসাগরীয় কর্মকর্তা বলেছেন, তার দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে জড়িত হতে আগ্রহী। কিন্তু ইসরায়েল যদি ফিলিস্তিনিদের স্থায়ী অধীনতা ছাড়া কোন বিকল্প প্রস্তাব না করে তাহলে সেটা সম্ভব নয়। শতাব্দী-প্রাচীন এই দ্বন্দ্বের সমাধান আগে করা প্রয়োজন।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মন্তব্য