বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত মোট ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে সংবিধান সংস্কার বা পুনর্লিখনের দাবি ওঠতে থাকে। অন্তর্বর্তী সরকার অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করে, উক্ত কমিশন কিছুদিন আগে সংবিধান সংশোধনের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাদের সুপারিশে সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের সুপারিশ বা প্রস্তাব জাতীয় সংসদে পাস না হওয়া পর্যন্ত সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে থাকবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।
বাহাত্তরের সংবিধানে মূলনীতি হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ অন্তর্ভুক্ত ছিল, ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের সামরিক আদেশে তা বাতিল হয়ে যায় এবং ১৯৭৯ সনে পঞ্চম সংশোধনীর দ্বারা সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে’ রাষ্ট্রের ‘সকল কাজের ভিত্তি’ বলে উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীকালে ২০১১ সনে আওয়ামী লীগের শাসনামলে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে আবার ধর্মনিরপেক্ষতা মূলনীতি হিসেবে প্রতিস্থাপন করা হয়। সংস্কার কমিশন এবার সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘বহুত্ববাদ’ বসানোর প্রস্তাব করেছে। কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে ধর্মনিরপেক্ষতার চেয়ে বহুত্ববাদ অনেক বেশি অন্তর্ভুক্তিমূলক।
১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির আমলে কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের দাবি না থাকা সত্ত্বেও ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ করে বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। একই সংশোধনীর মাধ্যমে হাইকোর্ট বেঞ্চকে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপনের বিধানও করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করে দিলেও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্মের সংযুক্তি বাতিল করেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে ইসলামের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল। কারণ তারা জানে, জাতীয় পার্টির যিনি সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন তিনি ধর্মপ্রীতি থেকে এ কাজটি করেননি।
প্রকৃতপক্ষে অবৈধ ক্ষমতা ও দখলদারিত্ব জায়েজ করার জন্যই এই অপকর্ম করা হয়েছে; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে সব রাজনৈতিক দল বিরোধিতা করছিল সেই সব দল ক্ষমতায় গিয়েও এ ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনেনি, সব দলই মনে করেছে ইস্যুটি স্পর্শকাতর, রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বাদ দেওয়া হলে ভোট কমে যাবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাতিল করার একটা সুযোগ এসেছিল, কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের অনুভূতির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস করেনি। ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্যান্য ধর্মের সমঅধিকারের কথা বলা হলেও ইসলামকেই রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল রাখা হয়। সম্ভবত একই কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের সংবিধান সংস্কার কমিশনও রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ, অর্থাৎ রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ থেকেই যাচ্ছে।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমঅধিকার নিশ্চিত করবে বলে সংবিধানে উল্লেখ আছে। তারপরও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসাই হচ্ছে গণতন্ত্র। ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে অতীতে জাতিতে জাতিতে বহু সংঘাত হয়েছে, অনেক যুদ্ধ হয়েছে; ধর্মের নামে মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুন্ঠিত হয়েছে। মনুষ্যত্ব, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ভূলুন্ঠিত হওয়ার প্রধান কারণ বিভিন্ন ধর্মের রীতিনীতি পরষ্পর বিপরীতমুখী এবং বিপরীতমুখী বলেই একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির পক্ষে সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধাবোধ দেখানো সম্ভব নয়।
পাকিস্তান আমলে ধর্মের নামে অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ প্রত্যক্ষ করে বাংলার মানুষ রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে বিমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; কিন্তু রাজনীতির কুশীলবরা অঘটন ঘটন পটিয়সী; তারা পারে না এমন কোন কাজ নেই। তারা দেখেছে, জনগণকে ইহজাগতিক প্রাপ্য ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রে ধর্মের গুরুত্ব বাড়াতে হবে। ভোটপ্রার্থী কিছু রাজনৈতিক দল অনুধাবন করল, ব্যক্তিগত জীবনে ধর্ম পালন করার খুব প্রয়োজন পড়ে না, শুধু ধর্মের কথা বললেই ভোট পাওয়া যায়। ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যের কারণে ভারতবর্ষে অনেক অঘটন ঘটেছে। গুপ্ত যুগ ও সেন আমলে বৌদ্ধধর্মের প্রায় বিলুপ্তি ঘটলেও পাল আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ঘটে। একইভাবে সেনদের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনর্জাগরণ ঘটে। আওরঙ্গজেব ছাড়া মুঘল সম্রাটরা ধর্মের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ ছিলেন; তাদের রাজ দরবারে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের লোক ছিল। শুধু তাই নয়, সম্রাট আকবর সব ধর্মের সমন্বয়ে একটি আলাদা ধর্মের প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। মোগল শাসনামলে সুফিদের খানকাগুলো হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মানুরাগীদের আকৃষ্ট করতো। ইংরেজদের শাসনামলে কোম্পানি থেকে শাসন ক্ষমতা নিয়ে রাণী ভিক্টোরিয়া ধর্মনিরপেক্ষ থাকার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের জাতির পিতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ শুধু নিজে নয়, রাষ্ট্রকেও ধর্মনিরপেক্ষ রেখেছিলেন। ধর্ম সম্পৃক্ত থাকায় জিন্নাহ তুরস্ক কেন্দ্রিক খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন করেননি। ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা ধর্মীয় রাষ্ট্র রক্ষায় জিন্নাহর কখনো উৎসাহ ছিল না। তিনি মহাত্মা গান্ধীকেও মুসলিম ধর্মীয় নেতা ও তাদের অনুগামীদের ধর্মান্ধতায় উৎসাহ দিতে নিষেধ করেছিলেন। রাজনীতি আর ধর্মকে এক করে ফেলার জন্যও তিনি গান্ধীকে দোষারোপ করেছিলেন। তিনি সুস্পষ্ট করে বলেছিলেন, পাকিস্তানের নাগরিকদের ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী তাদের নিজ নিজ উপাসনালয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা রয়েছে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের করণীয় কিছু নেই। তিনি আরও বিশ্বাস করতেন, ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এবং মানুষের মধ্যকার একটি বিষয়, রাজনীতির মধ্যে কখনো ধর্মকে আসতে দেয়া বাঞ্ছনীয় নয়। পাকিস্তানের জন্য দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি বেশি দিন বাঁচেননি। তার অবর্তমানে ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধানে ‘ইসলাম’ হয়ে গেল পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম। একই পরিণতি হলো বাংলাদেশের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশ হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র; কিন্তু বেশি দিন থাকতে পারলো না; পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে সংঘটিত পটপরিবর্তনে ধর্ম আবার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হলো।
ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ নাও হতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সমীচীন ও বাঞ্ছনীয়। আমাদের বুঝতে হবে যে, রাষ্ট্র লেখাপড়া করতে পারে না, রাষ্ট্রের কোনো জ্ঞান-গরিমা নেই, রাষ্ট্রকে ধর্মগ্রন্থ পড়তে হয় না, রাষ্ট্র একটি নৈর্ব্যক্তিক প্রতিষ্ঠান বিধায় ধর্মীয় নির্দেশনা পরিপালনের সামর্থও নেই এবং এসব কারণেই পরকালে রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হবে না। পরকালে জবাবদিহি করতে হবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের, তাই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কখনো তার নাগরিকদের ধর্মনিরপেক্ষ হতে বাধ্য করে না। রাষ্ট্রের একজন নাগরিক তার অন্তর্গত বিশ্বাস থেকে তার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ভাবতেই পারেন, এই ভাবনায় অন্যের লাভ-লোকসান হওয়ার সম্ভাবনা কম। মুশকিল হয় তখন, যখন ব্যক্তির ভাবনা রাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতাই যদি রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার একমাত্র নিয়ামক হয় তাহলে বিশ্বের কয়েকটি দেশের নাস্তিক্যবাদকে সে দেশের রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিতে হবে।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের চোখে এক ও অভিন্ন। তাই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় কোন ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম গণ্য করে অন্য ধর্মের ওপর প্রাধান্য দেওয়া বেমানান। তবে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি থাকলেও রাষ্ট্রের নাগরিকদের অসৎ রাজনীতির কারণে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতা হারায়। ভারত ও বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার বহাল থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের নির্যাতন বা তাদের নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগ থামছে না। তবুও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানে সকল নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীন আইন থাকা দরকার। তাই সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ছাঁটাই করে দিয়েও বলতে বাধ্য হয়েছেন, সংবিধানের মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার উপস্থিতি সংখ্যালঘুদের ‘রক্ষাকবচ’ ও ‘শক্তি’ হিসেবে কাজ করে। ধর্মনিরপেক্ষ মানে সব ধর্মের প্রতি সমান আচরণ নয়, ধর্মনিরপেক্ষ মানে রাষ্ট্র কোনোভাবেই কোনো ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না।
শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মকে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রাধান্য দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ধর্মের প্রতি বৈষম্য করা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের মনে জন্ম নিয়েছে অবিশ্বাস ও সন্দেহ। তাই নেতা-নেত্রীদের বক্তৃতা, বিবৃতিতে প্রীতি আর সহাবস্থানের সুললিত বাণী উচ্চারিত হলেও অন্তরের মিলন আর হয় না, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে পাহারা দিয়ে রক্ষা করতে হয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইসলামকে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রেখে দিয়ে বৈষম্যবিরোধী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কমিশন বৈষম্য অবসানের কোনো চেষ্টাই করেনি। তাহলে কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এত ত্যাগ তিতিক্ষা নিরর্থক ও বায়বীয়?
লেখক : সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক
মন্তব্য