-->

উপহার

তাসকিনা ইয়াসমিন
উপহার
হ্যাপি ভ্যালেনটাইনস ডে

এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন চারপাশ। তবু ছাদের আলো বেশ উজ্জ্বল। টর্চ ছাড়াই দেখা যাচ্ছে সব ফুল গাছগুলো। মম গাছগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখল, না আজ সবগুলো গাছে পানি দেবার দরকার নেই। শুধু তুলসী গাছগুলোতে দিলেই হবে। তুলসীরা ভীষণ পানি খেতে পছন্দ করে। পানির পরিমাণ সামান্য কম হলেই নেতিয়ে পড়ে।

মম গাছগুলোতে পানি দেয়া শুরু করল। এখন মাঘ মাস। কিন্তু হলে কি হবে? আজ তেমন হাড় কাঁপানো কনকনে ঠান্ডা নেই। বড় বড় গাছগুলো সব কাটা পড়ছে। আর সেগুলোর বদলে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি হচ্ছে। সেই বিল্ডিংয়ে থাকছে সব নব্য ধনীরা। বড় বড় গাছ নেই। আর তাই কুয়াশারা ঝরে পড়ার সুযোগই পায় না। শীতও অনুভূত হয় না। মম তুলসী গাছগুলোর তৃষ্ণা মেটায় আর তার চোখের সামনে বদলে যাওয়া প্রকৃতিকে অনুভবের চেষ্টা করে। ভাবনারা ডালপালা মেলে বিভিন্ন দিকে।

ওহ্ আজ তো ৩ ফেব্রুয়ারি। আর মাত্র ১০ দিন পরেই ভ্যালেনটাইনস ডে। মম ভাবে। এবার তাকে কি গিফট দেবে হালিম? কিছু কি দেবে? একবার ভাবে অবশ্যই দেবে। আবার পরক্ষণেই মমর সংশয়বাদী মন ভাবে ও আসলে কোনো গিফট দেবে না। ওর দিনটির কথা মনেই থাকবে না। ওর যে কাজের চাপ! দিন নেই, রাত নেই ২৪ ঘন্টা শুধু ডিউটি আর ডিউটি।

মম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠে। হাতের মগটা রেখে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। ফোন করেছে সে। তার মানে এখন অফিসে।

সকালের আলো ইতিমধ্যে ফুটতে শুরু করেছে। মম হাসিমুখে হালিমের ফোনটা ধরে। ওপাশ থেকে হালিম বলে, অফিসে পৌঁছে এখন একটু ফ্রি হলাম। তুমি কি করো? গাছে পানি দেয়া শেষ হয়েছে? মম বলে, না আজ তো সবগুলো গাছে পানি দেব না। শুধু তুলসী গাছগুলোতে দেব। - তাহলে দেয়া শেষ করে ফোন দাও।

- না কাটার দরকার নেই। আগে কথা তারপর কাজ।

- তোমার অর্ডারের কি অবস্থা! নতুন কোনো অর্ডার হলো?

- নাহ্! আগেরগুলোই আছে। সেগুলো সবগুলো নির্দিষ্ট দিনের আগে পৌঁছাতে পারব কিনা তা নিয়েই চিন্তায় আছি।

- আরে নাহ্। অত চিন্তার কিছু নেই। ঠিক সময়মতোই পেয়ে যাবে। তবে যাই বলো। তোমার ভাবনাটা দারুণ। এখন মোবাইলের যুগে কেউ ডায়রি লেখে না। সেখানে তোমার প্রিয়জনকে ডায়রি আর কলম দেবার ভাবনাটা দারুণ। আমি বলতেই, আমার কলিগরা দেখলাম বেশ এপ্রিশিয়েট করল তোমার বুদ্ধির।

- তোমার কলিগদের মধ্যে তিনজন তো অর্ডার করেছে।

- তাই নাকি! কে?

- মীনা আপা, রুমকি আপা আর সৌরভ ভাই।

- হাহাহা।

- হাসছ কেন?

- আরে আমাকে কেন এত প্রশ্ন করছিল এতক্ষণে বুঝলাম।

- ও তাই। আগে আমাকে বলনি তো!

- আচ্ছা তুমি যে লাভ কোটেশনগুলো ব্যবহার করেছ সেগুলো ওদের তিনজনের বেলায় কার লেখা দিয়েছ? হুমায়ন নাকি মিলন?

- দুজনের কারোরই না।

- তাহলে কার?

- কার আবার তোমার।

- মানে কি?

- হু। তোমার বিভিন্ন সময়ে বলা কথাগুলোই দিয়েছি।

- ধূর। এটা তুমি কি করলে? আমাদের ভালোবাসা পাবলিক করে দিলে?

- আরে নাহ্। পাবলিক করতে যাব কেন? ওরা কি কোনোদিন জানতে পারবে যে ওগুলো তোমার কথা।

- তা ঠিক।

- আর বিজনেস পার্সন পার্টনার হলে এটাই বড় সমস্যা। বুঝছ। সবকিছুর মধ্যেই ব্যবসা খোঁজে।

- হুম, বুঝলাম। পড়েছি ব্যবসায়ীর হাত, নিজের সবকিছুই যাবে তার ব্যবসাতে।

- হু, সেই।

- আমি না প্রথমে ভাবতেই পারিনি যে, তোমার এত্তগুলো গিফট আইটেম নির্দিষ্ট এই দিবস ঘিরে বিক্রি হবে।

- এটাই তো অনলাইন বিজনেসের মজা। শুধু মানুষের ব্রেনে একটা কিছু ঢুকিয়ে দিলেই হলো।

- একবার ক্লিক করলেই হু হু করে বিক্রি হয়।

- বাহ্। দারুণ একটা ব্যাপার। আর অর্ডার ভালো হলে তোমার মুডও বেশ ভালো থাকে।

- হ্যা ভালো পরিমাণ অর্ডার হলে মুড তো ভাল থাকবেই।

- ম্যাডাম, আপনার যে মুড ভালো আছে সেটা তো আমি আজ খুব ভালোভাবেই টের পাচ্ছি। অন্যদিন হলে আপনি আমার ফোনকলটা রিসিভ করে শুধু বলতেন, পৌঁছেছ? আমার উত্তর হ্যা বলাও শেষ আপনার ফোন রাখাও শেষ।

- হাহাহা। দুঃখিত। খুবই দুঃখিত। আমি আর এমন করব না। আসলে সকালবেলাটা কি ভীষণ কঠিন সময়। এত কাজের চাপ থাকে তখন কি ফোনে কথা বলা যায়?

- আমার দিকটাও তো একটু দেখবে? সকালেই যা একটু ফোনে কথা বলার সময় পাই। তারপর সারাদিন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় পাই না। আরে রাতে ফিরে ক্লান্তির ঘুম। এভাবে চলতে থাকলে একসময় আমরা দুজনে দুটো ভালবাসাহীন পাথরে পরিণত হব। মানুষ আর থাকব না।

- নাহ্! মাথা খারাপ। এমন দিন আসার আগে আমাদের মরণ হোক।

- সেই। আমিও তাই ভাবি। আর বলি সংসারের কাজের মাঝেও যেন আমরা দুজন দুজনের থাকি।

ইতিমধ্যে বেশ বেলা হয়ে গেছে। পূর্ব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। মম হালিমকে ফোন রাখতে বলে। দুজনের কথা শেষ হতে ফোন রেখে মম ছাদ থেকে নিচে নেমে আসে। সোজা তার প্রোডাক্ট রুমে চলে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে একবার চোখ বুলায় প্রোডাক্টগুলোতে।

আজ এগুলো ডেলিভারি দেবার দিন। কিছুক্ষণ পরেই ডেলিভারি পার্সন চলে আসবে। মম এবারের ভ্যালেনটাইন্স ডে উপলক্ষে তার অনলাইনে ডায়রি, তার নিজের বানানো প্রাকৃতিক কলম দিচ্ছে। সঙ্গে দিচ্ছে একটি লাভ কোটেশন। যেগুলো তার শহর থেকে দূরের ঠিকানায় যাবে সেগুলো আগেই পৌঁছে দেবে। আর যারা তার নিজের শহরে বাস করে তাদেরকে ১৪ তারিখেই পৌঁছে দেবে।

এবার মমকে অবাক করে দিয়ে তাদের শহরের শেষ প্রান্তে থাকা ৭০ বছর বয়সী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তারই সমবয়সী স্ত্রী এবং একসময়ের সহকর্মী শিক্ষকের জন্য অর্ডার করেছেন। ভদ্রলোক মমকে জানিয়েছেন তিনি এদিন সকালে স্ত্রীর হাতে উপহারটি তুলে দিয়ে বলতে চান ভালোবাসি।

মম এবার এই গিফ্টটি দিতে পেরে সত্যি আনন্দিত। সে ঠিক করেছে দুজনে মিলে খুব সকালে ভদ্রলোকের হাতে গিফ্টটি পৌঁছে দেবে। মম আরও একটা গিফট দিতে পেরে খুব খুশি। ছেলেটি ওদের পাড়াতেই থাকে। খুব দরিদ্র। ওর পড়ার খরচটা চলে পাড়ার সবার সহযোগিতায়। মমদের বাড়ি থেকেও কতবার যে ওর ফর্ম ফিলআপের টাকাটা দিতে হয়েছে তা কখনও গুণে রাখেনি।

সে যখন গিফট অর্ডার করেছে তখন মম কোনকিছু চিন্তা না করেই তার জন্য ৬০% ডিসকাউন্ট করে দিয়েছে। এটাও ওর জন্য অনেক ভালো লাগার ব্যাপার।...

দিনটি ১৪ ফেব্রুয়ারি। মম আজ রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠেছে। তার ৮০% প্রোডাক্ট আজ ডেলিভারি হবে। না ভুল বলা হলো, আর একটু বাড়িয়ে বললে বলতে হবে অনলাইন অর্ডার করে ডেলিভারি হবে, ভালোবাসা আর আস্থা। ভোর ৫-৬টা এই এক ঘন্টা হালিম আজ মমর সঙ্গে ডেলিভারি দিতে সাহায্য করবে।

আজ সে অফিসে পৌঁছাতে এক দুই ঘন্টা দেরি করবে। তারা দুজনে বেশিরভাগ প্রোডাক্ট ডেলিভারি পার্সনদের হাতে দিয়ে ছুটল সেই প্রধান শিক্ষকের বাড়ি। মম কলিংবেলে চাপ দিতেই ভদ্রলোক এসে দরজা খুললেন। দুজনকে দেখেই নিজের বিস্ময় প্রকাশ করলেন। আপনারা সত্যি এসেছেন।

মম বলল, হ্যাঁ। আপনাকে যখন কথা দিয়েছি তখন তো আসবই। ম্যাডামকে ডাকুন প্লিজ।

ভদ্রলোক এবার তার স্ত্রীকে ডাকলেন। অবসরপ্রাপ্ত এই দম্পতিকে প্রথম দেখায় অনেক তারুণ্যে ভরা দেখায়। বয়স বোঝায় যায় না। মম তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের ফুল, কেক আর ডায়রি কলম হাতে দিল। স্বামীর এমন আচরণে সত্যি খুব খুশি হয়েছেন - তাই তিনজনকে ধন্যবাদ জানালেন সেই ভদ্রমহিলা।

দুজনকে ধন্যবাদ জানিয়ে মম-হালিম সেখান থেকে বিদায় নিল।

বাইকে উঠার আগেই মম হালিমকে বলল Happy Valentines Day এবং ওর হাতে ওর জন্য কেনা ঘড়িটা পরিয়ে দিল। হালিম ছোট্ট একটা ধন্যবাদ দিযেই বলল, উঠ। আমার অফিসে যেতে দেরি হয়ে যাবে। মম এবং হালিম রওয়ানা দিল। মম মনে মনে ভাবতে লাগল, হালিম যেন কেমন!

বাড়ির কাছাকাছি এসে হালিম বাড়িতে না ঢুকে বাইক ঘুরিয়ে চালাতে লাগল। মম কিছুই বুঝেনি। কদিনের যে ধকল গেছে তা অনেক বেশি। আজ কিছুটা রেস্ট মিলবে। কাল থেকে আবার নতুন অর্ডার নিয়ে কাজ শুরু।

হালিম তার অফিসের সামনে এসে বাইকটা দাঁড় করাল। এবার মম খেয়াল করল সে বাড়িতে নয়, হালিমের অফিসে পৌঁছেছে। ওরা অফিসের ভেতরে যেতেই সবাই একসঙ্গে অফিস রুমে আসল। ক্লিনার রীতা দিদি, দারোয়ান সৌরান দাসহ সবাই আছেন। ওরা পৌঁছাতেই মীনা আপা একটা কেক নিয়ে এলেন। যেখানে লেখা ঐধঢ়ঢ়ু ঠধষবহঃরহবং উধু. সবাই মিলে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশে কেক কাটল।

সৌরভ পাশে এসে বলল, কি ভাবছেন? আমরা সবসময় দুষ্টু লোকদের নিয়ে কাজ করিনা ভালোবাসার মানুষদের কথাও মনে রাখি। মম বুঝতে পারল এই দুষ্টুমিটার হোতা আসলে কে? সে হালিমের দিকে আড় চোখে তাকাতেই দেখল ওর মুখে দুষ্টুমির হাসি। মম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে আসতেই হালিম ওর পেছনে পেছনে আসল।

দুষ্টুমি করে বলল, ম্যাডাম চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। মম হাসতে হাসতে বলল, দুষ্টুমিটা ছাড় বুঝেছ। দুজন বয়স্ক মানুষ বাড়িতে আছেন। তাদের ওষুধ এবং খাবারের দেরি হয়ে যাবে।

হালিম এবার ওর পেছন দিকে রাখা বাম হাতটা সামনে আনল। মম দেখল ২ দিন আগে ওরা দুজন মিলে অর্ডারের যেসব গিফট হ্যাম্পার তৈরি করেছে এটা তার মধ্যে একটি। যখন ওরা প্যাকিং করে তখন হালিম বলেছিল একটা বেশি প্যাক করি। মমর প্রশ্ন ছিল, শুধু শুধু বাড়তি করার কি দরকার? হালিমের উত্তর ছিল করলাম একটা বেশি। এতে কি এমন ক্ষতি!মম গিফট প্যাকেটটা হাতে নিয়ে হালিমকে ধন্যবাদ দিতেও ভুলে গেছে। শুধু ওর দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিল। মম দেখল, গিফট হ্যাম্পারের উপরে হালিমের হাতে লেখা Happy Valentines Day - Momlim.

 

মন্তব্য

Beta version