কী গ্রাম, কী শহর এক সময় সব জায়গায় প্রধান বিনোদন মাধ্যম ছিল বই পড়া। শিক্ষিত, স্বল্প শিক্ষিতের মধ্যে ছিল বই পড়ার অদ্ভুত নেশা। চৈত্রের উদাস দুপুর, বিষ্টি ভেজা শ্রাবণ বিকেল, আষাঢ়ের সন্ধ্যা, বসন্ত রাত, কী শিশির ঝরা সকাল- অবসর পেলেই পাঠক ডুব দিতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, শরৎ, বঙ্কিম, সুনীল, সমরেশ, নিমাই ভট্টাচার্য, হুমায়ূনদের লেখনীতে। হারিয়ে যেতেন মাসুদরানা, দস্যুবনহুরের মতো সিরিজের মধ্যে।
তখন ধার করে বই পড়ার প্রচলন ছিল। সেই বই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যেত শহরের চশমা আটা মানুষের ড্রইং রুম থেকে পল্লির কুঁড়েঘরে। কালের বিবর্তনে এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। আকাশ সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ হয়েছে স্মার্টফোন। সবাই সহজে ঢুকে পড়ছে ফেসবুক, গুগল, টুইটার তথা নেট দুনিয়ায়। এখানে সময় পার করছে আমজনতা। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাঠক। পাঠক তার চাহিদা গিলছে স্মার্টফোনে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এখন বই কেনা বেড়েছে। তবে তা কেবল ঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য। পাঠক খরার যুগে বই ব্যবহার হচ্ছে শুধু শো-পিস হিসেবে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক বড় কর্তা আরিফ রহমান (ছদ্ম নাম)। তার গাড়ি বাড়ি সবই আছে। পরিপাটি করে সাজানো ঘর। প্রতি বছর বইমেলা এলে তিনি নতুন নতুন বই কিনেন। ঘরে রয়েছে নামিদামি সব লেখকের বই। তাকে প্রশ্ন করা হয় বই পড়া হয়? উত্তরে তিনি হেসে বলেন, ‘নাহ্ সময় কই। ঘরে নামিদামি লেখকদের বই না থাকলে ঘরটি পরিপূর্ণভাবে সেজে ওঠে না। তাছাড়া ঘরে একটি বইয়ের শো-কেস না থাকলে লোকে কী বলবে। মূলত সেই জন্যই বই কেনা। অবসর সময় যতটুকু পাই ফোনেই থাকি।
বইমেলায় দেখা হয় পেশায় আইনজীবী আবুল হোসেনের সঙ্গে। দুই ছেলেকে নিয়ে মেলায় এসেছেন। তার দুই হাত ভর্তি বই। যে কেউ দেখলে ভদ্রলোককে জাত পাঠক ভেবে নেবেন। বই পড়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে ‘আমি বই কিনি, কিন্তু পড়া হয় না। মেলায় এলে পছন্দ হলেই বই কিনি। সেগুলো কেবল আলমারিতে শোভা পায়। আমার বাচ্চারা এখনো ছোট। ইচ্ছা আছে ওদের পাঠক বানানোর। কিন্তু কি হবে জানি না। এখন থেকেই তাদের স্মার্টফোনে ঝোঁক।’
বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে সংশ্লিষ্টরা বলেন, স্মার্টফোনের কবলে পড়ে পাঠক কমে যাচ্ছে এটা জাতির জন্য ভালো সংবাদ নয়। বিশেষ করে যারা কিশোর-কিশোরী তাদের বই পড়ার বিকল্প নেই। যারা বই পড়ে তাদের মন ভালো থাকে। তারা সমাজসচেতন হয়। বইয়ের সঙ্গে যারা থাকে তারা খারাপ কাজ, অন্যায় কাজ করে না। সর্বোপরি তাদের মধ্যে জীবনবোধ তৈরি হয়। তাই এখনই অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। নেটের নেশা কাটিয়ে তাদের হাতে বই তুলে দিতে হবে।
জানতে চাইলে জনপ্রিয় লেখক জাফর ইকবাল ভোরের আকাশকে বলেন, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। তাই কেউ আর বই পড়ে না। তারা শুধু লাইক দেয়। কিন্তু পড়া বলে যে ব্যাপার আছে তারা তো এটা ভুলেই গেছে। একটা ছোট বাচ্চা যখন আমার কাছে বই নিয়ে এসে অটোগ্রাফ নেয়। তখন আমি খুব খুশি হই। আমি পৃথিবীর মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করেছি। যারা পড়ে আর যারা পড়ে না। যারা পড়ে না তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারবে না। আর যারা পড়ে পৃথিবী তাদের থেকে অনেক কিছু পাবে। তাই আমি চাই, বাচ্চারা অনেক বেশি বেশি পড়ুক। তাই আমি সব বাচ্চাদের বলতে চাই, ঘুমানোর আগে অন্তত দুটি পৃষ্ঠা হলেও পড়ে ঘুমাবা।
একই বিষয়ে জানতে চাইলে কবি নাসির আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, পাঠক কমে যাওয়া একটি বড় কারণ স্মার্টফোনের ব্যবহার। এখন ছোট-বড় প্রায় সবার হাতেই এ ধরনের ফোন শোভা পেতে দেখা যায়। তারা ঢুকে পড়েন নেট দুনিয়ায়। ভালো-মন্দ দিক বিবেচনা না করে এখানে সময় কাটাতে ভালোবাসেন তারা। যে কারণে পাঠক হারিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবার প্রধানদের সচেতন হওয়া দরকার।
জ্ঞানের সঙ্গে বুদ্ধির একটি গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দার্শনিক সক্রেটিস জ্ঞান লাভের জন্য নিজেকে জানতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, নিজেকে জানো। জ্ঞান বুদ্ধির ভিত তৈরি করো। আর প্রকৃত জ্ঞান ও বুদ্ধি জগত, সৃষ্টি ও সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে অনন্য ভূমিকা পালন করে। জ্ঞান অর্জনের জন্য নানা উপায় বা পথ রয়েছে। এ পথগুলোর মধ্যে সহজ এবং নির্ভরযোগ্য পথটি হলো বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা।
যে জাতি যত বেশি বই পড়ে সে জাতি ততো বেশি জ্ঞান গড়িমায় সমৃদ্ধ। বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী ওমর খৈয়ামের একটি লেখার ভাবানুবাদ করেছিলেন ঠিক এমনভাবে, ‘রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, অনন্ত যৌবনা হয়ে থাকবে বই যদি সেটা তেমন বই হয়।’ বই পড়ার বহুমুখী উপকারিতা রয়েছে। একটি সভ্য সমাজ তৈরিতে বই পড়ার কোনো বিকল্প নেই। আর এই বইয়ের প্রধান পাঠক হয়ে থাকে যুব সমাজ যারা পরবর্তী সময়ে দেশের হাল ধরেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বই পড়া মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে, অথচ সেটা বাড়ার কথা ছিল।
জানা যায়, এখনো একজন ভারতীয় কমপক্ষে ১১ ঘণ্টা বই পড়ে। এখানে বই বলতে বিভিন্ন ধরনের বইকে বুঝানো হচ্ছে। ভারত ছাড়াও চীন, থাইল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা ব্যাপকভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলেছে। থাইল্যান্ডের জনগণ প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১০ ঘণ্টা বই পড়ে। চীনারা প্রতি সপ্তাহে ৮ ঘণ্টা এবং মার্কিনিরা প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৬ ঘণ্টা বই পড়ে থাকে। অথচ আমাদের দেশে পাঠক খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন পাঠ্যবই পড়ার বাইরে অন্যান্য বই যারা পড়বে তাদের জন্য পরীক্ষায় কিছু নম্বরও ধার্য করা যেতে পারে। বেশি বেশি সংখ্যক বইমেলার আয়োজন করতে হবে। যে নৈতিক অবক্ষয় তরুণ প্রজন্মকে গিলতে শুরু করেছে, সেটা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে তরুণদের মাঝে। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা করে পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল গত ৭ বছরে বইমেলায় মোট ৩৭৪ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। কিন্তু বাড়েনি কাক্সিক্ষত পাঠক। বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালে বিক্রি হয়েছে সাড়ে ১৬ কোটি টাকার বই, ২০১৫ সালে ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৬ সালে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭ সালে ৬৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৮ সালে ৭০ কোটি টাকা, ২০১৯ সালে ৮০ কোটি টাকা, ২০২০ সালে ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়।
মন্তব্য