-->

ধন্য সেই পুরুষ

শামসুর রাহমান
ধন্য সেই পুরুষ

ধন্য সেই পুরুষ

 

শামসুর রাহমান

 

ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;

ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চ‚ড়া থেকে যে নেমে আসে

প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মতো উপত্যকায়;

ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে যে উঠে আসে

রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।

ধন্য সেই পুরুষ কাহাতের পর মই-দেয়া ক্ষেত থেকে যে ছুটে আসে

ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।

ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসো,

আর তোমারই প্রতীক্ষায়

ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ

জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহংকারের মতো

ফুটে আছে রক্তজবা, আর

আমরা সেই পুষ্পের দিকে চেয়ে থাকি, আমাদের

চোখের পলক পড়তে চায় না,

অপরাধে নত হয়ে আসে আমাদের দুঃস্বপ্নময় মাথা।

দেখ, একে একে সকলেই যাচ্ছে বিপথে অধঃপাত

মোহিনী নর্তকীর মতো

জুড়ে দিয়েছে বিবেক-ভোলানো নাচ মনীষার মিনারে,

বিশ্বস্ততা চোরা গর্ত খুঁড়ছে সুহৃদের জন্যে

সত্য খান খান হয়ে যাচ্ছে যখন তখন

কুমোরের ভাঙ্গা পাত্রের মতো,

চাটুকারদের ঠোঁটে অষ্টপ্রহর ছোটে কথার তুবড়ি,

দেখ, যে কোন ফসলের গাছ

সময়ে-অসময়ে ভরে উঠেছে শুধু মাকাল ফলে।

ঝলসে-যাওয়া ঘাসের মতো শুকিয়ে যাচ্ছে মমতা

দেখ, এখানে আজ

কাক আর কোকিলের মধ্যে কোনো ভেদ নেই।

নানা ছলছুতোয়

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল,

গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা, যাঁর নামের ওপর

কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয় জ্যোৎস্নার সারস,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো

দুলতে থাকে স্বাধীনতা,

ধন্য সেই পুরুষ যাঁর নামের ওপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।

স্বৈরাচারের মাথায় মুকুট পরাচ্ছে ফেরেব্বাজের দল।

দেখ, প্রত্যেকটি মানুষের মাথা

তোমার হাঁটুর চেয়ে এক তিল উঁচুতে উঠতে পারছে না কিছুতেই।

তোমাকে হারিয়ে

আমরা সন্ধ্যায়, হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো হয়ে যাচ্ছিলাম,

আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে,

তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে

আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে

আকাশকে ব্যথিত করে তুললাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে

রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেননা জেনেছি

জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version