আরিফুল ইসলাম রিগান: সনেট সংকলন হওয়ায় কবিতার শিরোনাম না থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু যেভাবে কবিতাগুলোর ক্রম সংখ্যা দেয়া হয়েছে তাতে প্রথম দেখায় মনে হবে মুদ্রণজনিত ভুল হয়েছে; কিন্তু না। ভালো করে দেখলে এবং কাব্যটির ভ‚মিকা পড়লেই স্পষ্ট হবে, ভুল হয়নি মুদ্রণে। জানা মতে, বাংলা কবিতার ধারায় এ ধরনের টুইস্ট এই কাব্যেই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে।
কথা বলছি হালের অন্যতম প্রকরণসিদ্ধ কবি মোরশেদুল ইসলামের নতুন কাব্য ‘ভাবনা নয় ঘুম আসে’ নিয়ে। কাব্যটির সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমকপ্রদ ভূমিকায় বলা হয়েছে, ‘সচেতনভাবেই কবিতাগুলোর শিরোনাম বাদ দিয়েছি ও সংখ্যাক্রমের ধারাবাহিকতায় ব্যত্যয় ঘটিয়েছি। প্রত্যাশা, কবিতাগুলো পাঠে কোনো বিধিবদ্ধ অর্থের অনুসৃয়ায়োন না ঘটুক আর কবিতা তার নিজস্ব অর্থ থেকে মুক্তি পাক।’
কবি আরো প্রত্যাশা করেছেন যে কবিতাগুলো পড়ে যেন কোনো স্তরের পাঠকমহলে কোনো ভাবনা-চিন্তার উদ্রেক না হয়। তার বদলে যেন ঘুম আসে; শান্তির সশব্দ ঘুম। কিন্তু কেন ভাবতে নিষেধ করা হলো, কেনইবা ঘুমানোর কথা বলা হলো এটাই ভাবনার বিষয়। পাঁচ ফর্মার বইটিতে মোট ৭২টি সনেট স্থান পেয়েছে। জীবনের নানা ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত সমকালীন অনেক বিষয়বস্তু নিয়েই কবিতাগুলো রচিত।
কবিতা তার পাঠকদের কীভাবে ভাব, ভাষা, ছন্দ, অলংকার ও দ্যোতনা দিয়ে ভাবায় তা খোলাসা করতে গিয়ে উদাহরণ টানা হয়েছে নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাসের ২০১২ সালে রচিত সাড়াজাগানো কবিতার; মনে করিয়ে দেয়া হয়েছে ২০২০ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কর্তৃক আবৃত্তিকৃত একটি কবিতার কথা, যার ফলে কূটনৈতিক ঝড় উঠেছিল তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে।
এছাড়াও কবিতার কারণে জেল-জুলুম কিংবা চাকরি খোয়ানোর নজির তো রয়েছেই। তবু কবি আশা ব্যক্ত করেছেন:
‘মুখ বন্ধ করলেই কি কথা থেমে যায়?/ প্রতিবাদ ঢেউ তোলে পুরো দেহটাতে!’ (সনেট ১৭) কবিতাগুলোয় প্রতীকের ব্যবহারে কবি তার যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ৩৯নং সনেটে বলেছেন: ‘পাতাগুলো নেচে চলে বাতাসের সুরে।/ যদি আমার নির্দেশ না করো পালন,/ না নাচো আমার তালে, ছন্দের পতন/ হয় যদি কোনোক্রমে, খাবো কুঁড়ে কুঁড়ে/ লাত্থি দিয়ে নিয়ে যাব এক্কেবারে দূরে!’
১নং সনেটে বলা হয়েছে : ‘কোথায় হাত দিবেন? সব খসে পড়ে!/ ডালের মতো শুকিয়ে আটকে আছে গাছে/... মান্যবর শিয়ালরা থ্রেট মারে দেদারসে/ সিংহের ভীতি, ফুলদানি থেকে ফুল পাছে/ ঝরে! তাই ভাবেন না। ঘুমান অঘোরে!’ চমকপ্রদ সব উপমার দেখা মেলে বিভিন্ন কবিতায়।
২নং সনেটে এমনই এক উপমা : ‘তোমার দেহের কড়া ঘ্রাণ ঠিক পাশের বাড়ির/ ডাল রান্নার মতন দোলা দেয় নাকের ভেতরে!’ উত্তরাধুনিক কবিতার সরল রৈখিক ব্যাখ্যা করা দুরূহ ব্যাপার; এখানে ভাবনার বহু আঙ্গিক থাকে। তবু এ কাব্যে অযাচিত দুর্বোধ্যতা নেই। আছে ভাবনার নৈর্ব্যক্তিক ও সার্বজনীন স্রোতে হারিয়ে যাওয়ার মতো অনন্য সব পঙক্তি: ‘কথা না বলেই ফুল কত কিছু বলে/ মানুষ বধির তাই বার্তা যায় জলে!’ (সনেট ৫৫)
‘কতশত ফুল ফোটে অদেখাই রয়,/ রূপ ঝরে রৌদ্রে, খুশবু বাতাসেই ক্ষয়!’ (সনেট ২৪) নৈসর্গিক সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েও কবিমানস বারবার ফিরে আসে যাপিত জীবনের প্রায়োগিক নানা অনুষঙ্গে। কবির ভাবনা ছুঁয়ে যায় পাঠকের হৃদয়; সৃষ্টি হয় গভীর ও মর্মস্পর্শী সব অনুভ‚তির। ফলে কবিমানসের সাথে পাঠকের বিচ্ছিন্নতার জো নেই।
‘দিনশেষে আমরা সবাই গল্প হয়ে যাব:/ কেউ রবে ইতিহাসে কেউবা উপন্যাসে!’ (সনেট ৪৪) ‘ফলেরা নিচেই পড়ে, পাতা যায় দূরে/ সামান্য বাতাসে তারা ওড়ে ঘুরে ঘুরে।’ (সনেট ২২) কবিতাগুলোতে অমিত্রাক্ষর ছন্দেরই আধিক্য লক্ষ করা যায়। ১৪ মাত্রার পয়ারের পাশাপাশি ১৮ মাত্রার মহাপয়ারের চালও দেখা যায় সমানতালে।
‘একদিন হারিয়ে যাবে সব, দূরত্ব সাধবে শূন্যতা/ এই আমাদের মাঝে; কাকতালীয় ঘটনায়ও ভুলে/ হবে না আমাদের দেখা; বহতা সময়ের ক‚লে/ মৃত্যু হবে একজনের, অপরে জানতেও পারবে না তা’ (সনেট ৩৬) কবিতাগুলোর অন্ত্যমিল বিন্যাসে পেত্রার্কিয় সনেটের বিন্যাস লক্ষণীয়; বিশেষ করে অষ্টকে। তবে ষটক এর বিন্যাসে সময় সময় পরিবর্তন দেখা যায়। বলতে গেলে, মূলধারার সাহিত্যিক ঐতিহ্যের সাথে সাথে আধুনিক, বাস্তবিক এবং পরাবাস্তববাদী গঠন ও মননশীলতার বহুমাত্রিক টুইস্টে ভরপুর তরুণ কবি মোরশেদুল ইসলামের ‘ভাবনা নয় ঘুম আসে’ কাব্যটি।
কবিতাপ্রেমী চিন্তাশীল পাঠক হৃদয়ের জন্য ঘোরলাগা অনুপম একটি কাব্যগ্রন্থ; যেখানে ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক উভয় ধরনের রস আস্বাদনে তৃপ্ত হবে পাঠক হৃদয় এবং ডুবে যাবে ভাবনার ঢেউয়ে।
বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। বইটি একুশে বইমেলা ২০২৩-এ চারুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশিতব্য।
লেখক: সংবাদকর্মী
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য