আটচালা
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
সব ফেলে চলে গেলি তোরা
চাষের জমি, গোলার ধান, গণেশের ভিটা, বরজের পান, পানের বাটা,
শাদা-কালো দুই জোড়া গরু, পুকুরের মাছ, ঝাড়ের বাঁশ, কাঁসার থালা, রুপোর বালা,
আয়না-চিরুনি-ডেকচি-পাতিল সব, এসবের সাথে আটচালাটাও ফেলে গিয়েছিলি।
ফেলে গিয়েছিলি বলতে এসব কিনে নিয়ে ছিল আমার বাবা, চাচারা
এতেই ভীষণ খুশি ছিলি তোরা!
আটচালাসহ তোদের বাড়িটা নিয়েছিলাম আমরা।
তোরা চলে গেলি ভরা ভাদ্র মাসে
তখন তোদের গাছে পাকা পাকা তাল ঝুলছিল,
পাছ দুয়ারের ডালিম গাছে ফেটে লাল হয়েছিল ছোট-বড় ডালিম,
কাকে খেয়ে যাচ্ছিল বারোমাসি আতা গাছটির পাকা আতা! গাছে গাছে কত ফল!
আঙিনায় লাউ-কুমড়ার জড়াজড়ি, রান্নাঘরের চালে পাকা চাল কুমড়া,
খোঁপ ভরা বাহারি রংয়ের কবুতর, হাঁস-মুরগি আরো কত কী!
এক সাজানো বাগান, কী নেই তোদের !
আম-জাম, জামরুল-কাঁঠাল, কলা-কদবেল, লিচু-পেয়ারা-আমলকির এক ফলবতী বাড়ি!
সময়ের ব্যবধানে সেসব তখন আমাদের হয়ে গেছে!
কালীচরণ, বলতে গেলে তোরা জমিদারই ছিলি
অথচ যাবার বেলায় নিয়ে গেলি অতি সামান্য
লক্ষী দেবীর মূর্তি, রামায়ণ, লেপ-কাঁথা-বালিশ...
তিনটি গরুর গাড়িতে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস,
সঙ্গে শুকনো খাবার গুড়-মুড়ি-চিড়া এসব।
মা তোদের বিন্নি ধানের পায়েস রান্না করে দিয়েছিল।
বিদায়বেলায় জেঠিমা, মাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলেন,
বলেছিলেন ‘দিদি আমাদের জন্মের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো! ভালো থেকো’।
তুই আর আমি, কেউ কাউকে ছাড়তেই চাইছিলাম না
দুই কিশোরের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছিল
সদ্য ভাগ হওয়া এপার বাংলার একটি গ্রাম।
তোদের গাড়ির সাথে সাথে বহুদূর গিয়েছিলাম
জেঠি মা, কাকাবাবু, সোনালি দি, বরুণ, ঠাকুর মা, তুই বারবার হাত নাড়াচ্ছিলি, আমরাও!
একসময় তোদের গাড়িটা সিকেলির মোড় ঘুরে যায়,
অদৃশ্য হয়ে যাস তোরা, আমরা তখনো দাঁড়িয়ে।
তুই চলে গেলে ভীষণ জ্বরে পড়েছিলাম আমি
সবাই বলেছিল এর নাম হোতোসে জ্বর!
আমি তখন হোতোসে জ্বরের মানে জানি না,
প্রিয় মানুষ ছেড়ে গেলে নাকি এসব জ¦র হয়
তারপর কত জল গড়ালো- কত বন্ধু এলো কিন্তু তোর মতো কেউ এলো না।
যেদিন থেকে আটচালাটা আমাদের হয়ে গেলে
সেদিন থেকে আমি তোর কামরাতেই থাকা শুরু করি
আমার কৈশোরের বাকিটা সময়, যৌবন, বৃদ্ধ বেলা
তোর ঘরেই কেটেছে।
এই ঘরে গেলে আমি তোকে দেখতে পেতাম
তোকে, জেঠি মাকে, বরুণকে, সোনালীদিকে
আমরা সবাই যেন এই আটচালাতে থাকি!
তোর টেবিল-চেয়ার, খাট ছুলেই মনে হতো তোকে ছুয়েছি।
স¤প্রতি সেই আটচালাটা ভেঙে ফেলা হয়েছে কালীচরণ,
মানা করেছিলাম, কেউ শেনেনি আমার কথা
কালীচরণ, বন্ধু আমি এখন কবরযাত্রী, অতি বৃদ্ধ
এইসব পৌড়ের কথা কে কবে শুনেছে, বল?
কেউ শোনে না!
বলতে গেলে তোর কোনো স্মৃতিই এখন অবশিষ্ট নেই
এ প্রজন্ম তোর সব আসবাস দান করে দিয়েছে
এসব নাকি এখন খুব অচল!
অচলের ভিড়ে বহু অনুরোধে একটি শালের খুঁটি চেয়ে রেখেছি
যেটাতে তোর নাম খোদাই করা আছে,
শ্রী কালীচরণ ব্যানার্জি, তৃতীয় শ্রেণি, রোল- এক, ১৯৪৩ ইং।
খুব অগোচরে ওটাতে মাঝে মাঝে হাত বোলাই
চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই একঝাঁক মানুষের মুখ।
কী আশ্চর্য ! যে ইস্যুতে দেশ ভাগ হলো
সেই হিন্দু-মুসলিমের মুখ খুঁজে পাই না!
স্মৃতির আয়নায় কেবলই মানুষের মুখ ভাসে।
৩০/১/২৩, ঢাকা, শাহীনবাগ
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য