মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: বাড়ির নাম জোহরা মঞ্জিল। অত্র এলাকার সবচেয়ে পুরোনো ও বড় বাড়ি। বয়স প্রায় ৩০০ বছর। আয়তন সাত একর। পুরো এলাকা তারকাঁটায় ঘেরা। এই বিশাল জায়গার পাশে জোহরা মঞ্জিল। এর পশ্চিম এবং পূর্ব দিকে সান বাঁধানো দুটি দিঘি। বাকিটা বাগান। বাগানে নানা প্রজাতির গাছ-গাছালিতে ডাসা। বেশিরভাগই পুরোনোকালের গাছ। এসব গাছে সকাল-বিকাল পাখিদের কলকাকলি।
বর্তমানে এই বাড়ির মালিক বারেক মন্ডল। তার বাবার নাম শাহাজান মন্ডল। বাড়িটা তৈরি করেছিলেন শাহাজান মন্ডলের বাবার দাদা। তার নাম রশিদ মন্ডল। তিনি জমিদার ছিলেন। রশিদ মন্ডল স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন। স্ত্রীর নামে বাড়ির নাম দেন জোহরা মঞ্জিল।
একসময় জমিদারি প্রথার অবসান হয়। কিন্তু বংশের চলন-বলন পাল্টে যায়নি। বারেক মন্ডলের দুই বোন। আবেদা সুলতানা ও কোহিনুর সুলতানা। তারা বারেকের বড়। দুই বোনকে বিয়ে দেয়া হয়েছে জমিদার বংশের ছেলের কাছে। দুই পরিবারের পূর্ব-পুরুষরা জমিদার ছিলেন।
বারেক মন্ডলের বংশ ইতিহাস বেশি ভালো নয়। তার তিন চাচা ছিল। কারো বংশধর নেই। ফলে সব সম্পত্তির মালিক হন বারেক মন্ডল। তিনি শাহাজান মন্ডলের শেষ বয়সের সন্তান। যে কারণে তিনি পুত্রকে অধিক ভালোবাসতেন।
তার জন্মের পর মন্ডল বংশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু তার দুই বোনের মধ্যে উল্টো চিত্র দেখা গেছে। শেষ সময়ে কেউ এসে সম্পত্তিতে ভাগ নেবে এটা তারা মানতে পারেনি। বারেকের মা বিষয়টি বুঝতে পারেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দেয়ার পর তিনি শাহজাহান মন্ডলকে বাড়িটা ছেলের নামে লিখে দেয়ার অনুরোধ করেন।
তার শঙ্কা বাড়ির সম্পত্তি নিয়ে মেয়েরা একদিন ঝামেলা করবে। কথাটা শাহাজান মন্ডলের মনে ধরে। তিনি এর একটা বিহিত করতে চান। তার সম্পত্তি প্রায় ২০০ একর। তিনি মেয়েদের ডেকে নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন।
বললেন ‘তোমাদের শ্বশুড় বাড়িতে জায়গা-সম্পত্তির অভাব নেই। কিন্তু বাবার সম্পত্তিতে তোমাদের হক রয়েছে। আমি তোমাকে তা থেকে বঞ্চিত করব না। তোমাদের একটা মাত্র ভাই। তোমাদের অমত না থাকলে বাড়িটা বারেকের নামে দিয়ে যেতে চাই। এর বিনিময়ে তোমাদের অন্য জায়গা থেকে সম্পত্তি দিয়ে যাবো। আশা করি তোমরা আমার সঙ্গে একমত হবে।’
দুই মেয়ের কেউ-ই বাবার কথা অমান্য করে না। ফলে শাহাজান মন্ডলের ইচ্ছোনুয়ায়ি সম্পত্তির ভাগ বাটরা করা হয়। কিন্তু বিষয়টি তিনি পুরোপুরি শেষ করে যেতে পারেন নাই। ছেলেকে বাড়ির সম্পত্তি লিখে দেয়ার দুদিন পরে তিনি মারা যান। পরের সপ্তাহে মেয়েদের সম্পত্তি লিখে দেয়ার কথা ছিল। শাহাজান মন্ডল মৃত্যুর আগে কিশোর পুত্র বারেককে বলে যায় বোনদেন না ঠকাতে।
এই বংশের কেউ কখনো চাকরি করেনি। বারেকই প্রথম সরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করে। চাকরির আগেই মায়ের অনুরোধে বিয়ে করতে হয় তাকে। বিয়ের এক বছরের মধ্যে তাদের ঘরে আসে পুত্র অনিক। তারও প্রায় দুই বছর পর চাকরিতে জয়েন করে বারেক।
সে বংশের অন্যদের চেয়ে আলাদা। আয়েশি জীবনযাপন ভালো লাগে না তার। জমিদার বংশের কেউ-ই অত্যাচারি ছিলেন না। তবে বেশিরভাগই ছিলেন আয়েশি জীবনের অধিকারী। যে কারণে তাদের সম্পত্তি এখন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
শাহাজান মন্ডল মারা যাওয়ার কিছুদিন পর থেকে তার দুই বোন ভাইয়ের কাছে সম্পত্তির মালিকানা বুঝে দেয়ার দাবি করে। বাবা যেহেতু তাদের অন্য সম্পত্তি লিখে দেয়ার সময় পাননি। তাই তারা বাড়ির সম্পত্তির ভাগ ছাড়তে নারাজ। সবার আগে তারা এই সম্পত্তির ভাগ চায়।
বারেক অনেকবার বোনদের বাড়ির বদলে অন্য সম্পত্তি দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছ। বাবা যেভাবে বলে গিয়েছেন, সেই ভাবে সব মিটাতে চায়। তাদের মা কুলসুম বিবিও মেয়েদের অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
তাদের যুক্তি এই সম্পত্তির মূল্য বেশি। তাই অন্য সম্পত্তির সঙ্গে এর তুলনা হয় না। বোনদের জটলা বাড়তেই থাকে। বারেকও আর ঝামেলা বাড়াতে চায় না। বাড়ির সম্পত্তিতে তাদের অংশ বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু নানা কারণে আরো কয়েক বছর পেরিয়ে যায়। ফলে সম্পত্তির মীমাংসা হয় না। এর মধ্যে কুলসুম বিবিও মারা যায়।
মায়ের মৃত্যুর পর দুই বোন আরো অগ্নিমূর্তি হয়ে উঠেছে। তারা আত্মীয়-স্বজনদের বলে বেড়াই ভাই বুদ্ধি করে বাবার সম্পত্তি গ্রাস করেছে। বাড়ির সম্পত্তি থেকে তাদের বঞ্চিত করেছে। তারা এর একটি সুষ্ঠ সমাধান চায়। বারেক বোনদের মিথ্যাচার না করার অনুরোধ করে। যেকোনো সময় সম্পত্তি বুঝে দিতে চায়। সম্পত্তি ফেরত দিতে হবে দলিলের মাধ্যমে। এর জন্য মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন।
কিন্তু বারেকের কাছে এখন এত টাকা নেই। তাই সে বোনদের এই টাকাটা দেয়ার আহব্বান জানায়। এই প্রস্তাবে বড় বোন রাজি থাকলেও বেঁকে বসে ছোট বোন। সে কিছুতেই টাকা দিবে না। সম্পত্তি ফিরিয়ে দেয়ার দায়িত্ব বারেকের। সে কীভাবে দিবে সেটা তার ব্যাপার। এ বিষয়ে তাদের মাথাব্যাথা থাকার কথা নয়। কথাটা বড় বোনের মনে ধরে। সেও ছোট বোনের সঙ্গে একমত।
তারা ভাইকে তাদের অপারকতার কথা জানায়। বারেক বোনদেন কাছে কিছু সময় চায়। সময়টা তিন মাস। বোনেরা বারেকের প্রস্তাব মেনে নেয়। রোজার ঈদের পরপরই বাড়ির সম্পত্তি ফেরত দেয়া হবে। একই সঙ্গে শেষ হবে অন্য সকল সম্পত্তির ভাগাভাগির পর্ব।
রোজার মধ্যে মন্ডল পরিবারে একটা দুসংবাদ আসে। এই বংশের শেষ উত্তরাধিকারী অনিকের হার্টে দুটি ছিদ্র ধরা পড়ে। ডাক্তার জানিয়েছেন এই অপরেশনটা দেশের বাইরে করাতে পারলে ভালো হয়। এতে ঝুঁকিটা কম। একমাত্র ছেলের এই সংবাদে বারেক ভেঙে পড়ে। বারো বছর বয়সি ছেলের মুখের দিতে তাকাতে পারেন না। ছেলেটার মুখের দিকে তাকালেই কান্না পায়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় আল্লাহর কাছে ছেলের সুস্থতা কামনা করে।
বোনদের সঙ্গে যত ঝামেলাই হোক না কেন তারা ছাড়া বারেকের আর কেউ নেই। সে বোনদের এই সংবাদ জানায়। খবর পেয়ে আবেদা এবং কোহিনুর দুজনেই হাজির হয়। কিন্তু ছোট এ বাচ্চাটার অসুস্থতা নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। বরং বাড়িতে এসেই তারা সম্পত্তির কথা তুলেছে। এতদিন এ বিষয়টা নিয়ে বারেক কিছু না বললেও এবার মুখ খোলে। বলে ‘বুবু তোমরা কি আমার ছেলেটাকে দেখতে এসেছো নাকি সম্পত্তি বুঝে নিতে এসেছো?
অনিক সুস্থ হোক আমি অবশ্যই তোমাদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দেবো। সত্যি বলতে কী বুবু, বাড়িটা আমার নামে দেয়ার ইচ্ছেটা ছিল মা-বাবা এবং তোমাদের। আমি তখন ছোট এ সবের কিছুই বুঝতাম না। দয়া করে অনিক সুস্থ হওয়া পর্যন্ত সময় দাও। ভাইয়ের সত্যি কথাতে চতুর দুই বোনের হাতেঘাঁ লাগে। কিন্তু বিষয়টা বুঝতে দেয় না। বরং ভাইকেই ভুল বুঝতে না করে। বোঝানোর চেষ্টা করে অনিকের জন্য তাদেরও মন খারাপ। সবার আগে ছেলেটার চিকিৎসা করা জরুরি।
রাতের খাবার খাওয়ার পর দোতলার ঘরে কোহিনুর ও আবেদার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। গৃহকর্মী রত্না তাদের সব ব্যবস্থা করে দেন। বারেকের স্ত্রী আয়েশা বেগম রত্নাকে খুব বিশ্বাস করে। সংসারের কোনো কাজই তাকে বলে দিতে হয় না। তার স্বামী তুহিনও ভালো ছেলে। বহুদিন এ বাড়িতে থাকতে থাকতে দুজনই পরিবারের সদস্য হয়ে গেছে।
আয়েশা বেগম ও বারেক ছেলের কাছে বসে রয়েছে। অনিক তার অসুখের কথা জানে না। তবুও অনুমান করতে পারছে, খারাপ কোনো অসুখ হয়েছে তার। বারবার মা-বাবাকে প্রশ্ন করছে সে এই অসুখে মারা যাবে কিনা? কবরে গিয়ে সে একা একা কীভাবে থাকবে? মরে গেলে মানুষ কোথায় যায়? ছেলের এসব কথার পাত্তা দিতে চায় না স্বামী-স্ত্রী উভয়ে। দুজনই প্রসঙ্গ ঘোরাতে মগ্ন।
কথা বলতে বলতে অনিক ঘুমিয়ে পড়ে। ছেলে ঘুমাবার পর বারেক স্ত্রীকে বলে, আমি দোতলার ঘরে যাই বুবুদের সঙ্গে একটু কথা বলে আসি। আয়েশা বেগম বলে, চল আমিও যাই। ছেলেটার জন্য আমি বুবুদের সঙ্গে এখন পর্যন্ত ভালো করে কথাই বলতে পারিনি। চল যদি কিছু লাগে জেনে আসি।
বারেক স্ত্রীকে থামিয়ে দেয়। তোমার এখন যাওয়ার দরকার নেই। বাবুর কাছে থাকো। বুবুদের কিছু লাগলে আমি ব্যবস্থা করব। রত্না আছে, ও দেখবে। তুমি সকালে বুবুদের সঙ্গে কথা বল। আচ্ছা ঠিক আছে যাও। বিশেষ দরকার হলে আমাকে বল। শোন বুবুরা যেন কোনো কারণে কষ্ট না পায়। উনারা যাই বলুক শেষ পর্যন্ত তারা কিন্তু এ বাড়িরই মেয়ে, তোমার বোন।
আর মেয়েদের শেষ আশ্রয় কিন্তু বাবার বাড়ি। বুবুরা দুকথা বললেও তুমি কিন্তু ওদের কিছু বলবে না। না না আমার বুবুরা এমন না। শোন বুবুদের শরীরে জমিদারের রক্ত বইছে। সেই জন্য কর্থাবার্তার ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু ভেতর থেকে তারা খুব নরম। আমি তো আমার বুবুদের চিনি।
দোতলায় বুবুদের ঘরের কাছে গিয়ে হাসির শব্দ কানে আসে বারেকের। সে ভাবে বুবুরা হয়তো পুরোনো কোনো স্মৃতিচারণ করছে। বাবার বাড়িতে এলে মেয়েদের এমন হয়। ভাই-বোন এক জায়গায় হলে কত্ত কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে বোনদের সঙ্গে বোনদের আলাদা আলাদা স্মৃতি থাকে। দরজার কাছে গিয়ে বুবুদের কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পায় বারেক।
তাহলে আর সম্পত্তি লিখে নেয়া লাগবে না তাই না কোহিনুর? সেই দোয়াই কর বুবু, ছেলেটা যদি ফাইনাল হয়ে যায় তাহলে সম্পত্তি আমাদের হয়ে যাবে। আচ্ছা কোহিনুর এই অপরেশনটা কি খুব কঠিন? শুনেছি তেমন কঠিন না।
অনিক বাচ্চা মানুষ কতটা সামাল দিতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। দেখার বিষয় কী দোয়া কর যেন অপরেশন টেবিলেই মরে। মন্ডল বাড়িতে যেন ছোট একটা কফিন আসে। কিন্ত বুবু বারেকের তো এখনো বয়স আছে। যদি আবার ছেলে-মেয়ের জন্ম দেয়?
এত সব ভাবিস না তো কোহিনুর পরেরটা পরে। আগে অনিক তো মরুক। ভিটে তো উচো হোক। পরেরটা পরে ভাবা যাবে। আমার মনে হয় বারেকের আর সন্তান হবে না। হলে এতদিন হত। বউয়ের মনে হয় দিন শেষ। বাচ্চাকাচ্চা আর হবে না। বোনদের কথা শুনে বারেকের শরীর শীতল হয়ে আসে। এতদিন বুবুদের সম্পর্কে তার যে ধারণা ছিল নিমিষেই তা বদলে যায়। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিকে নেমে আসে বারেক।
বিদেশ নিয়ে যাওয়ার আগে ঢাকায় আনা হয় অনিককে। শেষবারের মতো পরীক্ষা করে তবেই বিদেশ পাঠানো হবে। বারেক এবং আয়েশার ভাগ্য সুপ্রসন্ন। অনিকের রিপোর্টে দেখা যায় তার হার্টে কোনো ছিদ্রই নেই। বিদেশ নেয়ার কোনো দরকার পড়বে না। এমন কী কোনো ওষুধেরও দরকার নেই। মিরাকল দেখে ডাক্তারই অবাক!
বাড়িতে ফিরে কিছুদিন পর বুবুদের খবর পাঠায় বারেক। তুহিন গিয়ে খবর দিয়ে আসে। আগস্টের সাতাশ তারিখে তাদের জমির দলিল করে দেয়া হবে। তারা যেন একদিন আগেই চলে আসে। এই খবরে খুশি হয় আবেদা ও কোহিনুর। এত দিনে তাদের মনের ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে। যথা সময়ে মন্ডল বাড়িতে হাজির হয় দুবোন। বাড়িতে এসে রত্না এবং তুহিন ছাড়া কাউকে দেখতে পায় না। মলিন মুখে বারেন্দায় বসে রয়েছে তারা। আবেদা তাদের প্রশ্ন করে।
কীরে ওরা কই? বাড়িতে নেই? রত্না কোনো কথা বলে না। উত্তর দেয় তুহিন। না সাহেবরা নেই। নেই মানে কী, কই গেছে ওরা? আর সব ঘরে তালা ঝুলঝে কেন? তোরাও মনে হচ্ছে কোথাও যাবি? এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন কোহিনুরের। ঠিকই ধরেছেন ছোট ম্যাডাম।
কারণ আমরা আর এ বাড়িতে থাকব না। কী যা তা বলছিস , কি হয়েছে? এই বাড়িটা তো আর সাহেবের নেই। তাই আমাদেরও দিন ফুরিয়েছে। এখন থেকে এই বাড়িটা আপনাদের। বাড়িটা সাহেব আপনাদের দিয়ে গেছেন। এ কথা বলে আবেদার হাতে দলিল দিয়ে স্ত্রীসহ বেরিয়ে যায় তুহিন। দলিলের সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠিটা আগে পড়ে আবেদা।
শ্রদ্ধেয় বুবু, সালাম নিবেন। আপনারা বহুদিন থেকেই বাড়ির মালিকানা বুঝে পাওয়ার জন্য বলে আসছিলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া আমি বুঝিনি আপনারা বিষয়টির এত গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বেশি দেরি হয়ে গেল। আপনারা আমাকে এত অবিশ্বাস করেন সত্যিই আমি জানতাম না। সম্পত্তি নিয়ে এক সময় ভাই-বোনদের দু-এক কথা হয় না এমন পরিবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বুবু, মন্ডল বংশে আপনারা ছাড়া আমার আর আপন কেউ নেই। যারা সর্বক্ষণ আমার পাশে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু আমার ভুল ভেঙে গেছে যেদিন শুনলাম আপনার কামনা করছেন আমার ছেলেটা যেন অপরেশন টেবিল থেকে না ওঠে। ও যেন ওখানেই মারা যায়। আপনারা আমার কিংবা অনিকের এতটা অমঙ্গল চাইতে পারেন নিজে না শুনলে বিশ্বাস করতাম না।
এক সময় আমাদের জমিদারি ছিল, বহু সম্পত্তি ছিল এখন নেই। কিন্তু আমাদের যা আছে দেশে অনেকেরই তা নেই। এখনো দুইশ একরের মত সম্পত্তি আমাদের। যার মধ্যে আপনারা দুবোন প্রায় একশ একর সম্পত্তির অংশীদার। শুনেছি বড় বাড়ির ছেলে-মেয়েদের মনও বড় হয়। কিন্তু আপনারদের দেখে সে ধারণা পাল্টে গেছে। মাত্র সাত একর সম্পত্তির জন্য আপনারা নিজের ভাইয়ের একমাত্র ছেলেটার মৃত্যু কামনা করতে পারো এটা ভাবতে পারি না।
যে ছেলেটা একদিন এই বংশের প্রতিনিধিত্ব করবে। কারো অভিশাপে কিছু হয় কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু আপনারা আমার আপনজন কোনো কারণে তোমরা কষ্ট পাও তা চাই না। এই বাড়ির সাত একরের আপনারা পান সাড়ে তিন এশর। আমি পুরো বাড়িটা আপনাদের নামে লিখে দিলাম। বাকি সম্পত্তি ইচ্ছেমতো ভাগ করে নিবেন। আমার অংশের অর্ধেকটা হাসপাতালের জন্য দান করব ভাবছি। এত সম্পত্তি আমার দরকার নেই। কী হবে এসব দিয়ে।
তুহিন ছেলেটা বহুদিন ধরে আমাদের বাড়িতে নিজেদের লোকের মতো ছিল। গরীব মানুষ এখন ওরা খুব কষ্টে থাকবে তাই ওদের আমি এক বিঘা ফসলি জমি এবং বাড়ি করার জন্য আলাদা করে ১৫ শতাংশ জমি দিয়ে গেলাম।
যখন সম্পত্তি ভাগ হয় আমার অংশ থেকে এই টুকু বাদ দিলেই হবে। আমার প্রমোশনের সাথে সাথে ঢাকায় বদলি হয়েছে। অফিস লোনের মাধ্যমে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি আমরা। খুব বড় নয়। সেখানেই উঠব আমরা। জানি এই বন্ধ জায়গায় অনিকের এবং তার আম্মার খুব খারাপ লাগবে। মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে। অনিক জোহরা মঞ্জিলটা খুব ভালোবাসত। সবুজ না দেখলে ওর ভালো লাগে না। পাখির ডাক না শুনতে পারলে ছেলেটা দম বন্ধ হয়ে আসে।
এখানে থাকতে থাকতে হয়ত একদিন সাঁতারকাটাও ভুলে যাবে ছেলেটা। তারপর একদিন বুঝবে জীবনটা সত্যিই বড় মানানসই।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য