অনিল সেন: অভাব-অনটনে বিপর্যস্ত ছিল গোবিন্দের সংসার। বছরের পর বছর আধাবেলা খেয়ে জীবন চলত তার। তবে চেহারাসুরত দেখে বোঝার উপায় ছিল না কতটা তার অভাবী জীবন। এজন্য তার ওপর ঈশ্বরের কৃপা আছে বলে অনেকে বিশ্বাসও করতেন। গোবিন্দ দ্রুত এক পিকুলিয়ার চরিত্র হয়ে ওঠে।
ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারিতে সে কখনো হারতে চাইত না। তাকে হারানোটাও বেশ কঠিন ছিল। শুধু সমবয়সিরা নয়, বেশি বয়সিদের অনেকেই শারীরিক শক্তিতে তার সঙ্গে পেরে উঠত না। গোবিন্দ কখনো হেরে গেলে পরের দিন আবারো আক্রমণ করত। প্রতিপক্ষের পাল্টা আক্রমণে কখনো কখনো তার ত্রাহি অবস্থা হতো।
তারপরও সে ছিল নাছোড়বান্দা। বেশি বয়সিরা তার ওপর প্রচন্ড ক্ষ্যাপা থাকত। হেরে গেলে অদ্ভুত কিছু গালি দিয়ে শোধ নেয়ার চেষ্টা করত। অনেক সময় দেখে নেয়ার হুমকিও দিত। গালি দেয়ার কারণে বড় মাশুল দিতে হতো তাকে।
আমার বাবাকে গোবিন্দ খুব মান্য করত। একবার দুর্গাপূজায় গোবিন্দ একটা দামি শার্ট নেয়ার আবদার করে। আমরা সবাই রাজি হলাম। গোবিন্দ সেটা বুঝতে পেরে বাবার কাছে ঘুরঘুর করা শুরু করে। বিষয়টা ইতোমধ্যে বাবাও জেনে গেছেন। মজা করে বলতেন, কিরে কী ব্যাপার, ইদানিং দেখছি বেশি বেশি কাছে আসা হচ্ছে! যা বলি তাই করছিস! গোবিন্দ কাচুমাচু করে বলে ঠাকুরদা, তোমরা কোনদিন হাঁটত যাইবেন?
গোবিন্দ এদিক-ওদিক দেখে নেয়। তারপর বাবার কানে কানে বলে, কাকারা কইছে এবারের পূজাত মোক একনা দামি পিরান কিনি দেবে। বাবা গোবিন্দের দিকে তাকায়, ওর মুখে এ রকম হাসি আর কখনো দেখেননি! গোবিন্দের টোলপড়া গালটা আলতো করে টেনে বাবা বললেন, তাহলে তো তোকেও হাটে যেতে হবে। গোবিন্দ বলে, যাওয়া তো নাগবে। তা কোন হাটে যাবি, নাগেশ্বরী? গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলে না, ভেতরবন্দ হাটত যাইম। শত বছর ধরে এই হাটটা সবার অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
গোবিন্দ বাবার ব্যাকব্রাশ করা চুলগুলো পরম যত্নে স্পর্শ করে বলল, ঠাকুরদা মুই তোমার সাথত ভেতরবন্দ হাটত যাইম। বাবা বললেন, তুই টাকা পেয়েছিস? কাল পাইম গোবিন্দ বলল।
গোবিন্দ পরের দিন দুপুরে টাকা নিয়ে হাজির। সে আজ অন্য রকম। চুল ব্যাকব্রাশ করা। মাথার দিকে তাকিয়ে বাবা মুচকি হাসলেন। গলা ঝেড়ে বললেন, একটু খাড়াও, আমি বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আসি।
গোবিন্দ বাঁ-হাতটা কোমরে রেখে ডান হাত দিয়ে সামনের চুল পেছনে দিচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে এক বিরল আনন্দ খেলা করছে তার ভেতরে। দামি পিরান কিনবে কিনা! কিছুক্ষণ পরে গোবিন্দ হাটে রওনা দিল।
হাটে দীর্ঘদিনের পরিচিত দোকানদার, মজিদ। বাবাকে আদাব দিয়ে বললেন, কাকা কী লাগবে? বাবা গোবিন্দকে দেখিয়ে বললেন, ওর জন্য একটা ভালো দামি শার্ট দাও। মজিদ একটার পর একটা শার্ট তাক থেকে গোবিন্দের দিকে ছুড়ে মারছেন। পছন্দ হচ্ছে না। এবার গোবিন্দ নিজেই হাত বাড়িয়ে বলল, ওই পিরানটা দেও। ওটা বড়দের-মজিদ বলল। গোবিন্দ বলল, ওটাই মোক দেও।
মজিদ প্যাকেট থেকে শার্টটা বের করে দিল। বাবা বললেন, ওটা তো তোর অনেক বড় হবে গোবিন্দ! ওটা বড়দের! গোবিন্দ কারো কথা না শুনে গায়ে দিয়ে বলল, মুই এই পিরানটাই নেইম। বাবা বললেন দ্যাখ, এটা কিন্তু তোর অনেক বড় হচ্ছে। মজিদও তাই বলল। গোবিন্দ সোজা জানিয়ে দিল মুই টাকা দিয়া যখন কিনিম বড়টাই কিনিম! গোবিন্দ এখানেও হারতে চাইল না। নিয়ে-ই নিল।
বাড়ি ফিরে সবাই হৈ-হুল্লোড় করে যখন শার্টটা দেখতে চাইল। গোবিন্দের ঘোর আপত্তি! সে চিৎকার করে বলল, এলায় পরলে পিরানটা বাসিয়া হয়া যাইবে। দশমীর দিন পরিম। কিন্তু গোবিন্দের শেষ রক্ষা হলো না। শার্টটা গায়ে দিতেই হলো। সবাই হো হো করে হেসে বলে উঠল ভালো হয়েছে তোর আর প্যান্টের দরকার হবে না! গোবিন্দ এবার জোরেশোরে বলল, ‘টাকা দিয়ে যখন নেইম তখন ছোটটা নেইম ক্যা, বড়টা নিছং, তাতে তোমারগুলার কী?’
গোবিন্দ সবার হাসির অর্থ বুঝতে পেরেছে কিনা বোঝা গেল না। জেতার পেছনে হারানোর কষ্টটাও তার জানার কথা। তবে মূল দৃশ্যটা দেখার জন্য বিজয়া দশমী পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হলো।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য