একাত্তরের মার্চ ছিল উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর, ভয়ংকর। পাকিস্তান নামক শব্দ তখন বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় উড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের পতাকা। এরই মধ্যে ৭ মার্চ ঢাকায় স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন।
জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে বললেন, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। কাগজে-কলমে পাকিস্তান হলেও দেশের প্রশাসন চলছে আওয়ামী লীগের নির্দেশে।
এরই মধ্যে সংকট নিরসনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় এলেন। ১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া একান্ত বৈঠক হলো এক ঘণ্টা। ১৭, ১৯ ও ২০ মার্চও দুজনের মধ্যে কথা হয়। তাদের দুজনের সঙ্গেই ছিল নিজ নিজ পরামর্শক টিম। তারা জানাল, কয়েকটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, যার ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট একটা ফরমান জারি করবেন।
একদিকে আলোচনা চলছে, বিক্ষুব্ধ জনতা তখন থেকে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। ১৯ মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গাজীপুরের বীর জনতা গর্জে উঠেছিল এবং সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর উসকানিমূলক হামলায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। সেনাবাহিনীর এমন কর্মকান্ডকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
এরপর মুজিব-ইয়াহিয়া তৃতীয় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৯০ মিনিটের বৈঠকে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না। ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, মুজিবকে সমর্থন দেয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘গান্ধিজির পরে শেখ মুজিবুর রহমানই এতখানি বিশাল আয়তনে অহিংস শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা লাভ করিলেন’।
তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যেরূপ সাফল্যের সহিত জনসাধারণকে সর্বাত্মক ঐক্যে তাহার পশ্চাতে কাতারবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন, সমগ্র ইতিহাসে অন্য কোনও নেতার জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া বাহির করা খুবই দুষ্কর।’
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ দুপুরে হঠাৎ এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেন। এ কথা শোনামাত্রই সারা দেশের মানুষ স্বতঃফ‚র্তভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে এ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসে। দেশের সর্বত্রই স্লোগান ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালি-বাঙালি’।
বঙ্গবন্ধু ঢাকায় পূর্বাণী হোটেলে এক সভায় ইয়াহিয়ার ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং ঢাকায় ২ মার্চ এবং সারা বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ৩ মার্চ হরতাল আহŸান করেন এবং ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা আহব্বান করেন।
১৯ মার্চের সশস্ত্র যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক মাইলফলক। আকস্মিকভাবে পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার জাহান জেবের নেতৃত্বে পাকিস্তানি রেজিমেন্ট জয়দেবপুরস্থ (গাজীপুর) দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার জন্য পৌঁছে যায়। এ খবর পাওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই হাজার শ্রমিক জনতা চারদিক থেকে লাঠিসোটা, দা, কাতরা, ছেন, দোনালা বন্দুকসহ জয়দেবপুরে উপস্থিত হয়।
রেলগেটে মালগাড়ির বগি, রেলের অকেজো রেললাইন, স্লিপার সহ বড় বড় গাছের গুঁড়ি, কাঠ, বাঁশ, ইট ইত্যাদি যে যেভাবে পেরেছে, তা দিয়ে এক বিশাল ব্যারিকেড দেয়া হয়। জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত আরো ৫টি ব্যারিকেড দেয়া হয়, যাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নিয়ে ফেরত যেতে না পারে।
রেলগেটের ব্যারিকেড সরানোর জন্য দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের রেজিমেন্টকে বিগ্রেডিয়ার জাহান জেব আদেশ দেয়। কৌশল হিসেবে বাঙালি সৈন্যদের সামনে দিয়ে পেছনে পাঞ্জাবি সৈন্যদের অবস্থান নিয়ে মেজর শফিউল্লাহকে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের আদেশ দেয়।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা জনতার ওপর গুলি না করে আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে সামনে আসতে থাকে। বর্তমান গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ওপর অবস্থান নিয়ে বন্দুক ও চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সেনাবাহিনীর ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করি।
এদিন পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে জয়দেবপুরে শহীদ হন নেয়ামত ও মনু খলিফা। আহত হন চতরের সন্তোষ, ডা. ইউসুফসহ শত শত বীর জনতা। পাক বাহিনী কার্ফ্যু জারি করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করলে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। দীর্ঘ সময় চেষ্টা করে ব্যারিকেড পরিষ্কার করে ব্রিগেডিয়ার জাহান জেব চান্দনা চৌরাস্তায় এসে আবার প্রবল বাধার সম্মুখীন হন।
১৯ মার্চের পর সারা বাংলাদেশে স্লোগান ওঠে, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু কর’। ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গাজীপুরবাসীর উদ্দেশে এক পত্রে ১৯ মার্চের সশস্ত্র প্রতিরোধের সময় শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং জয়দেবপুরবাসীকে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য