১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। দিনটি ছিল পাকিস্তান দিবস। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের স্মরণে লাহোর প্রস্তাব দিবস হিসেবেও উদযাপিত হতো। কিন্তু একাত্তরের এদিন পাকিস্তান দিবসে ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবন ও সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা ওড়েনি।
সাধারণ ভোটে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহব্বানে দিবসটি প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। দেশের সর্বত্র উত্তোলন করা হয় স্বাধীন বাংলার নতুন পতাকা। বস্তুত এ দিনই বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। উধাও হয়ে যায় পাকিস্তানি পতাকা।
ঢাকায় সেক্রেটারিয়েট ভবন, হাইকোর্ট ভবন, পরিষদ ভবন, ইপিআর সদর দপ্তর, রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা বেতার ভবন, ঢাকা টেলিভিশন ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, টেলিফোন ভবন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল, প্রধান বিচারপতি ও মুখ্য সচিবের বাসভবনসহ সব সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়।
জনতা ভুট্টো ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শ্লোগান দেয়। জনতা ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কুশপুত্তলিকা দাহ করে।
গণআন্দোলনের প্রবল জোয়ারে ঢাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুক্তিপাগল জনতা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে যায়।
সকাল ১০টায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে পল্টন ময়দানে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। এ সময় ছাত্রলীগ ও সাবেক বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত জয় বাংলা বাহিনীর আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজ ও মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।
কুচকাওয়াজ ও মহড়ার শুরুতে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি এবং সামরিক কায়দায় অভিবাদনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। এ সময় রেকর্ডে জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাজানো হয়। পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্রলীগের ‘চার খালিফা’ নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব ও শাজাহান সিরাজ।
সভা শেষে এই চার নেতা একটি বিশাল মিছিল নিয়ে ধানমন্ডির বাসায় এসে অসহযোগ আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হাতে পতাকাটি অর্পণ করেন। জয় বাংলা বাহিনীর পাঁচ শতাধিক সদস্যও প্যারেড করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যান। তারা সামরিক কায়দায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতাকে অভিবাদন জানান।
বঙ্গবন্ধু সালাম গ্রহণ শেষে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন, ‘বাংলার মানুষ কারো করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতাবলেই আপনারা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেন। বাংলার জয় অনিবার্য।’ সকালে বাসভবনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেন।
এদিন আর বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের সকাল ও বিকেলে দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং অপর পক্ষে এম এম আহমদ, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা ও কর্নেল হাসান উপস্থিত ছিলেন।
বিকেলে পশ্চিম পাকিস্তানি জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার বাসভবনে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে কাউন্সিল মুসলিম লীগের প্রধান, জমিয়তে উলামায়ের প্রধান, পাঞ্জাব কাউন্সিল লীগের প্রধান ও বেলুচিস্তান ন্যাপের সভাপতি উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা চাই দেশের মঙ্গলের জন্য সবকিছু খুব তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হয়ে যাক।’ এ সময় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা ভালো কামনা করুন, কিন্তু খারাপের জন্যও প্রস্তুত থাকুন।’
সন্ধ্যা ৭টায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাসায় দেখা করে তার পূর্ণ সমর্থন ও আনুগত্য প্রকাশ করেন।
রাতে বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত ‘আমার সোনার বাংলা...’ পরিবেশন করা হয়।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য