-->

স্বপ্ন ভাঙার গল্প

মোরশেদুল ইসলাম
স্বপ্ন ভাঙার গল্প

ঘাটের অদূরেই নয়া বাজার। বাজারের পিঠ ঘেঁষে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক মেহগনি গাছ। ফাগুনের শেষ দিকের আগুনে ঝরে গেছে তার পাতা; কাঁচা, পাকা সব পাতাই ঝরে গেছে। পড়ে থাকা উলঙ্গ ডালগুলো মাঝে মধ্যে কেঁপে ওঠে পাগলা হাওয়ায়।

 

চৈত্রের শুরুতে বৃন্তে বৃন্তে ও বাঁকল ফেটে শুরু হয় পাতা গঁজানো। ট্যালকাম পাউডারের মতো ধুলো সারাখন ওড়ে। সেই ধুলোয় ধূসরিত চারদিক। ফলে ব্রহ্মপুত্র নদের বুক চিরে-ফেঁড়ে কোন নৌকা ঘাটে আসছে, কে নামছে তা এই মেহগনি গাছের নিচ থেকে বুঝতে পারে না রহিম উদ্দিন।

 

তবু গাছের নিচের টঙে বসে থেকে ঠাহর করার চেষ্টা করে চলে সে। অনেক মানুষ, অনেক কন্ঠস্বরের ভীড়ে সে ভাবে, এই বুঝি শহর থেকে ফিরে এলো তার ছেলে; একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, খোঁজে। গত একমাস ধরেই রোজ বিকেলে ঘাটে শহর ফেরৎ নৌকা ভেড়ার সময় রহিম উদ্দিনকে বসে থাকতে দেখা যায় এই মেহগনি তলার টঙে। কিন্তু ছেলে আর ফেরে না!

 

আজকের বিকেলটা অন্য বিকেলগুলোর চেয়ে একটু বেশি ধুলি ধূসরিত। অনেক খন ধরেই টঙে বসে আছে রহিম উদ্দিন। নৌকা এখনও আসে না। তার মনটা আনচান করে। হঠাৎ নৌকা আসছে বলে কেউ একজন আওয়াজ দিলে তার মনের আনচান আরও বেশি বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে শহর ফেরৎ মানুষের কণ্ঠ স্বর ও পায়ের শব্দে কান খাঁড়া করে সে। পাশে বসে থাকা অন্য আরেকজন বলে ওঠে, ‘জ্যাটো, পুলিশ আসলো বাহে!’

 

পুলিশ আসছে; পুলিশ আসলে আর কী-বা করার আছে রহিম উদ্দিনের! ছেলে তো বাড়িতে নেই; ফেরেনি এখনও। পুলিশ গ্রাম চৌকিদারসহ তাদের অন্যান্য সোর্সের মাধ্যমে নিয়মিতই খোঁজ-খবর রাখে যে আসামি বাড়িতে আছে কিনা। এবং আসামি বাড়িতে নেই জেনেও তারা মাঝে মধ্যেই আসে ও যায়; এটা তাদের রুটিন ডিউটি বলেই ধরে নেওয়া যায়। বয়স বেশি নয় রহিম উদ্দিনের; ষাটের আশেপাশেই।

 

তবু বয়সের থেকেও অনেক বেশি বুড়ো হয়ে গেছে সে। ছোট বেলা থেকেই বাবা না থাকায় অন্যের বাড়িতে থেকে, ভৃত্যের কাজ করে করে বড় হয়েছে সে। যুবক বয়সে যখন সে মাকে হারায়, মালিকের থেকে প্রাপ্ত দরমা দিয়ে শুরু করে কাঁচামালের ব্যবসা। সেই ব্যবসাতেও দরমার পাশাপাশি বিনিয়োগ করেছিল সে হাড়ভাঙা শ্রম। সেই কথা এখনও সে এলাকার যুবক ছেলেদের বয়ান দেয়: ‘তোমরা কী করেন রে, বাবারা! মুই, দ্যাহো, মাইনষের বাড়িত খাটি খায়া, ব্যবসা করি জমি-জিরেত কিনছোং,

 

তিন তিনটা বেটিক ডিম্যান দিয়ে ব্যাঁচে খাইচোং; বড় ব্যাটাক পুলিশ বানাইচোং! আর, তোমরা এলা কী করেন হে চান্দুঁরে?’ এবং তার এই চরাঞ্চলের সিকিস্তি জীবনে পরিশ্রম করে জমি কেনা, মেয়েদের সাধ্যমতো যৌতুক দিয়ে বিয়ে দেওয়া, বড় ছেলেকে পুলিশের সেপাই বানানোর মতো সাফল্যের গল্পের সত্যতা মেলে যখন এখনও রহিম উদ্দিন অসুস্থ শরীর নিয়ে টুকটাক শাক-সব্জী ও এটা-ওটা আবাদ করে এবং সেসব বিক্রি করে ছোট ছেলেটার লেখাপড়ার খরচ জুগিয়ে যায়, তাতে।

 

রফিক নামের ছোট ছেলেটা তার জিপিএ ফাইভ পেয়েছিল এসএসসি পরীক্ষায়। গ্রামের দু-চারজন শিক্ষিতের পরামর্শে রফিককে ভর্তি করানো হয় রংপুর শহরের একটা সরকারি কলেজে। সেটা করোনা মহামারির আগের কথা। ছেলে শহরে থাকায় একটা এনালগ ফোন কিনে দিয়েছিল তার বাবা।

 

হঠাৎ করেই শুরু হয় করোনা। রাস্তা-ঘাট-বাজার, সব বন্ধ। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। এটা সেই সময়ের কথা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে ক্লাস ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করে তখন অনেকটা প্রয়োজনের তাগিদে, কিছুটা ছেলের জিদের ফলে তাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিতে হয়েছিল।

 

ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ভেসে থাকা চরের মতো করোনার শাটডাউন-লকডাউনে ছেলের পড়াশোনা নিয়ে রহিম উদ্দিনের স্বপ্নও জ্বলজ্বল করেছিল চোখে-মুখে। মাঝেসাঁঝেই গ্রামের আলাউদ্দিন মাস্টারের সাথে তার স্বপ্ন ও শঙ্কা শেয়ার করত সে। মাস্টার বলতেন: 'চিন্তা করিস না ভাই, লকডাউন-ফকডাউন যা-ই হোক, লেখাপড়া তো আর থামি নাই; ব্যারামটার ব্যাগ একটু না কমা তক মোবাইলেই চলবে এইদোন করি। সমস্যা নাই, আল্লাহ ভরসা; সগ্লের যা হইবে হামারো তা-ই হইবে।’

 

আলাউদ্দিন মাস্টার পুরনো মানুষ। স্মার্ট ফোনের ফিচার ও ফাংশন সম্পর্কে তার ধারণা কতটুকু সেটা পাঠকরা জানেন। কিন্তু তিনি তা জানেন না বলেই নিজেও চিন্তিত নন, অন্যদেরও চিন্তিত না হতেই যে পরামর্শ দিবেন তা খুবই স্বাভাবিক।

 

রফিক স্মার্ট ফোন প্রজন্মের ছেলে। অনলাইনে ক্লাস যদি ৩ টা করে, ফোনের বিভিন্ন অ্যাপ্স নিয়ে গবেষণা করে ৬ ঘন্টা! কখনও নিজে চেপে চেপে কখনও তার দোস্ত বাইজিদ, সেলিম, রাজিব প্রমুখের সহায়তায় ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে সে নানা অ্যাপ্স সম্পর্কে। একদিন রাজিব তাকে ভিন্ন কিছু অ্যাপ্সের, কিছু পর্নো সাইটের খোঁজ দেয়। আবার সেলিম একদিন তাকে জ্ঞান দেয় পাবজি, ফ্রি ফায়ার ইত্যাদি সম্পর্কে। আর, কার্ড কিংবা লুডুর মতো খেলাগুলো তো পানি-পান্তা তাদের জন্য!

 

 

আর এসবের ফলাফল যে নিকট ভবিষ্যতে রফিকের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না এ কথাটাও বলার কেউ ছিল না তার। সব সময় মাথা নিচু করে ফোনে চোখ লাগিয়ে থাকতে দেখে বুড়ো রহিম উদ্দিন ভাবত তার ছেলে অনেক পড়ে! গর্বে ফুলে উঠা বুক নিয়ে সগতোক্তি করত, ‘এই ছাওয়া মোর বড় অফিস্যার হইবে একদিন!’ আর ছেলেকে বলত, ‘সারাদিন এত পড়িস ন্যা বাবা ফোনোত; চোখ কানা হয়া যাইবে গো!’ রফিক হাসি দিত৷ বাবা তো আর জানে না ছেলে স্মার্ট ফোনে পড়াশোনা করে না অন্য কিছু করে।

 

সদাশয় সরকার যখন পরীক্ষা না নিয়েই অটো পাস ঘোষণা করল তখন রফিকের সাথে সাথে তার বাবাও বেজায় খুশি। কিন্তু ব্যাপারটা যখন বড় ছেলে খোলাসা করল তখন রহিম উদ্দিনের খুশি উড়ে যায় বাষ্প হয়ে! তবু আশা ছাড়ে না সে। আলাউদ্দিন মাস্টার তাকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ছেলে ভার্সিটি পড়বে, বড় অফিসার হবে একদিন। সময় গড়ায়; রহিম উদ্দিনের স্বপ্ন মরিচীকার মতো শুধু সামনের দিকেই দৌড়ায়; তাকে আর ধরা দেয় না! একটা ভার্সিটিতেও চান্স না পেয়ে অবশেষে রফিক ভর্তি হয় একটা কলেজে!ব্রহ্মপুত্রের বুকে স্রোত বয়ে চলে। একদম নিঃশব্দে।

 

পুলিশ ফিরে যাওয়ার পর টঙে বসে বসে তেমনই নিঃশব্দে চোখে ঐসব অতীতের ভেসে ওঠা দেখে রহিম উদ্দিন। তাকে সান্ত¡না দেওয়ার চেষ্টা করে দু'একজন: ‘ধূর বাহে, কিছুই হবান্নয়, চুপ করি থাকো তো। কোনোমতে তিনটা মাস পাড় হয়া গেইলে, চার্জশিটখ্যান দিলে, সোইগ ঠিক হয়া যাইবে।’ কিন্তু রহিম উদ্দিনের মনে এসব সান্ত¡না ঢোকা পায় না।

 

কারণ সে জানে, তার পুলিশ ছেলের থেকে শুনেছে, রফিকের বিরুদ্ধে শুধু অপহরণ মামলাই করা হয়নি সাথে রয়েছে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে’র ধারাও। যদিও সে ওসব ডিজিটাল-মিজিটাল কিছুই বোঝে না তবু তারই পুলিশ ছেলে যেহেতু বলেছে এটা মারাত্মক মামলা কাজেই তাকে আর বোঝানো দায়।

 

চলছে বিকেলের বিদায়ের আয়োজন। জমে উঠছে বাজার। কতখন আর টঙে বসা থাকা যায়! আস্তে আস্তে রহিম উদ্দিন ওঠে; জলিল বিড়ির একটা প্যাকেট কিনে একটা বিড়ি জ্বালায়। তার মুখ ভর্তি ধোঁয়া বের হয়; সাথে বের হয় কাশিও। কাশির শব্দ শুনে পাশের চায়ের দোকানে বসে থাকা আলাউদ্দিন মাস্টার বুঝতে পারেন এটা রহিম উদ্দিন। তাকে ভিতরে ডেকে নিয়ে চা খাওয়ার জন্য বলেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প ওঠে পুলিশ আসার এবং রফিকের।

 

আলাউদ্দিন মাস্টারসহ আরও কয়েকজন শ্রোতা মেতে ওঠে সে গল্পে। রহিম উদ্দিনের স্বপ্ন ভাঙার গল্প। চায়ের খালি কাপের মতো খালি হয়ে পড়ে আছে রহিম উদ্দিনের বুক! বাইরে সন্ধ্যা নামে। আঁধার ঢেকে দিয়ে যায় দোকান-পাট, বাজার, ঘাট; ঢেকে দিয়ে যায় ব্রহ্মপুত্র নদ। সাথে ঢেকে যায় রহিম উদ্দিনের স্বপ্নহীন বুক। সে তাকিয়ে রয় আঁধারের দিকে। নিশ্চুপ শ্রোতারা আলাউদ্দিন মাস্টারের কাছে গল্প শোনে রফিকের:

 

কলজে ভর্তি হয়ে কোনো এক মেয়ের প্রেমে পড়ে রফিক। মেয়েটা ইতোমধ্যেই জড়িত ছিল আরেকটা ছেলের সাথে। রফিক নাছোড়বান্দা। একই শ্রেনিতে পড়ার সুবাদে খুব সহজেই মেয়েটার সাথে সংযুক্ত হয় ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে। এক পর্যায়ে লবণ দিয়ে পাকানো কাঁঠালের মতো প্রেম বাসা বাঁধে মেয়েটার হৃদয়ে। আসলে, তাদের প্রেম যতটা না বাস্তবে ছিল তারও চেয়ে বেশি ভার্চুয়াল।

 

ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপে ফেলে আসা প্রেমের চিহ্ন জমে জমে পাহাড় সমান হয়ে যায় একটা পর্যায়ে। সেই পাহাড় একটা সময় দৃষ্টি কাড়ে মেয়ের প্রথম প্রেমিকের। দানা বাঁধে ত্রিমুখী সংকট। হঠাৎ একদিন মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যায় রফিক। প্রথম প্রেমিক ও মেয়ের অভিভাবক জোট বাঁধে। তারপর তাদের মামলা হামলায় রফিক এখন বাড়ি ছাড়া; ফেরারি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version