-->

একা

নদের চাঁদ ফকির
একা

নদের চাঁদ ফকির: টপ ফ্লোরে সাজিদদের মেস। গরমের দিনে প্রচণ্ড গরম, শীতে তীব্র ঠান্ডা। এসব সহ্য করে তাদের বছর পার করতে হয়। উপায় কী, ঢাকা শহর ব্যাচেলরদের জন্য বড় অসহায় জায়গা। মেস পাওয়া মহামুশকিল। সে কারণে ইচ্ছার বিরদ্ধেও অনেক কিছু করতে হয়। সাজিদের চব্বিশ বছর বয়সে সে কখনো এমন পরিবেশে থাকেনি। এখন থাকতে হচ্ছে। সময় মানুষকে কতটা বদলে দেয়! এমন একসময় ছিল, যখন নিজেকে নিয়ে মগ্ন থাকত। সময়মতো পড়াশোনা, খাওয়া এবং আড্ডার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তার পৃথিবী। পরিবারের সবার আদরের ছিল সে। বাবা, মা, ভাই, বোনদের আদরে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর।

 

হঠাৎ জীবনে ছন্দপতন ঘটে সাজিদের। মা মারা যাওয়ার এক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই বাবা নতুন স্ত্রী ঘরে আনেন। বড় বোনের বিয়ে আগেই হয়ে গিয়েছিল। সৎ মায়ের অত্যাচারে ছোট বোনটাকেও বেশি দিন ঘরে রাখা সম্ভব হলো না। বিয়ে হলো ইতালি প্রবাসী এক ছেলের সাথে। বোনটি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেলেও মুক্ত হতে পারল না সাজিদ। এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটি বছর। বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় শেষ হলো তার পড়াশোনা। ইতোমধ্যে তার বড় ভাই বিয়ে করলেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে অপ্রিয় হয়ে উঠল ভাইয়া-ভাবির কাছে। বাবা স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকতে শুরু করলেন। বাবার কাছে সে অনেক আগেই অজানা কারণে অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মা মারা যাওয়ার সময় তার হাতে তুলে দিয়েছিল সাজিদকে। বাবা মাকে কথা দিয়েছিল- সে অবুঝ সাজিদকে কখনো ফেলে দেবেন না। পড়াশোনা শেষ হতে না হতেই ভাইয়া বারবার চাকরির তাগিদ দিলেন। অবশেষে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকরি জুটে গেল। এক সময় সে বুঝতে পারল, ভাইয়া তাকে একসাথে রাখতে চায় না। চাপা স্বভাবের সাজিদ এক সময় কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একদিন মেসে ওঠে। ভাইয়া-ভাবী যে খুশি হলেন তার বুঝতে বাকি রইল না। অথচ এমন এক সময় ছিল সাজিদ ঘরে না ফিরলে খাবার খেত না ভাইয়া। একটু সর্দি-কাশি হলে সে সাজিদের চেয়ে বেশি ভেঙে পড়ত। জোর করে নিয়ে যেত ডাক্তারের কাছে। কিন্তু আজ সে একশ তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে শুয়ে আছে। দেখার কেউ নেই।

 

আগামীকাল ঈদ। সে জন্য মেস মেম্বার বলতে সে একা। নাড়ির টানে সবাই ছুটে গেছে আপনজনের কাছে। বুয়াও চলে গেছে গ্রামের বাড়িতে আপনজনের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। কিন্তু সে কোথায় যাবে। কাছের মানুষগুলো এখন তার কাছে ঝাপসা। এখন পর্যন্ত বাবা একটি ফোন করল না। ছোট বোনটা ইতালি থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে ‘অগ্রিম ঈদ মোবারক, ভালো থাকিস ভাইয়া’। এই বোনটা কত আদরের ছিল। সাজিদ তাকে কখনো চোখের আড়াল হতে দিত না। সেই বোনটা এখন কত যান্ত্রিক হয়ে গেছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া একটি ফোনও করে না। বড় বোনটার অবস্থাও তাই। ভাইয়াও যান্ত্রিকতায় গা ভাসিয়ে দিয়েছে।

 

মেসে আসার পরও সে প্রতি সপ্তাহে একবার ভাইয়ার কাছে যেত। একদিন ভাইয়া বলল, ‘তোর কষ্ট করে এত ঘন ঘন আসার দরকার কী’। তাছাড়া ছুটির দিনে তোর ভাবিকে নিয়ে মাঝে মাঝে বাইরে বের হই। সেদিন খুব কষ্ট পেয়ে বৃষ্টির মধ্যে ভাইয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছিল সে। ভাইয়া একটিবারও বলল না বৃষ্টি থামুক তারপর যাস।

 

সাজিদের উচিত গ্রামের বাড়িতে যাওয়া। ঈদের নামাজ শেষে মায়ের কবর জিয়ারত করা। কিন্তু সে যায়নি। ওখানে গেলে সবাই শুনবে বড় ভাই আসেনি কেন, বাবা কোথায় ইত্যাদি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখে পানি জমে ওঠে। সুখে-দুঃখে যারা এক ছাদের নিচে ছিল, সেই মানুষগুলো আজ অনেক অনেক দূরে। একটি দিন সন্ধ্যা করে বাড়ি ফিরলে যে বাবার শঙ্কায় বুক কাঁপত সেই বাবা আজ কতটা বদলে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে। মানুষ কীভাবে এতটা বদলে যেতে পারে কে জানে। এক সময় তার মনে পড়ে আবু জালাল স্যারের কথা। স্যার প্রায় বলতেন, সময়ের প্রয়োজনে আমরা সবাই এক সঙ্গে থাকি। আসলে সবাই একা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বাস্তব এটি। কাছের মানুষগুলো একদিন অনেক দূরে চলে যাবে এটি চিরন্তন। পৃথিবীর নিয়মটি এমনই। যদিও বিষয়টি কষ্টের কিন্তু সত্য। স্যার এখন কোথায় আছে সে জানে না। এতদিন পর স্যারের কথাগুলো তার কাছে খুব বেশি বাস্তব মনে হয়। ছেলেবেলায় যে কথা মূল্যহীন মনে হতো। বিছানা ছেড়ে জানালায় এসে দাঁড়ায় সাজিদ। চোখ যায় বাইরের বাতাবি লেবুর গাছটির দিকে। যেখানে সবুজ পাতার ওপর সোনালি রোদ খেলা করছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বিলীন হবে এই অদ্ভুত ভালোলাগার দৃশ্য। পৃথিবীতে কিছুই স্থির নেই। সবকিছু ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version