জোবায়ের রাজু: পকেটের ভেতরে মোবাইল বেজে উঠলে বুকটা হঠাৎ করে কেঁপে উঠে আসলাম মিয়ার। গত তিন দিন থেকে এই সমস্যাটা হচ্ছে। যখনই কল আসে, মনে হয় মেয়ে মিতার কল এসেছে। কাঁপা হাতে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে যখন তীক্ষè চোখে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন কার কল এসেছে, ছোট্ট মোবাইলের চারকোনা পর্দায় মিতার নাম দেখলে গলাটা যেন নিমেষে শুকিয়ে আসে। রিসিভ করলেই ওপাশ থেকে মেয়েটার প্রবল অনুরোধের বুলি কানে বাজবে- ‘আব্বা, টাকার ব্যবস্থা করেছেন তো? ঈদ তো এসে গেছে। কবে একটা খাসি নিয়ে আমার শ^শুরবাড়িতে আসবেন? দোহাই আব্বা, আমার সম্মান বাঁচান। নয়তো আমাকে নানা কটুকথা হজম করতে হবে।’
মেয়ের এমন আবদার শুনে অকূলপাথারে পড়ে যান আসলাম মিয়াা। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যেন তার জীবনে দুর্দশা নেমে এল। আর্থিক অবস্থা একেবারেই নড়বড়ে আসলাম মিয়ার। দিনে এনে দিনে খায় অবস্থা। এক বছর আগেও ঘরে তার বিয়ের উপযুক্ত কন্যা মিতা ছিল, যার চোখ ঝলসানো রূপের জৌলুসে দশ গ্রামের মানুষ বিস্মিত। মেয়ে তো নয় যেন পূর্ণিমার শশী। রূপের সৌন্দর্যের কারণে পালপাড়া চৌধুরী বাড়ির বউ হয়ে যায় অতি সাধারণ ঘরের মিতা, যার বাবা একজন নিম্নমানের পল্লী চিকিৎসক। মামুন চৌধুরী তার সেজো ছেলে রাজীবের জন্য মিতাকে চাইলেন আসলাম মিয়ার কাছে। আসলাম মিয়া না করতে পারেননি সেই প্রস্তাব। ওতো বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে হবে, এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
বিয়ের পর শশুর শাশুড়ির কাছ থেকে কোনো তাচ্ছিল্য না পেলেও মিতার বড় দুই জা তাকে ইশারা ইঙ্গিতে বোঝাতেন যে বাপেরবাড়ি থেকে এই সংসারে কিছু না কিছু এনে নিজের হিম্মত দেখাও। কিন্তু মিতা এমনই এক বাবার মেয়ে যে আসলাম মিয়া মেয়ের দাবি পূরণে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। তাই শ^শুরবাড়িতে নিজেকে খুব দুর্বল প্রজাতি হিসেবে ভাবতে অনেকটা লজ্জা পেতে থাকে মিতা। আর তার দুই জা তো বড় ঘরের মেয়ে হবার কারণে একধরনের দাম্ভিকতায় তাদের চরণ যেন মাটিতে পড়ে না। সুযোগ পেলেই মিতাকে তারা আকার ইঙ্গিতে জানিয়ে দিয়েছে ‘তোমার মতো মেয়ে এই চৌধুরী বংশে উপযুক্ত নয়।’
কিছুদিন পর কোরবানির ঈদ। মিতার দুই জা এবার মুখের ওপর বলে দিয়েছেন, ‘বাপের বাড়ি থেকে কখনো তো কিছু আনোনি, বিয়ের পর এবার তো তোমার শ^শুরবাড়িতে প্রথম ঈদ। গরু না হোক, অন্তত একটা ছাগল তো আমরা আশা করতেই পারি।’
দুই জা যখন তিক্ত প্রস্তাবটি দিয়েছেন, মিতা শুধু মরা হাসি দিয়ে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
বাবাকে ফোন করে সে খবর জানাতেই আসলাম মিয়ার মুখের হাসি চলে গেল। একটা ছাগল কেনার পয়সা যে তার কাছে নেই। তবুও মেয়েকে কথা দিয়েছেন, ‘চিন্তা করিস না তুই, তোর আবদার রাখব।’ কৃতজ্ঞতা জড়ানো গলায় মিতা বলল, ‘আমার মান বাঁচাও বাবা। আমার দুই জা বড় ঘরের আদরের কন্যা। আসবাবপত্র এনে আমার শ্বশুরবাড়ি তারা ভরিয়ে ফেলেছেন। তুমি অন্তত একটা ছাগলের ব্যবস্থা না করলে আমার মান-ইজ্জত সব খোয়া যাবে।’
সেই ছাগল কেনার টাকা জোগাতে আসলাম মিয়া যেন সাত ঘাটের জল পান করে হাঁপিয়ে উঠেছেন। নিরুপায় হয়ে দুঃসম্পর্কের এক ধনী মামাতো ভাইয়ের কাছে ক’টা টাকা ধার চাইতেই দশ হাজার পেয়ে গেলেন। তারপর বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টেনেটুনে আরো দশ হাজারের ব্যবস্থা করে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।
২.ফুরফুরে মন নিয়ে আসলাম মিয়া পশুর হাটে গিয়ে ভড়কে গেলেন। ছাগলের আকাশ ছোঁয়া দাম শুনে তার মুখটা বেজার হয়ে গেল। ত্রিশ হাজার টাকা হলে চোখে লাগার মতো একটা ছাগল কেনা যায় বটে, কিন্তু এই টাকা আসলাম মিয়ার পকেটে নেই। অসহায়ের মতো পশুর হাটের এদিকে ওদিকে পায়চারি করতে করতে অবশেষে অনেক দর কষাকষির পর আঠার হাজার টাকায় যে ছাগলটি কিনেছেন, সেটি দেখতে খুব একটা জুতসই মনে হচ্ছে না।
সন্ধ্যার ছায়া পড়া আধো আঁধার। আসলাম মিয়া ছাগল নিয়ে মেয়ের শ^শুরবাড়ি যাচ্ছেন। পথে পরিচিত যার সঙ্গেই দেখা হয়েছে , সবাই উপহাসের ছলে মুচকি হেসে জানতে চাইছে, ‘এত ছোট্ট সাইজের ছাগলকে কোরবানির জন্য কে বিক্রি করেছে?’
অসহায় চোখে আসলাম মিয়া ছাগলটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। সবাই মিথ্যে বলছে না। ছাগলটা দেখতে এতটাই ছোট্ট যে বিক্রেতা হয়তো পয়সার জন্য নিরুপায় হয়ে এবার কোরবানির হাটে ছাগলটাকে নিয়ে এসেছেন! কিন্তু এই অতি সাধারণ দামের ছাগলটা কেনার জন্য আসলাম মিয়াকে কি একটা ঝাঁক্কি পোহাতে হয়েছে, তা তিনি আর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না।
এই ছোট্ট ছাগলটার জন্য শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে মিতাকে না জানি কী পরিমাণ অবজ্ঞা পেতে হয়, সে কথা ভাবতে গিয়ে আসলাম মিয়ার চোখে পানি চলে এল। যেন অন্য এক বাস্তবতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তিনি।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য